আজকের এই জীবনের গল্পটি একজন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলের। টাকার অভাব এবং পারিবারিক চাপের কাছে কিভাবে একজন মধ্যবিত্তের জীবনের তরী ডুবে যায়, তাইই তুলে ধরা হয়েছে এই গল্পটির মাধ্যমে। একজন মধ্যবিত্তের কষ্ট রইল আজকের এই গল্পে।
জীবনের গল্প। মধ্যবিত্তের অসমাপ্ত জীবন কাহিনীঃ-
ছেলেটার নাম কৌশিক। বাবা একজন ব্যবসায়ী। না অনেক বড় ব্যবসায়ী নন, একজন মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ী। কোনোক্রমে মা-বাবা-কৌশিকের তিন সদস্যের পরিবারের বেশ ভালোই চলে। কৌশিক স্নাতক ডিগ্রী শেষে এবার একটি প্রফেশনাল কোর্সে ভর্তি হয়েছে। যদিও তার ইচ্ছে ছিল অন্য কিছু পড়ার কিন্তু, বাবার কথার কাছে তার কথা বিন্দু মাত্র দাম পায়নি। বাবার ইচ্ছে ছেলে একজন শিক্ষক হবে। এদিকে কৌশিক চায় একজন দক্ষ VFX artist হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে।
কৌশিকের ইচ্ছে ছিল তাড়াতাড়ি কিছু একটা করার, কারণ তারা মধ্যবিত্ত। বাড়ি থেকে আর কতদিন ছেলের খরচ চালাবে। এখন স্নাতক পাশ করার পড়ে কৌশিকের বাবার কাছে হাত পাততেও লজ্জা লাগে। কারণ বয়স প্রায় ২২, এখনও বাবার ভরসায় চলতে হয়, সেই ছোট্ট থেকে বাবার কাঁধের উপর ভরসা করে চলেছে সে। আর কত দিন এভাবে চলবে সে! কোথাও ঘুরতে যাওয়ার টাঁকা থেকে শুরু করে, মোবাইলের টাঁকা, সবকিছুর জন্যই হাত পাততে হয়।
তাছাড়া তার বাবার অত্যধিক রাগ, তাকে বেশি চিন্তায় ফেলে দেয়। প্রায় কিছুদিন পড় পড় তার বাবা-মায়ের মধ্যে ঝগড়া তাকে বেশি দুঃখ দেয়। সে মধ্যস্ততা করার চেষ্টা করলেও কোনো লাভ হয়না। কারণ তার বাবা তাকেও অনেক অনেক মানসিক কষ্ট দেয়। তার মা প্রায়ই রাতে চোখের জল নিয়ে বিছনায় যায়। কৌশিকের মায়ের অনেক রাত কাটে, বিছানায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে।
কি আর করবে কৌশিক কিছুই যে তার করার নেই, সে বাইরে কাজের জন্য যেতে চাইলেও বাড়ি থেকে তার বাবা যেতে দিবেন না, আবার কৌশিক ও তার মা কোনো ইনকাম করে না দেখে, তার বাবা আরও বেশি পরিমাণে চড়াও হয় তাদের উপর। মাঝে মাঝে এই সব দৃশ্য দেখে কৌশিক ভাবে সে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাবে, অচেনা অজানা কোনো এক জায়গায় যেখানে পরিচিত কেউই থাকবে না। কিন্তু তার মায়ের কথা ভেবে সে আর যেতে পাড়ে না। কারণ তার মা অসুস্থ, তারপর আবার সে চলে গেলে, তার বাবা তার মায়ের উপর অত্যাচার বাড়িয়ে দিবে।
বয়স ২২ হলে কি হবে, কৌশিকও অনেক রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাঁদে। সে কিছুতেই বুঝতে পাড়ে না, সে কি করবে, কোথায় যাবে, কিভাবে সমস্যার সমাধান করবে। একদিনের ঘটনা- কৌশিক সবে বাড়ি ফিরেছে। খাবার দিতে একটু দেড়ি হয়েছে বলে তার বাবা মাকে প্রচণ্ড পরিমাণে বকা দিচ্ছে, কৌশিককে দেখে যেন তার বাবা রুদ্র মূর্তি ধারণ করল। কৌশিককে দেখার মাত্রই তার বাবা ভাতের থালা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নানান অকথ্য কথায় তার মাকে গালি-গালাজ করতে লাগল।
ছিঃ এসব কথা শোনাও পাপ, বলে কৌশিক বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গিয়েছিল। প্রায় সন্ধ্যে নাগাদ কৌশিক ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বাড়িতে আসে, সারাদিন নাওয়া-খাওয়া নেই, টই টই করে ঘুরে কাটিয়ে দিয়েছে সে। বাড়ি ফিরতেই সে আরেক ঝামেলা বাড়ি ফেরা মাত্রই তার দজ্জাল বাপ প্রশ্ন করা শুরু করে দেয় তাকে-
এতক্ষণ কোন মেয়ের বাড়িতে সময় কাঁটালি?
আরও পড়ুন—
কৌশিক জানায় তার কোনো মেয়ে বন্ধু নেই, কিন্তু কিছুতেই তার বাবা বিশ্বাস করে না। তার বাবা আবার শুরু করে দেয় প্রচণ্ড আজে-বাজে কথা। কৌশিক চুপচাপ নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। মায়ের ডাকেও সে সাড়া দেয়নি। বিছানায় কাঁদতে কাঁদতে কখন যে সে ঘুমিয়ে পড়েছে সে নিজেও জানে না, সকালে পাখির ডাকে তার ঘুম ভাঙ্গে।
এরপর প্রায় দিন পনেরো বেশ ঠিকঠাক চলল। আবার পনেরো দিন পড় অশান্তি শুরু। ইউনিভার্সিটিতে এক কাজে সে যায়, বাড়ি ফিরে আবার ঝামেলা। তার বাবাকে দেখেই তার মনে হল, আজ কিছু একটা হতে চলেছে। বাড়ি ফেরা মাত্রই তার বাবা বলল, আমার পকেট থেকে দশ টাঁকা নেই, তুই নিয়েছিস কেন? ব্যাস শুরু হয়ে গেল। আর তার বাবা একবার বকা দেওয়া শুরু করলে, কবে কোথায় কি ভুল কৌশিক করেছিল, সব টেনে আনবেই আনবে। আর এরপর কথায় কথায় তার মাকেও টেনে নিয়ে এসে অনেক কথা শোনায়।
না আর সহ্য হচ্ছে না, কৌশিকের। তার জন্য শুধুমাত্র তার জন্যই তার মা, বাবার কাছে বকা খায়। সে তার বাবাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। পরের দিন সকালে, বেলা প্রায় ৯ টা গড়িয়ে গেছে। কিন্তু কৌশিক কিছুতেই বিছানা ছেড়ে উঠছে না। এদিকে কৌশিকের উঠতে দেড়ি হচ্ছে দেখে তার রাগী বাবা আবার অকথ্য কথা শুরু করে। তার মা বারং বার ডাকলেও কোনো সাড়া আসে না। এদিকে কৌশিকের মোবাইল বেজেই যাচ্ছে, কে যেন ফোন করেছে। কিন্তু কৌশিক কিছুতেই ফোন তুলছে না।
এরপরেই তার মায়ের মনে কেমন যেন খটকা লাগে। কিন্তু তার বাবা বকছে তো বকছেই- “এই ছেলের কোনো দিন উন্নতি হবে না, এর ভবিষ্যৎ একদম অন্ধকার। জীবনে কোনো দিন উন্নতি করতে পাড়বে না, এই ছেলে। মায়ের জন্যই ছেলেটা আজ বিগড়ে গেল। আমার হাঁতে থাকলে ছেলেকে মানুষের মত মানুষ করতাম, ছিঃ কেমন ছেলে জন্ম দিয়েছি, অমুকের ছেলেকে দেখ, তমুকের ছেলেকে দেখ ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু যা হওয়ার তা ইতিমধ্যে হয়েই গেছে।
আম গাছে জোড়ে জোড়ে কা কা করে ডাকতে থাকা কাক টাও একসময় থেমে যায়। বাবা তার কাজে চলে যায়। এদিকে মায়ের রান্নার কাজ শেষ, কিন্তু কৌশিক কিছুতেই এখনও উঠছে না। বেলা প্রায় ১১ টা কৌশিকের ঘড় থেকে কোনো সাড়া শব্দ নেই। বাড়িতে ফিরে বাবা দেখেন কৌশিক এখনও উঠে নি। আবার মেজাজটা বিগড়ে গেল। রেগে-মেগে সজোরে কৌশিকের দরজায় জোড়ে একটা লাথি মারলেন। কৌশিকের রুমের ঘুণে ধরা দরজাটা শব্দ করে পড়ে গেল।
দরজা খুলতেই বাবার নজরে এল, কৌশিক দিব্যিসে ঘুমোচ্ছে। হুম একদম দিব্যি সে। কারও সাধ্য নেই তাকে এই ঘুম থেকে জাগায়। এমনকি কৌশিকের রাগী বাবারও নয়। এই ঘুম চিরশান্তির ঘুম। কৌশিকের মুখে একটা চরম তৃপ্তির হাঁসি। অনেক অনেক কষ্ট থেকে যেন রেহাই পেয়েছে সে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে যথারীতি পুলিশ আসে। পুলিশ তার কাজ করে চলে যায়। উদ্ধার হয় একটি সুইসাইড নোট। তাতে লেখা আছে-
“ আমি জানি আমি যা করেছি, তা অনেক পাপ। উপরন্তু আমাদের ভদ্র সমাজ তাই মনে করবে। আমরা অনেক সময় আমাদের জীবনটাকে নদীর সাথে তুলনা করি। নদীর বাঁধ যেমন একটা নির্দিষ্ট ক্ষমতা পর্যন্ত জল ধরে রাখতে পাড়ে ঠিক তেমনি, একটা মানুষের কষ্ট ধারণ করার ক্ষমতা সীমিত। আমি সবে মাত্র নতুন দিগন্তের উদ্দেশ্যে পা বাড়াব, ঠিক মতো পৃথিবীটাকে চেনাই হল না, আর তার মাঝেই বাবার পরিমার্জিত কথায় আমার ঘুম ছুটেছে। আপনারা সবাই বাবাকে ভালো মানুষ হিসেবেই চেনেন।
কিন্তু বাঁশের বাইরেটা যতই শক্ত হোক না কেন, ভেতরটা যেমন ফাঁকা ঠিক তেমনিই মধ্যবিত্তের জীবনটা। বাইরে থেকে চাকচিক্য মনে হলেও ভিতরে কিছুই নেই। আসলে মধ্যবিত্তরা মানুষকে দেখাতে বেশি ভালোবাসে। সমাজের কাছে আমার বয়স অনেক। কিছু একটা করতে গেলেও, সম্মান থাকবেনা বলে বাড়ি থেকে অন্য কাজে যেতে দেয় না। আবার মা অসুস্থ। মাঝে মাঝে আমার মাকে দেখে অবাক হই। কিভাবে মা এত কিছু সহ্য করেন জানিনা। কিন্তু আমার সহ্য শক্তি হয়ত মায়ের থেকে অনেক কম।
ইচ্ছে ছিল, কম্পিউটার নিয়ে এগোনোর কিন্তু, বাবার ইচ্ছে প্রফেশনাল কোর্স। নিজের ইচ্ছে আবদ্ধ রেখেই আবার এক নতুন পথে চলা শুরু করলাম। কিন্তু যতই আমার বয়স বাড়ছে ততই বাবার কথাটাও বেশি শুনতে হচ্ছে। মাঝে মাঝে এমন কথা তিনি শোনান, আমি বাড়ি ছেড়ে দিদির বাড়িতে যেতে বাধ্য হই।
জীবনটাকে নিজের মত করে সাঁজাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু জীবন যে হাত দিয়ে সাজাবো সেই হাতই যে আমার বাঁধা। মা, তুমিও আমার জন্য অনেক কথা শুনেছ, আর তোমাকে কথা শুনতে হবে না। আমি চলে যাচ্ছি ঠিকই কিন্তু আমি সবসময় তোমার পাশে থাকব। নিজের স্বাস্থ্যের খেয়াল রেখো মা। তোমাকে ছেড়ে যেতে মন চাইছে না, কিন্তু কি আর করব বল- বয়স অনেক হয়ে গেলেও তোমাদের জন্য কিছু করতে পাড়লাম না অন্তত তোমাদের শান্তিটা তো দিয়ে যাই। ভালো থেকো।“
এই বলেই চিঠিটা শেষ হয়।
এই হল এক মধ্যবিত্তের জীবন কথা। বাইরে বেরোলে লজ্জায় নাক কাটা যাবে, আবার সঙ্গে সঙ্গে ইনকামও লাগবে। যেখানে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় সেখানে গরম ভাতের সাথে কচু সেদ্ধ বিলাসিতা মাত্র। জীবন যেমন নিজের তেমনই নিজের মত করে বাঁচতে দেওয়াটাও অনেকটা গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের টেলিগ্রামে আড্ডা দেওয়ার গ্রুপ :- https://t.me/charpatraOfficial
সমস্যা নিয়েই মানুষের জীবন। কিন্তু সেই সমস্যায় নিজের জীবন থেকে ইতি টানা মানেই সমস্যার সমাধান নয়, বরং আপনি জীবন যুদ্ধের একজন পরাজিত যোদ্ধা। তাই কোনো খারাপ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একবার নদীর সামনে গিয়ে দাঁড়ান, নদীর জল সব সময় সমান থাকে না। যে নদীর উপর দিয়ে গ্রীষ্ম কালে হেঁটে পাড় হওয়া যায়, বর্ষা কালে সেই নদীর ধারে যেতেও আমরা ভয় পাই। তাই সবসময় মানুষ আপনাকে দমিয়ে রাখবে এমনটা হতে পারেনা। কিন্তু বিচার-বিবেচনা না করেই ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে নেওয়াটা অনেক বড় অপরাধ।
নতুন গল্প। জীবনের গল্প। মধ্যবিত্তের জীবনের গল্প। new bengali story
কি কেন কীভাবের উপর গড়ে ওঠা মানুষের জিজ্ঞাসু মন সর্বদাই নতুন দিগন্তের সন্ধানে পা বাড়ায় ৷ প্রতিটি পদক্ষেপেই নতুন কিছু অভিজ্ঞতা আমাদের ঝুলিতে জমা হয় ৷ সেই অভিজ্ঞতা সকলের সাথে ভাগ করে নেওয়ার মধ্যে এক অফুরন্ত আনন্দ লুকিয়ে থাকে ৷ আর সেই কাজেই হাত বাড়িয়েছে ছাড়পত্রের টিম।
ধন্যবাদ।।