স্বামীজীর নাম বললে অধিকাংশ মানুষের মনে ভেসে উঠে গেরুয়া বস্ত্র পরিহিত এক সন্ন্যাসীর ছবি। অনেকে আবার স্বামীজীকে বলে থাকেন যে তিনি নাকি শুধু হিন্দুদের পক্ষে মত দেন। কিন্তু সত্যি কি তাই!

স্বামীজী বিদেশ যাওয়ার আগে তাঁর গুরুভাই স্বামী তুরীয়ানন্দ কে বলেছিলেন- “হরিভাই, আমি এখনো তোমাদের তথাকথিত ধর্মের কিছুই বুঝি না। কিন্তু আমার হৃদয় খুব বেড়ে গেছে এবং আমি অপরের ব্যথায় ব্যথা অনুভব করতে শিখেছি। বিশ্বাস করো, আমার তীব্র দুঃখবোধ জেগেছে।“

এই কথা যে স্বামীজী বলতে পারেন, কীভাবে তাকে শুধু ধর্মের দিক থেকে বিচার করবেন!

স্বামীজীর মত মহান আদর্শকে নিয়ে আলোচনা করা আমার মত ক্ষুদ্র মানুষের কুক্ষিগত নয়। আমি স্বামীজীর জীবনের কিছু ঘটনা আপনাদের সামনে তুলে ধরছি, বুঝে যাবেন স্বামীজী কেন জগতের স্বামীজী

স্বামীজীর জীবনের গল্পঃ- ১

রাজস্থানের এক রেলস্টেশনে আছেন স্বামীজী। সারাদিন তাঁর কাছে লোক আসছে। নানা প্রশ্ন তাদের। স্বামীজী সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন। লোক আসার শেষ নেই, স্বামীজীরও ধর্মপ্রসঙ্গের বিরাম নেই। এত লোক আসছে কেউ কিন্তু একবারও খোঁজ করছে না স্বামীজীর খাওয়া হয়েছে কিনা। এইভাবে পর পর তিনদিন সম্পূর্ণ অনাহারে থেকে স্বামীজী ধর্ম- প্রসঙ্গ করে চলেছেন। জল পর্যন্ত খেতে পারেননি। তৃতীয়দিন রাত্রে সবাই চলে যাবার পর একটি গরিব লোক এসে তাঁকে জিজ্ঞাসা করল, ‘মহারাজ, আপনি তিনদিন তো অনবরত কথাই বলেছেন, জল পর্যন্ত খাননি। এতে আমার প্রাণে বড় ব্যথা লেগেছে।’

স্বামীজীর মনে হল স্বয়ং ভগবানই দীনবেশে এসেছেন। তিনি বললেন: ‘তুমি আমায় কিছু খেতে দেবে?’ লোকটি জাতিতে চামার, সে বলল- ‘আমার প্রাণ তো তাই চায়; কিন্তু আমার তৈরি রুটি আপনাকে দেব কী করে? আজ্ঞা হয় তো আমি আটা ডাল এনে দিই, আপনি ডাল-রুটি বানিয়ে নিন।’

স্বামীজীর-জীবনের-গল্প
স্বামীজীর-জীবনের-গল্প

স্বামীজী বললেন- ‘না, তোমার তৈরি রুটিই আমায় দাও; আমি তাই খাব।’ লোকটি শুনে ভয় পেল রাজা যদি জানতে পারে যে সে চামার হয়েও সন্ন্যাসীকে রুটি তৈরি করে দিয়েছে তবে হয়তো তাকে শাস্তি পেতে হবে। তবুও সাধুসেবার প্রবল আগ্রহে নিজের বিপদ তুচ্ছ করেও স্বামীজীর জন্য রুটি তৈরি করে নিয়ে এল। তার দয়া দেখে স্বামীজীর চোখে জল এল, ভাবলেন, আমাদের দেশের কুঁড়েঘরে এরকম কত মানুষ বাস করে, যারা বাইরে দীন-দরিদ্র- অন্ত্যজ, কিন্তু অন্তরে মহান।

এদিকে স্টেশনের কয়েকজন ভদ্রলোকের নজরে পড়ল স্বামীজী চামারের হাত থেকে খাবার নিয়ে খাচ্ছেন। তারা এসে তাঁকে বলল ‘আপনি যে নীচ ব্যক্তির ছোঁয়া খাবার খেলেন এটা কি ভাল হল?’ স্বামীজী উত্তর দিলেন ‘তোমরা তো এতগুলো লোক আমাকে তিনদিন ধরে বকালে, কিন্তু আমি কিছু খেলাম কিনা তার কি খোঁজ নিয়েছিলে? অথচ এ ছোটলোক হল, আর নিজেরা ভদ্র বলে বড়াই করছ? ও যে মনুষ্যত্ব দেখিয়েছে, তাতে ও নীচ হল কি করে?’

স্বামী বিবেকানন্দের গল্পঃ- ২

একবার ট্রেনে যেতে যেতে স্বামীজী দেখলেন, একজন মুসলমান ফেরিওয়ালা ছোলাসিদ্ধ বিক্রি করছে। সঙ্গের ব্রহ্মচারীকে স্বামীজী বললেন- ‘ছোলাসিদ্ধ খেলে বেশ হয়; বেশ স্বাস্থ্যকর জিনিস।’ ব্রহ্মচারী এক পয়সার ছোলা কিনলেন, কিন্তু ফেরিওয়ালাকে দাম হিসেবে দিলেন চার আনা। কারণ, স্বামীজীর স্বভাবের সঙ্গে তিনি পরিচিত ছিলেন।

তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ছোলা কেনার ছলে স্বামীজী আসলে ফেরিওয়ালাকে সাহায্য করতে চান। স্বামীজী জিজ্ঞাসা করলেন- ‘কিরে, কত দিলি?’ ‘চার আনা।’ স্বামীজী বললেন- ‘ওরে, ওতে ওর কি হবে? দে, একটা টাকা দিয়ে দে। ঘরে ওর বউ আছে, ছেলেপিলে আছে।’ তাই করা হল।

পড়ুনঃ- রহস্য রোমাঞ্চে ভরপুর গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন। 

স্বামীজীর জীবনের গল্পঃ- ৩

 স্বদেশে ফেরবার পথে স্বামীজী ইজিপ্ট হয়ে যাচ্ছেন। কায়রোতে এসেছেন, সঙ্গে আছেন কয়েকজন বিদেশী শিষ্য-শিষ্যা। কায়রোর রাজপথে সঙ্গীদের নিয়ে চলতে চলতে স্বামীজী একদিন ভুল করে সেই জায়গায় চলে এসেছেন যেখানে পতিতা রমণীরা থাকে। সঙ্গীরা যখন বুঝতে পারলেন, তৎক্ষণাৎ স্বামীজীকে নিয়ে সেখান থেকে চলে যেতে চাইলেন। কিন্তু স্বামীজী ততক্ষণে তাঁদের ছেড়ে এগিয়ে গেছেন রাস্তার পাশে বসে থাকা কয়েকটি রমণীর দিকে।

তিনি তাদের দিকে তাকিয়ে আপনমনে বলতে লাগলেন- ‘আহা বাছারা। আহা অভাগিনীরা। ওরা ওদের সৌন্দর্যের পায়ে নিজেদের দেবীত্বকে বলি দিয়েছে।’ তাঁর চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। ঐ রমণীরা এর আগে হাসতে হাসতে চপল ভঙ্গিতে তাঁকে ডাকছিল। এখন তারাই লজ্জায় মাথা নিচু করল। একজন তাঁর বসনপ্রান্ত চুম্বন করে বলতে লাগল- ইনি ঈশ্বরকে জেনেছেন, ইনি ভগবানের লোক। আর একজন দুহাতে নিজের মুখ ঢেকে স্বামীজীর পবিত্র চোখদুটির দৃষ্টি থেকে নিজেকে আড়াল করতে চেষ্টা করল। 

স্বামী বিবেকানন্দের গল্পঃ-৪

স্বামীজী দ্বিতীয় এবং শেষ বারের মতো পাশ্চাত্যে এসেছেন। আমেরিকায় একদিন তিনি একটা নদীর ধারে বেড়াচ্ছেন। হঠাৎ চোখে পড়ল, কয়েকটি যুবক সাঁকোর উপরে দাঁড়িয়ে জলে ভেসে-থাকা কয়েকটা ডিমের খোলার দিকে গুলি ছুঁড়ছে। বারবার চেষ্টা করছে-কিন্তু একবারও পারছে না। দাঁড়িয়ে দেখতে দেখতে স্বামীজীর মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠল।

স্বামী বিবেকানন্দের মজার ঘটনা

যুবকদের একজনের তা চোখে পড়ল। স্বামীজীকে চ্যালেঞ্জ করে সে বলল: কাজটা যতটা সহজ দেখাচ্ছে ততটা সহজ নয়। দেখি তো আপনি কেমন পারেন! স্বামীজী দ্বিরুক্তি না করে তাদের কাছ থেকে একটা বন্দুক নিলেন, তারপর পরপর বারোটি খোলা গুলিবিদ্ধ করলেন। যুবকরা অবাক হয়ে গেল। তারা ভাবল, ইনি নিশ্চয়ই বহুদিন ধরে বন্দুক ছুঁড়েছেন।

স্বামীজী তাদের বললেন তিনি এর আগে কখনোই বন্দুকে হাত দেননি। তিনি যে লক্ষ্যভেদ করতে পারলেন তার রহস্য হচ্ছে মনঃসংযম। 

পড়ুনঃ- স্বামী বিবেকানন্দের বাণী- যেগুলি জীবন বদলাবে 

স্বামী বিবেকানন্দের গল্পঃ-৫

স্বামীজীর ইচ্ছা, অতীতে বুদ্ধের অনুগামীরা যেমন বুদ্ধের বাণী দূর- দূরান্তরে ছড়িয়ে দিয়েছিল, শ্রীরামকৃষ্ণের অনুগামীরাও তেমনই শ্রীরামকৃষ্ণের বাণী পৃথিবীর যে-কোনও প্রান্তে বহন করে নিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত থাকবে। এই ব্রতের সূচনা হিসেবে স্বামীজী তাঁর দুজন সন্ন্যাসী-শিষ্যকে পূর্ববঙ্গে প্রচারে পাঠাতে চাইলেন।

স্বামীজীর আদেশ শুনে দুজনের মধ্যে একজন বললেন ‘স্বামীজী, আমি কী প্রচার করব? আমি তো কিছুই জানি না।’ স্বামীজী বললেন ‘তবে যা, তাই বলগে, ওটাও তো একটা মস্ত বড় কথা।’ শিষ্যের তবুও আপত্তি। তিনি তপস্যার অনুমতি চান। কাজে নামবার আগে তিনি সাধন-ভজন করে সিদ্ধিলাভ করতে চান।

শিষ্যের ইচ্ছের কথা শুনে স্বামীজী গর্জে উঠলেন, বললেন তুই যদি নিজের মুক্তির জন্য সাধনা করতে চাস তো তুই জাহান্নমে যাবি। পরমার্থ লাভ করতে হলে পরের মুক্তির জন্য চেষ্টা কর, নিজের মুক্তির ইচ্ছা জলাঞ্জলি দে। ঐ হল সর্বশ্রেষ্ঠ সাধনা।

তারপরে একটু নরম হয়ে বললেন বাবারা, কাজে লেগে যা, মনপ্রাণ দিয়ে কাজে লেগে যা! ঐ হচ্ছে কাজের কথা ফলের দিকে দৃষ্টি দিবি না। যদি অপরের কল্যাণ করতে গিয়ে নরকে যেতে হয়, তাতেই বা ক্ষতি কী? স্বার্থপরতা নিয়ে নিজের স্বর্গলাভ করার চেয়ে তা ঢের ভাল।

পড়ুনঃ- স্বামীজীর জীবনের কিছু শিক্ষণীয় ঘটনা 

স্বামীজীর জীবনের গল্পঃ-৬

স্বামীজী যখন একান্তে থাকতেন তখন অনেক সময় মানুষের দুঃখ- দুর্দশার কথা ভেবে অশ্রুবিসর্জন করতেন। তাঁর বিদেশ থেকে ফিরে আসবার পরের ঘটনা। বলরাম বসুর বাড়িতে স্বামীজীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন স্বামী তুরীয়ানন্দ। তুরীয়ানন্দ দেখলেন-গভীর চিন্তামগ্ন হয়ে স্বামীজী বারান্দায় পায়চারি করছেন। তিনি যে এসেছেন, স্বামীজী তা টেরই পেলেন না।

একটু পরে স্বামীজী চোখের জলে ভাসতে ভাসতে মীরাবাঈ-এর একটা বিখ্যাত গান গুনগুন করে গাইতে লাগলেন। নিজের হাত দুখানিতে মুখ লুকিয়ে রেলিঙে ভর দিয়ে বিষাদভরে গাইছেন- ‘দরদ না জানে কোঈ ঘায়ল কী খত ঘায়ল জানে আওর না জানে কোঈ (আমার ব্যথা কেউ জানে না। যে আঘাত পেয়েছে সে-ই বোঝে তার কী যন্ত্রণা, আর কেউ বোঝে না।’

গানের সুরের সঙ্গে সঙ্গে দুঃখ ও বিষাদ যেন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। তুরীয়ানন্দ বুঝতে পারলেন-জগতের মানুষের দুঃখের কথা ভেবে স্বামীজী নিভৃতে অশ্রুবিসর্জন করছেন। তিনিও চোখের জল সংবরণ করতে পারলেন না।

বিবেকানন্দের গল্প
<

এরকম অগণিত ঘটনা ঘটেছে স্বামীজীর জীবনে। যেগুলোকে ধর্মের আড়াল দিয়ে বাকিদের থেকে স্বামীজীর আদর্শকে ভুল ভাবে ব্যাখ্যা করছেন কিছু মানুষ।

সাধেই কি বলা হয় ভারতকে জানার আগে স্বামীজীকে জানো, কেননা স্বামীজীর মধ্যেই তো গোটা ভারতের অবস্থান।

স্বামীজির ধর্ম বলা নিয়ে একটি কথা বলে এই লেখাটি শেষ করব। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন- “আমি সেই ধর্মে বিশ্বাস করিনা যে ধর্ম বিধবার চোখের অশ্রু মোছাতে পারে না, পারে না ক্ষুধার্তের মুখে অন্ন তুলে দিতে। যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ কি একটা কুকুরও অভুক্ত থাকবে, ততক্ষণ আমার ধর্ম হবে তাকে খাওয়ান। জীবন্ত দেবতা মানুষের রূপ ধরে তোমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে, তাঁর সেবাই তোমার ধর্ম।‘’ এবার বলুন কোন দেশের কোন ধর্মগুরুর মুখে আপনি এরকম কথা শুনেছেন!

অথচ আমাদের মত কিছু ধর্মভীরু মানুষ স্বামীজীর চরিত্রকে আলাদাভাবে ব্যাখ্যা করে সমাজ দূষিত করছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ধর্মের শিক্ষায় নয়, পরিচালিত হোক স্বামীজির মত মহান আদর্শের শিক্ষায়।

।। জয় স্বামীজী ।।

গল্প পাঠাতে পারেন- charpatrablog@gmail.com -এ অথবা সরাসরি WhatsApp -এর মাধ্যমে এখানে ক্লিক করে।


নিচে দেওয়া wp গ্রুপ টি শুধু মাত্র অ্যাক্টিভ মেম্বারদের জন্য। যাদের মনে হবে ব্যস্ত জীবনের অল্প সময় ও এখানে ব্যয় করতে পারবেন আড্ডা আলোচনার মধ্যে তাদের জন্য।   বি.দ্র. - ইউটিউবার দাদা দিদিরা যারা কনটেন্ট খুঁজতে গ্রুপ এ আসেন তারা এখানে ভিড় জমাবেন না অহেতুক নিজেদের ক্ষতিসাধনে। 

WHATSAPP GROUP LINK- ছাড়পত্রিয়ানস (CHARPATRIANS)  👈🏻 ক্লিক করুন

সমস্ত কপিরাইট ছাড়পত্র দ্বারা সংরক্ষিত। লেখাটির ভিডিও বা অডিও বা অন্য কোনো মাধ্যমে অন্যত্র প্রকাশ আইন বিরুদ্ধ। ছাড়পত্র এর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণে বাধ্য হবে।

পড়ুনঃ-  
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাণী 

জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে গৌতম বুদ্ধের কিছু বাণী 
আমাদের সাথে যুক্ত হবেন যেভাবে- 

ফেসবুক Group - গল্প Junction 

ফেসবুক- ছাড়পত্র

টেলিগ্রাম- charpatraOfficial

স্বামীজীর জীবনের গল্প। স্বামী বিবেকানন্দের মজার ঘটনা। স্বামী বিবেকানন্দের গল্প।

Spread the love

Leave a Reply