দুটি অসাধারণ শিক্ষনীয় গল্প বাংলা, থাকছে আজ। এই দুটি গল্পের মধ্যে নতুন কিছু শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন লেখিকা।

বাংলা ছোট গল্পঃ-

শিক্ষনীয় গল্প বাংলা- “শো অফ না পরিচয়?”

ক্লাসে দেবীই সবচেয়ে বড়লোক পরিবারের মেয়ে। রোজ গাড়ি করে আসা চাই । নিত্যনতুন সুস্বাদু , লোভনীয় টিফিন আনা চাই। প্রতিদিন দামী ব্র্যান্ডের ব্যাগ এর ঢল। স্কুল বলে তাই এতটুকু, বাড়িতে তার আরো রাজকীয়তা, আরো বিলাস ব্যসন আরো প্রাচুর্যতার নিদর্শন। 

অন্যদিকে প্রশান্ত অত্যন্ত গরীব। রোজ ঠিক মতো টিফিন আনতে পারে না, ব্যাগ আর জুতোই দুটোই প্রায় ছিঁড়ে গেছে। জামাটাতেও তালি মারা আছে। সাইকেলে করে আসে সে কোনো একটা জায়গা থেকে কাজ করে। স্কুল ড্রেস ব্যাগ এ করে খুব সকাল সকাল কোথায় যেন কাজ করে তারপর স্কুল ড্রেস পরে সোজা স্কুলে চলে আসে। দেবী খুব তাচ্ছিল্য করে তাকে। সব বন্ধু বান্ধবী দেবীর একার অধীনে। প্রশান্ত এসব ব্যাপারে মাথা ঘামায় না কিন্তু দেবী যেদিন তাকে ডেকে সকলের সামনে টিফিন টাইমে অপমান করে তখন থেকেই প্রশান্ত দেবীর চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয় দেবী আসলে অহংকারে কতটা অন্ধ!

তখন টিফিনের সময়। প্রশান্ত আজ কিছু আনতে পারে নি টিফিন। সে বাইরে ঘুরতে থাকে। হঠাৎ দেবী তার সামনে এসে বলে, তুই বুঝি আজ টিফিন আনিসনি তাই না প্রশান্ত, খাবি আমার টিফিন দেখ আমার টিফিন বক্সে আছে, আমি না আর খেতে পারছি না, ফেলে দিতে যাচ্ছিলাম কিন্তু তুই যখন আনিসনি তখন আমার টিফিনটাই খেয়ে নে।

শিক্ষনীয় গল্প বাংলা bangla choto golpo
শিক্ষনীয় গল্প বাংলা bangla choto golpo

সবাই হেসে ওঠে আর প্রশান্ত প্রচন্ড অপমানিত হয় আর নীরব থাকে। এতে দেবী আরো অনেক কিছু বলে। কিন্তু আর চুপ থাকে না প্রশান্ত। সে বলে ওঠে, “দেবী হয়ত তোর বাবার অঢেল অর্থ আছে কিন্তু আমার বাবার নেই, হয়ত তোর জীবনে এখন অনেক বিলাসব্যসন কিন্তু আমার জীবনে শুধু লড়াই। হয়ত তোর জীবনে তুই অনেক সহজে যেটা পাস, সেটা আমি আমার জীবনে পাবো এমন স্বপ্নও দেখি না। কিন্তু তবুও তোর কাছে একটা জিনিস নেই যেটা আমার কাছে আছে, সেটা হলো বাস্তবকে উপলব্ধি করে লড়াইয়ের ক্ষমতা। আজ আমি তোকে একটা কথা বলছি, মিলিয়ে নিস।”

” তোর টাকা আছে বলেই কিন্তু সবাই তোর চারপাশে ঘুরঘুর করছে কারণ মধুভরা চাকের পাশেই মৌমাছি ঘোরে , খালি চাকে নয়। আর যারা তোর চারপাশে ঘুরঘুর করছে তারাও আজ বুঝতে পারছে না যে তারা অচিরেই কারোর দাসত্ব ধীরে ধীরে গ্ৰহণ করে ফেলছে সামান্য ফূর্তির জন্য তাও আবার ফ্রি তে, অন্যের টাকায়। ফ্রি তে নিজের সম্মান বিক্রি করছে। তুই একদিন ভিখারী হয়ে যা দেখ তোর চারপাশ থেকে সবাই সরে পড়বে দেবী।”

পড়ুন- মজার গপ্পো-সপ্পো 

“আর একটা কথা, জীবনটা এত সহজ নয়। তোর বাবার টাকা বলেই তুই বুঝতে পারিস না যে টাকা কামাতে গেলে কতটা রক্ত কে জল করতে হয়। নিজে যেদিন কামাবি সেদিন বাস্তবতার কঠিনত্ব অনুভব করার ক্ষমতা পাবি। আর বাবার টাকায় শো অফ করে কি হবে বলতো, সেই তো একদিন শুনবি নিজের পায়ে না দাঁড়ালে , নিজের পরিচয় না তৈরি করলে কেউ তোর মতামত শুনবে না সে তুই যাই হ না কেন!” 

তুই নতুন ড্রেস পরে দাঁড়াবি কেউ তোকে নয়, তোর নতুন ড্রেসটাকে দেখবে আর তুই ভাববি তোকে দেখছে। আর ভাববি তোর কত টাকা আছে সেইটা ভাবছে। না রে, তোকে কেউ দেখছে না বা তোর কত টাকা আছে সেটাও কেউ ভাবছে না, ভাবছে তুই কতটা ভাগ্যশালী যে কতটা বড়লোকঘরে জন্মেছিস। তুই যদি দামী কিছু খাস বা ব্যবহার করিস, সেক্ষেত্রেও তোর খাবার আর জিনিসটাকেই লোকে দেখবে, তোকে নয়। কারণ লোকে ভালো করেই জানে যে এগুলো তোর পরিবারের কৃতিত্ব, তোর কৃতিত্ব নয়।

কাউকে অপমান করে, ছোট করে নিজে বড় হওয়া যায় না। তুই হয়ত আজ ভাবছিস যে তুই ক্লাসের মধ্যে সবচেয়ে দামী জিনিস, খাবার ব্যবহার করিস কিন্তু একবারও কি ভেবে দেখছিস, তুই মানুষটা মানুষ হিসেবে কতটা মূল্য অর্জন করেছিস, কতটা দামী হতে পেরেছিস সকলের কাছে!”

দেবী বলে, “আমি দামী বলেই তো সব বন্ধুরা আমার সাথে থাকে।” 

new bengali short story
new bengali short story

প্রশান্ত হেসে বলে, “ওটা তোর পরিচয়ে থাকে না তোর শো অফ এর দৌলতে থাকে। তোর মূল্যে তোর কাছে থাকে না বরং তোর জিনিসপত্রের মূল্যে তোর সাথে থাকে। দামী ব্র্যান্ডের পেছনে না ছুটে নিজেকে মূল্যবান করে তোল। যাতে কেউ বলতে না পারে, বাবার টাকা ওড়াতে সবাই পারে! বাবা মায়ের যতো টাকাই থাকুক, তাদের কাছে অমানুষের মতো জেদ করে আবদার না করে, নিজে একটু অমানষিক জেদের বশে পরিশ্রম করে, বাস্তবের সাথে লড়াই করে টাকা অর্জন করে মা বাবার হাতে তুলে দিয়ে বল, তোমরা তো অনেক দিয়েছ এবার আমি তোমাদের দিলাম। 

নিজেকে এইসব শো অফ এর মাধ্যমে বড় না করে, নিজের পরিচয় তৈরি করে বড় হ। আর হ্যাঁ যার আছে সে কখনো বলে না তার আছে। অপমান করিস না কাউকে, আজ যাকে অপমান করছিস হয়ত দেখবি তাকেই তোর দুঃসময়ে পাশে লাগছে।   

দেবী স্তম্ভিত হয়ে যায় প্রশান্তর প্রশান্ত মহাসাগরের মতো বিস্তীর্ণ কথাগুলো শুনে। সে শুধরে যায় এরপর। সত্যি সত্যিই সে আর থাকে না আগের মতো বিলাসী মেয়ে। মন দেয় পড়াশোনায় প্রশান্তর মতো। নিজেকে তৈরি করে প্রশান্তর কথাগুলোর ছোঁয়ায়। সত্যিই তার আর কোনো বন্ধু থাকে না পাশে, থাকে শুধু প্রশান্ত। বন্ধুরা ছিল তার শো অফ এ তৈরি হওয়া নিজ পরিচয় নষ্ট করিয়ে দেওয়ার সময় আর প্রশান্ত ছিল শো অফ কে নষ্ট করে দেবীর পরিচয় দিয়ে দেবীকে গড়ে তুলে দেওয়ার সময়। অহংকারী, শো অফ করা দেবী এক দিন নিজের জন্য নিজে অহংকার করত যার পাথেয় ছিল দরিদ্র ও লড়াকু ছেলে প্রশান্ত। 

পড়ুন- অসাধারণ ২ টি মোটিভেশনাল স্টোরি 

বাংলা ছোট গল্প-

ক্লাস সেভেন থেকে কোনো অঙ্কই করতে পারত না মিতা। স্কুলে সবাই তাকে নিয়ে খুব হাসাহাসি করত এই নিয়ে। কিন্তু তার মনে পরে যে, ছোটবেলাতেও সে অঙ্কে অনেক ভালো ছিল। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে সে বাকি বিষয়ের উপর খুব ভালো দখল রাখলেও অঙ্কের ক্ষেত্রে তার যেন সবসময় গাফিলতি, এড়িয়ে যাওয়া। 

গোটা রেজাল্ট এর সমস্ত বিষয়ের নম্বর আর অঙ্কের নম্বরের সাথে আকাশ পাতাল তফাৎ। সবসময় তাকে বলা হয় সে যেন অঙ্কে এত নম্বর তোলে। তারপর খুব খারাপ লাগত যখন সে রেজাল্ট পাওয়ার সময় শুনত অঙ্কে ফেল বা অঙ্কে কত পেয়েছ প্রশ্নে চুপ করে থাকাতে। আরো খারাপ লাগে বন্ধুরা যখন সব অঙ্ক পারে আর সে টোকে পাশের বন্ধুর খাতা দেখে। অনেক অপমানিত হতে হয় এই জন্য বন্ধুদের কাছে। কিন্তু কিছু করার নেই, সে প্রপার গাইডের অভাবে অঙ্কে খারাপ। তার উপর নিজে একা একা চেষ্টাও করে না। অঙ্কে তার এত গাফিলতি যে আস্তে আস্তে সে অঙ্কে দুই তিন পেতেও শুরু করল। 

গার্জেন কল, বকা , তার সাথে কথা বলা বন্ধ করেও কোনো কাজ হয়নি মিতার। সে একই রকম রয়ে আছে অঙ্কে। বাড়ির লোক ঠিক করে যতই অভাব থাকুক মেয়েকে অঙ্ক টিউশনে পড়াতে পাঠাবে। তাই হলো, টিউশনে অঙ্ক শিখতে ভর্তি হলো প্রতিমা ম্যাম এর কাছে।  

শিক্ষণীয় গল্প
শিক্ষণীয় গল্প
<

প্রতিমা ম্যামের কাছে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই পাল্টে যায় মিতা। কিন্তু কি ভাবে, তার মানে কি সত্যিই ওর টিউশনের অভাবের জন্য অঙ্ক পারত না? না উত্তরটা প্রতিমা ম্যাম দেননি, দিয়েছিল মিতা নিজেই। 

ক্লাস টেন এর টেস্ট পরীক্ষা ও পরে মাধ্যমিকে অঙ্কে সর্বোচ্চ নম্বর পায় এককালে অঙ্কে কাঁচা ও ফেল করা মিতা চৌধুরী। সবাই খুব অবাক হয়েছিল সেদিন কারণ টেন এর প্রি টেস্টেও যে খুব একটা ভালো নম্বর পায়নি অঙ্কে সে টেস্ট আর মাধ্যমিকে কি করে সর্বোচ্চ নম্বর পেল? বাড়ির লোকেও প্রচন্ড অবাক হয়। মায়ের তো আনন্দ রাখার জায়গাই নেই মেয়ের এত উন্নতির জোয়ার দেখে। 

কিন্তু প্রতিমা ম্যাম কি এমন করেছিল বা বলেছিল মিতা কে যে মিতা আজ এত তুখর হয়ে গেল , এত দূর্বল ছিল যেই বিষয়ে !

পড়ুন- রোগা মানুষের উপাখ্যান 

মিতা সকলের জিজ্ঞাসার অবসান ঘটিয়ে বলে, প্রতিমা ম্যাম না থাকলে জানতেই পারতাম না পড়াশোনার প্রতি ভালবাসা কাকে বলে? সব টিচার বলেন যতবার জানতে চাইবে, যতবার বুঝতে চাইবে আমি বোঝাবো। কিন্তু প্রতিমা ম্যাম আমাকে কখনোই বলতেন না এই কথাটা। বরং বলতেন, মিতা আমি যদি অঙ্ক করতে না পারি তো তুমি আমাকে বোঝাবে। ম্যাম আমাকে অনেক ভালোবাসতেন। কখনো মনেই হতো না যে টিউশন পড়ছি বা উনি আমার শিক্ষিকা, ছোটবেলায় মা যেভাবে আমাকে খেলাচ্ছলে অঙ্ক শেখাতো ঠিক সেইরকমই মনে হতো যে মাইই আমাকে আবার অঙ্ক শেখাচ্ছে। আমি স্কুলে যখন দেখতাম সবাই অঙ্ক পারছে শুধু আমি পারছি না তখন লজ্জা আর ভয়ে আমি নতুন করে জানতে চাইতাম না কিন্তু প্রতিমা ম্যাম আমার প্রণম্য।  

পরে প্রতিমা ম্যাম খুব দামী কয়েকটা কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, অতিরিক্ত ভালোবাসা, অতিরিক্ত জেদ, অতিরিক্ত শাসন, অতিরিক্ত ভয় আর অতিরিক্ত চাপ কখনোই কোনো ছেলেমেয়ের পূর্ণ মস্তিষ্ক তৈরি করতে পারে না । অতিরিক্ত কোনোকিছুর প্রভাব অতিরিক্ত খারাপই হয়।

মিতা যে অঙ্কে কাঁচা তা কিন্তু নয়, ও ম্যাথোফোবিয়া তে ভুগছিল এতদিন। আর আমার মতে প্রত্যেক অভিভাবকের এমনকি টিচারেরও উচিত, সবাই পারছে বলে যে পারছে না তার দিকে নজর দেওয়া। সবার মাথা সমান নয়, সবার বোঝার ক্ষমতাও এক নয়। ভালোবেসে, যত্ন করে যদি কাদা মাটি কে মূর্তি হিসেবে তৈরি করা যায় তাহলে সে একদিন ঠিকই দর্শনীয় মন্দিরের দর্শনীয় মূর্তির স্থান পাবে। স্টুডেন্ট হিসেবে নয় বরং সন্তান হিসেবে দেখা উচিত প্রত্যেক শিক্ষার্থী কে। হয়ত তিক্ত সত্য কিন্তু তবুও আমি বলব আমার শিক্ষকতা জীবনে কেউ আমাকে শিক্ষিকা নয়, মায়ের চোখেই দেখে। যদি সে কিছু না জেনে থাকে তাহলে কখনোই তাকে বলতে নেই যে সে কিছু পারে না।

তার মনোবল ভেঙে দিয়ে কি লাভ আছে? জীবনটাই প্রতিযোগিতা  কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে একজন প্রতিযোগী কে উৎসাহ না দিয়ে যদি শুধু তার খামতি তার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে তার মনোবল কমিয়ে দেন, তাহলে সে কখনো বড় প্রতিযোগী হতে পারবে না। আজ মিতা অঙ্ক কে ভয় পায় না কারণ সে অঙ্ককে ভালোবাসে আর মাধ্যম টা আমি কিন্তু এতদিন ও কোনো মাধ্যম পায়নি স্কুলে। আর বর্তমানে সত্যি এটাই যে আমরা ইঁদুর দৌড়ে নেমেছি, কে কত আগে যেতে পারে, পিছিয়ে পড়াদের দেখব কথা দিয়েও দেখি না।

বাংলা ছোট গল্প
বাংলা ছোট গল্প

নম্বরের একটা সীমা করে রাখি আমরা স্টুডেন্টদের উপর যে এত নম্বরই পেতে হবে।  সে বুঝতে পারল নাকি পারল না সেই বিষয়ে খেয়াল না রেখে আমরা কেবল তার রেজাল্ট দেখি। আচ্ছা যদি সে নিজেকে ঠিক মত তৈরি করার সুযোগটাই না পায় তাহলে সে কি করে টিচারদের ভালো রেজাল্ট উপহার দেয়।

কথাগুলো কাউকে অপমান করে নয় বা স্কুলের থেকে টিউশন ভালো এইরকম ভুল ধারণা প্রবেশ করার জন্যও নয়, এই কাজটা স্কুল বা টিউশন বা বাড়ি যেকোনো জায়গাতেই হতে পারে তবে গুরুকেও শিষ্যের সাথে কখনো শিষ্য হতে হয়, গুরুকেও অনেক সময় শিষ্যের ভালোর জন্য কঠোর এবং স্নেহবৎসল উভয়ই হতে হয় , একজন টিচারও একজন স্টুডেন্ট থেকেই টিচার হয়েছেন, এটা ভুলে গেলে চলবে না।  ভেবে দেখবেন একটু। 

সুস্মিতা গোস্বামী

গল্পের ভাবনায়-
আমাদের গল্প পাঠান- charpatrablog@gmail.com -এই মেল অ্যাড্রেসে। 
সুস্মিতার অনন্য কিছু লেখা- 

স্কুল জীবনের দুষ্টুমি- গন্ধ চক্রান্ত 

অবহেলা থেকে ভালোবাসা- কলেজ লাইফের লাভ স্টোরি 

আমাদের সাথে যুক্ত হবেন যেভাবে- 

ফেসবুক Group - গল্প Junction 

ফেসবুক- ছাড়পত্র

টেলিগ্রাম- charpatraOfficial

WhatsApp Group- ছাড়পত্র (২)

“শিক্ষনীয় গল্প বাংলা।। বাংলা ছোট গল্প। Bengali short story”

Spread the love

Leave a Reply