বাংলা ভালো গল্প ধর্ম পালন নাকি করতে হয় শুদ্ধ কাপড় পরিধান করে। কিন্তু শুদ্ধ কাপড় পরিধান করলেই কি মন শুদ্ধ হয় আদতেও! সেই শুদ্ধ কাপড়ের কি মানুষের চিন্তা কে শুদ্ধ করার ক্ষমতা রাখে!

বাংলা ভালো গল্পঃ- ‘বকধার্মিক’

” ছি ছি তুমি ঐ অশুচি কাপড়ে ঠাকুরঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছো, হায় হায় সব অশুদ্ধ হয়ে গেল!”

প্রমীলা দেবী তার বৌমার কাজকর্ম দেখে বিব্রত হয়ে বলে ওঠেন। 

“মা, আমি তো এইমাত্র স্নান করে এলাম আর আপনি আমাকে অশুচি বলছেন?” প্রশ্ন করে মৌমিতা। 

“কেমনতর স্নান করেছ তুমি! স্নান করেই কি চলে এসেছ, কোনো আচার জানো না, মা কিছু শেখাননি তোমাকে! না শিখিয়েই কি বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। অবশ্য হবেই বা কি করে, তোমরা তো আবার ইউনিভার্সিটি তে পড়া আধুনিক মেয়ে, তোমরা অতশত মানতে যাবেই বা কেন বলো। তবে এটাও জেনে রাখো, আমার কাছে ওসব আধুনিকতা খাটবে না বলে দিলাম। এইবাড়িতে তোমার শ্বশুর বা বাকিরা এমনকি আমার ছেলে পর্যন্ত আমার এই পূজো আর্চা কে মেনে এসেছে নিয়মমাফিক। তোমাকেও ঠিক সেভাবেই চলতে হবে আমি যেমনটি বলব তেমন। বুঝতে পেরেছ?”  

একটি বাংলা ভালো গল্প
একটি বাংলা ভালো গল্প

“সব বুঝলাম কিন্তু কথায় কথায় আমার মা কিছু শেখাননি এই কথাটা টানবেন না। এই বাড়িতে আমি আছি, আমার মা নয়। সুতরাং মাকে বারবার টানবেন না।” 

“তুমি আমার মুখে মুখে তর্ক করছ। সত্যি আমার পূজো তোমাদের জন্যই আর নিষ্ঠাভরে হবে না। পূজোয় ব্যাঘাত ঘটবে তারপর পরিবারের অকল্যাণ নেমে আসবে। তোমার সাথে আর কথা বলে লাভ নেই।”  

মৌমিতা হলো বসু পরিবারে বিয়ে হয়ে আসা সদ্য বিবাহিতা নতুন বৌ। সে বিয়ের আগেই জানত তার শাশুড়ি নাকি সাংঘাতিক ধার্মিক এমনকি তার ধার্মিকতার খপ্পড়ে পড়ে গোটা বসু পরিবারও ধার্মিক নামক ছোঁয়াচে রোগের রোগী। চিকিৎসা দরকার তাদের তাই চিকিৎসক হিসেবে বাড়িতে আবির্ভাব ঘটে মৌমিতার। ও দেখতে চায় এই রোগটার নাম ধার্মিক না বক ধার্মিক? 

যাই হোক, দিন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই আচার, সেই আচার। এই নিয়ম, সেই নিয়ম। এই নীতি, সেই নীতি। মৌমিতা দেখে ওর মাস্টার্স এর সিলেবাস টাও মনে হয় এর থেকে অনেক কম ও সহজ আছে। আবার কিছু বলতে গেলেই তকমা এঁটে দেয় নাস্তিক। আশ্চর্য টাইপের বিচার তো। 

সব কাজ সেরে সময় মতো ইউনিভার্সিটি তে যাওয়ার জন্য তৈরি হওয়ার সময় শাশুড়ির গলা, “তুমি কেমন ধরণের বৌ বলোতো, বৌ মানে কি জানো, ঘরের লক্ষ্মী। আর তুমি কি করছো, বিয়ে করে সংসার না করে বাইরে টো টো করে ঘুরতে যাচ্ছো।”

পড়ুনঃ- বাস্তবতা নিয়ে একটি গল্প- ন্যায় 

“মা ওটা বাইরে টো টো করে ঘোরা নয়, ওটা ইউনিভার্সিটি তে ক্লাস করতে যাওয়া।” শান্ত গলায় বলে মৌমিতা। 

“শোনো আমাকে বেশি ক্লাস টাস দেখিও না। আমরা যেন আর পড়াশোনা করিনি! ঐ ইউনিভার্সিটি তে গিয়ে পাঁচটা ছেলের সাথে মিশবে সংসারে মন তো বসবেই না, সঙ্গে ঘরের নামটাও আর থাকবে না তোমার জন্য।”

“আচ্ছা আপনার দাবি টা কি একটু পরিষ্কার করে বলবেন শাশুড়ি মা? আপনি কি আমার ইউনিভার্সিটি যাওয়াটা ক্যানসেল করতে চাইছেন?” 

“শোনো অতশত জানি না আমি। একটু ঘরের বৌ ঘরের বৌএর মতো থাকো। পূজো আর্চা তে মন দাও। সবসময় উড়ঞ্চন্ডীপনা কোরো না। নাহলে দিনশেষে ঐ নাস্তিকদের দলে নাম উঠবে তোমার।”

“উঠলেও অসুবিধা নেই কেননা আপনার মতে আস্তিকের সংজ্ঞা যেটা, সেটা কে আস্তিক বলে না। তাই আমি যদি সেগুলো না মানার কারণে নাস্তিক হই, তো আমি এককথায় রাজি আছি।”  

বাংলা ভালো গল্প
বাংলা ভালো গল্প

এরপর আরেকদিন এর ঘটনা। বাড়িতে পূজো আর সারাদিন নির্জলা উপোস। মৌমিতা খেয়াল করে বাড়ির সবচেয়ে ছোট সদস্য অর্থাৎ বড় জা এর মেয়ে পূজার খিদেতে মুখ শুকিয়ে গেছে। ও বারবার ওর মা কে বলছে, “মা খেতে দাও না খিদে পেয়েছে।” আর ওর মা বারবার ওকে চুপ করিয়ে বলছে, “ওরকম করিস না, ঠাম্মা বকা দেবে, বাবাও বকা দেবে। একটু ধৈর্য ধর মা, পূজো শেষ হলেই তো খাবি।”

মৌমিতা ওদের কাছে গিয়ে পূজাকে বলে, “চল তো পূজা, তুই খাবি চল। তোর তো খিদে পেয়েছে বল!”  

“এ কি করছ তুমি মৌমিতা! পূজো শেষ হয়নি মায়ের আর তুমি উপবাসব্রত ভঙ্গ করছ। এত বড় পাপ করছ ! মা শুনলে কত রাগ করবেন জানো!” 

“সব জানি বড়দি কিন্তু তুমি হয়তো এটা জানো না যে নিজের আত্মা কে না খাইয়ে কিছু করা ও তাকে কষ্ট দেওয়া আরো বড় পাপ। চল পূজা।” 

“মৌমিতা বাড়াবাড়ি কোরো না, দাঁড়াও।” 

কিন্তু মৌমিতা শোনে না, পূজা কে নিয়ে চলে যায় ।

পড়ুনঃ- জীবনের চরম বাস্তবতার গল্প 

এরপর যা হবার তাই হলো। শাশুড়ির সে কি ভয়ানক তর্জন গর্জন। ছোটবৌমার এত বড় স্পর্ধা দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছে শাশুড়ি। 

“তুমি কোন সাহসে এটা করতে পারলে বৌমা?” 

“নৈতিকতার সাহসে। একটা বাচ্চা মেয়ে না খেয়ে থেকে কষ্ট পাচ্ছে আর আপনি ভক্তি দেখাচ্ছেন! ঈশ্বর মনের ভক্তি চান। মন শুদ্ধ, পবিত্র হলেও কোনো বাধা বাধা হতে পারে না বুঝেছেন। উপোস করছেন নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে , খিদে পাচ্ছে তবুও জোর করে না খেয়ে আছেন। শুনুন শাশুড়ি মা, দিন বদলেছে, আপনি যদি সত্যযুগের ভক্তির সাথে কলিযুগের ভক্তির তুলনা করে চলতে চান তাহলে ভুল করবেন। তখনকার ব্রাহ্মণদের মুখ দিয়ে কথা বললে আগুন বেরোতো আর এখন মদ, মাংসের গন্ধ বেরোয়। তাই এইসমস্ত কপট ধার্মিকতা আপনার কাছেই রাখুন।”  

ekti-নতুন-বাংলা-গল্প
ekti-নতুন-বাংলা-গল্প
<

“বৌমা, তোমার এত বড় স্পর্ধা!”  

“এটা স্পর্ধা নয় মা, যেটা ভুল সেটা ভুল হিসেবে গ্ৰহণ করতে শিখুন। ধর্মের নামে এই যে এত বেলায় বেলায় স্নান করেন, কাপড় বদলান , সেদিন আমাকে বললেন আমি নাকি অশুচি কাপড়ে এসেছি, তো আপনার লজিকেই বলি, বারবার স্নান ও বারবার কাপড় পরলেই শুদ্ধ হওয়া যায় তাই তো? তাহলে পাশের বাড়ির ওই পাগল ভিখারী কে যখন কেউ নতুন জামা দিতে যায় তখন কেন বলেন ওই গা ঘিনঘিনে নোংরা পাগলটাকে  ছুঁয়ো না। কেন মা, ওকে নতুন কাপড় পরালে ও কি শুদ্ধ হতে পারে না? মনের শুদ্ধতা আনুন মা, ওটা আনতে এত যাকযজ্ঞ দরকার হয় না, এত কাপড়চোপড় বদলাতে হয় না, ঘনঘন গঙ্গাস্নান করতে হয়না ঠিক, মনের শুদ্ধতা তে অনেক খাটনি আছে।

কিন্তু মন একবার শুদ্ধ হয়ে গেলে ঐ যে বললাম কোনো বাধাই আর বাধা নয়। একটা কথা মাথায় রাখবেন, যেখানে যত বেশি আড়ম্বর, প্রকাশ করা সেখানে আসল জিনিস টা ততটাই কম। যেমন প্রকাশ করলে ভালোবাসা কম, আড়ম্বর করলে ভক্তি কম। সকলের সুখে সুখী আর সকলের মুখে দুঃখী যে সেইই তো প্রকৃত ধার্মিক মা। আমি আপনাকে অপমান করে কিছু বলছি না। আপনি আমার গুরুজন, আপনাকে অপমান করার স্পর্ধা আমার নেই। কিন্তু গুরুজন বলেই যে সব ভুল , অন্যায় অন্ধের মতো মেনে নেবো তাও তো নয় তাই না।  

ধর্মের ফাঁকা বুলি আউরিয়ে বা মুখে ধর্ম ধর্ম করলেই ধার্মিক হওয়া যায় না। আসল ধর্ম তো মানবতাতে থাকে। সবচেয়ে বড় ধর্ম মনুষ্যত্ব ধর্ম। যুগে যুগে অবতীর্ণ হওয়া মহাপুরুষগণ বারবার বলে গেছেন, জীব সেবা করো,  মানুষকে ভালোবাসো, প্রেম করো। ভালো রাখো সবাইকে। 

‘নর রূপে নারায়ণ’ -এও তো সেই ধার্মিক ই বলে। তাহলে কাজের বেলায় মানুষের হিত কর্ম না দেখে কেন এসব উপোস, এত আড়ম্বর, এত স্নান, এত বাহ্যিক শুদ্ধতা! 

পড়ুনঃ- কয়েকটি বাছাই করা ছোট গল্প 

গীতায় আছে ধর্মের চেয়ে বড় হলো কর্ম । কর্ম করতে হয় মা, কর্ম। শুধু কর্ম নয়, হিতকর্ম , ভাল কাজ। 

দিনের মধ্যে সাতবার গঙ্গাস্নান করলে আপনার শরীর শুদ্ধ হতে পারে কিন্তু মন নয়। আর পাপ শরীর কে মন করায়। তাই মন কে আগে শুদ্ধ করা দরকার, বিবেক, মানবতাকে স্বচ্ছ করা দরকার। আর আমার মনে হয় যে কর্ম কে বোঝে, সে ধর্ম কেও বোঝে। 

আর এখনকার দিনে ধার্মিক মানে এককথায় আচার বিচার এর আড়ালে মিথ্যাচার। সততা কে দামী করার পরিবর্তে ভন্ডামী কে দামী করা। এখন ধর্মের নামে লোক ঠকানো ব্যবসা চলে চারিদিকে। এই যজ্ঞ, সেই হোম -আদতে অনেক মানুষের মনে ভুল হয় ঢোকানো আর তাদের কষ্টার্জিত উপার্জন কে জলে ভাসিয়ে দেওয়া। 

মা, এগুলো কোনো নাস্তিকতা নয়, নয় কোনো হিংসাত্মক অপপ্রচার। প্রকৃত ধার্মিক তো ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন, ছিলেন রামপ্রসাদ, স্বামী বিবেকানন্দ এনারা। কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে বিরাট আয়োজন করে পূজো দেওয়া কে আস্তিক বলে না। সারাদিন সাতবার স্নান বা সাতবার উপোস করে ভক্ত হওয়া যায় না। একটা ভেবে দেখবেন আমার কথা। যদি আমি বোঝাতে না পারি তাহলে আমার ব্যর্থতা। আর যদি ভুল কিছু বলে থাকি তাহলে ক্ষমা করবেন।”  

মৌমিতা চলে যাচ্ছিল হঠাৎ শাশুড়ি মা তাকে, “বৌমা দাঁড়াও।”  

মৌমিতা পেছন ফিরে তাকায়। 

“তোমার মতো করে আমাকে এতবছর ধরে কেউ বোঝায়নি গো। তুমি ঠিকই বলেছো, আগে মন তারপর শরীর। মন চাইছে না অথচ লোক দেখানোর জন্য আমরা জোর করে শরীরের উপর জুলুম খাটিয়ে এত কিছু করছি। আমাকে সবাই খালি বলত জানো, ঘনঘন পূজো করলেই পুণ্য হবে। কিন্তু কখনো বলত না যে সবাইকে সেবা, সবাইকে ভালোবাসা ও সবার সাথে মিলেমিশে বাঁচার মাধ্যমেই আসলে পুণ্য অর্জন হয়। 

সবাই আমাকে শিখিয়েছিল যে নিজেকে যত বেশী কষ্ট দেবে ততবেশি সংসারে মঙ্গল হবে। কিন্তু আজ বুঝতে পারছি, আত্মার মাঝেই ঈশ্বরের বাস তাই কারোর আত্মা তো নয় ই এমনকি নিজের আত্মাকেও কষ্ট দিয়ে কোনো কাজ করা উচিত নয়। 

bengali beautiful story
bengali beautiful story

তোমার বলায় আমার আজ একটা গল্প মনে পড়ছে, স্বর্গ ও নরক কি? নিজেদের হাতে বাঁধা বড় বড় হাতা দিয়ে যখন নিজেরা খেতে যাচ্ছে খাবার তখন গায়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে একাকার, ফলে কেউই খেতে পারছে না। আর সেটাই হলো নরক। 

কিন্তু যেই নিজেদের হাতে বাঁধা বড় হাতা দিয়ে সবাই একে অপরকে খাইয়ে দেয় তখনই সবাই ঠিক ভাবে খেতে পারে আর এটাই হয় স্বর্গ। 

আমরা শুধু নিজের কথা ভাবি, আমরা সত্যিই ধার্মিক এর নামে বক ধার্মিক। তবে আজ থেকে তোমার জন্য আমরা সবাই প্রকৃত ধার্মিক হওয়ার চেষ্টা করব। তুমি অনেক বড় হও বৌমা, অনেক বড় হও।”  

এরপর বসু পরিবার সত্যি সত্যি বক ধার্মিক থেকে শুধু ধার্মিক হয়ে ওঠে। মানবতা ধর্মের ধার্মিক, মনুষ্য ধার্মিক। 

সুস্মিতা গোস্বামী

গল্পের ক্যানভাসে
গল্প পাঠাতে পারেন- charpatrablog@gmail.com -এ অথবা সরাসরি WhatsApp -এর মাধ্যমে এখানে ক্লিক করে। 
সমস্ত কপিরাইট ছাড়পত্র দ্বারা সংরক্ষিত। গল্পটির ভিডিও  বা অডিও বা অন্য কোনো মাধ্যমে অন্যত্র প্রকাশ আইন বিরুদ্ধ। ছাড়পত্র এর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণে বাধ্য হবে।
পড়ুনঃ- 
প্রেমের গল্প- নষ্ট ভালোবাসা

নিজেকে বদলে ফেলার গল্প 

ভালোবাসার গল্প- পুনর্মিলন 

ছাড়পত্রের সমস্ত আপডেট পাওয়ার জন্য যুক্ত হন- 

ফেসবুক Group - গল্প Junction 

ফেসবুক- ছাড়পত্র

টেলিগ্রাম- charpatraOfficial

WhatsApp Group- ছাড়পত্র (২)

একটি বাংলা ভালো গল্প নতুন বাংলা গল্প bengali beautiful story

Spread the love

Leave a Reply