আজ আবার একটি নতুন রূপকথার গল্প নিয়ে আমরা হাজির। রূপকথার সেই কল্প কাহিনী কে না পছন্দ করে! আর সেই কথা মাথায় রেখেই আজকের এই সেরা রূপকথার গল্পটি নিয়ে আসা। BANGLA RUPKOTHAR GOLPO.

নতুন রূপকথার গল্প। রাজপুত্রের গল্প।

রাজ্যের নাম কমলপুর। রাজা প্রজা কারও মনে শান্তি নেই। কারণ একটাই, রাজ্যে রাক্ষসীর অত্যাচার। সৈন্য পাঠিয়েও রাজা রাক্ষসীকে ধরতে পারলেন না। রাক্ষসী যে মায়াবিনী! বিভিন্ন রূপ ধরতে পারে। প্রজারা রোজই এসে রাজার কাছে অভিযোগ জানায়— “মহারাজ, রাজ্যের রাক্ষসীর অত্যাচার বেড়েই চলেছে।“ রাক্ষসী রোজই এক একজনকে ধরে নিয়ে খেয়ে ফেলেছে। রাজা যদি রাক্ষসীর এ অত্যাচার বন্ধ করতে না পারেন তবে তিনি কিসের রাজা?

রাজা মহাচিন্তায় পড়ে গেলেন। পাত্র-মিত্র, মন্ত্রী ইত্যাদির সঙ্গে পরামর্শ করলেন। কি করা যায়? রাক্ষসীকে শেষ না করতে পারলে প্রজারা রাজ্য ছেড়ে চলে যেতে পারে। রাজা, মন্ত্রীগণ, সেনাপতি সবাই চিন্তায় আকুল হয়ে পড়লেন। শেষে মন্ত্রী বললেন, রাজকুমারকে ডেকে পাঠানো হোক।

রাজা মন্ত্রীর প্রস্তাব মেনে নিলেন। রাজকুমারকে গুরুগৃহ থেকে ডেকে পাঠালেন। রাজকুমার, মন্ত্রীপুত্র  আর কোটালপুত্র, তিন বন্ধু মিলে ঘোড়া ছুটিয়ে রাজ্যে ছুটে এলেন। রাজকুমার এসেই রাজাকে জিজ্ঞেস করলেন— “আপনি এত শীঘ্র আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন কেন? আমার শিক্ষা এখনও সমাপ্ত হয়নি।“

নতুন রূপকথার গল্প রাজপুত্রের গল্প
নতুন রূপকথার গল্প রাজপুত্রের গল্প image

রাজা বললেন— “কি আর করব রাজকুমার! রাজ্যে সাংঘাতিক রাক্ষসীর অত্যাচার। প্রজারা অতিষ্ঠ হয়েছে। সৈন্য-সামন্ত দিয়ে রাক্ষসীকে কিছুতেই মারা সম্ভব হচ্ছে না। রাক্ষসী মায়াবিনী, নানা সময় নানারূপ ধরে। দেখো, তুমি যদি কিছু করতে পারো। তা না হলে আমাদের এই রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে যেতে হবে।“  রাজকুমার অনেক ভেবেচিন্তে বললেন  ঠিক আছে, আমাকে অন্ততঃ একমাসের সময় দিন, তার মধ্যে যে করেই হোক রাক্ষসীকে মেরে ফেলব।

রাজপুত্র বীর হতে পারেন, কিন্তু মায়াবিনী রাক্ষসীর সঙ্গে পারবেন কি করে? রাতের বেলা হানা দিয়ে রাক্ষসী সামনে যা পায়, খেয়েদেয়ে চলে যায়। রাজ্যের হাহাকার পড়ে গেলো। সন্ধ্যে না হতেই রাজপথে লোক চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, কেউ ভয়ে রাজপথে বেরোয় না। প্রজারা রাক্ষসীর অত্যাচারে অতিষ্ট হয়েও বাজ্যে রয়ে গেছে, কারণ রাজকুমারের ওপর তাদের অগাধ বিশ্বাস। উনি যখন কথা দিয়েছেন, এক মাসের মধ্যে নিশ্চয়ই রাক্ষসীকে মেরে ফেলবেন। অতএব একমাস অপেক্ষা করেই দেখা যাক।

এদিকে রাজকুমার মহামুস্কিলে পড়েছেন—রাক্ষসীটা যে কখন আসে, কখন যায় কিছুই টের পান না। শুধু পরদিন অত্যাচারের খবর পান। কারো গরু নেই— হাড় পড়ে আছে। দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে কারো কচি ছেলেকে খেয়ে চলে গেছে। অথচ রাজবাড়ীতে কোন অত্যাচার এ পর্যন্ত হয়নি, ওখানে সব সময়ই যে পাহারাদার ঘুরে বেড়ায়। রাজবাড়ী সুরক্ষিতও বটে। বাইরে থেকে একটা মশামাছিরও ঢোকার উপায় নেই। রাজার গো-শালে হাজার গরু ঘোড়াশালে হাজার ঘোড়া। হাতী-শালে হাজার হাতী।

অনেক যুক্তি করে রাজপুত্র, কোটালপুত্র ও মন্ত্রীপুত্র ঠিক করলেন ওরাই নগর পাহারা দেবেন। রাজ্যের ঢোকার তিনটি সদর দরজা। এক দরজায় রইলেন রাজপুত্র। আর এক দরজায় রইলেন কোটালপুত্র। আর এক দরজায় রইলেন মন্ত্রীপুত্র। তিন দরজায় তিন বন্ধু উন্মুক্ত খড়্গ হাতে দাঁড়িয়ে রইলেন। সন্ধ্যের ঠিক কিছু পর রাজপুত্রের কাছে এক বুড়ী এলো। মাথায় কাঠের বোঝা। রাজপুত্র গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলেন— “তুমি কে?”

বুড়ী বলল, আমি কাঠ-কুড়ুনী বুড়ী। কাঠ কুড়িয়ে সেই কাঠ বেচে খাই। আমি বড় গরীব। আমার সংসারে কেউ নেই। কাঠ কুড়ুতে কুড়ুতে রাত হয়ে গেছে। আমায় রাজ্যে ঢুকতে দাও। নইলে বাইরে যা ঠাণ্ডা জমে মরে যাবো। তাছাড়া বাঘ-সিংহী আছে, রাতে বাইরে থাকলে বাঘ-সিংহী খেয়ে ফেলবে। বুড়ীর কথা শুনে রাজপুত্রের মনে দয়া হলো, রাজপুত্র সদর দরজা দিয়ে বুড়ীকে রাজ্যে ঢুকতে দিলেন।

আবার সকালে সেই মর্মবিদারক সংবাদ। দুটো কচি ছেলেকে খেয়ে রাক্ষসী মাথা দুটো আবার সেই বাড়ীর দরজাতেই রেখে গেছে। প্রজারা ভয়ে অস্থির হয়ে পড়ল; তবু মুখে কিছু বলল না। রাজপুত্র তো তাদের কাছে একমাসের সময় নিয়েছেন।

রাজপুত্র মন্ত্রীপুত্র আর কোটালপুত্রের দিকে চাইলেন। মন্ত্রীপুত্র বললেন, কাল সন্ধ্যার পর আমার দরজা দিয়ে আমি কাউকে ঢুকতে দিইনি। কোটালপুত্র বললেন—–কাল সন্ধ্যার পর আমিও কাউকে ঢুকতে দিইনি। তা ছাড়া আমার সদর দরজায় কেউ ঢুকতেও আসেনি। রাজপুত্র বললেন—আমারই ভুল হয়েছে, আমারই দোষ হয়েছে। কাল সন্ধ্যার পর আমি এক কাঠ-কুড়ুনী বুড়ীকে রাজ্যে ঢুকতে দিয়েছিলাম, ওটা নিশ্চয়ই রাক্ষসী। আজ যদি তোদের কারো সদর দরজায় কোন কাঠকুড়ুনী বুড়ী ঢুকতে যায়, ওর মায়াকান্নায় ভুলবি না। তৎক্ষণাৎ খড়্গ দিয়ে গলা কেটে ফেলবি।

সন্ধ্যে না হতেই তিন বন্ধু গতকালের মতোই আবার রাজ্যের তিন দিকের সদর দরজায় খড়্গ নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কোটালপুত্রের দরজায় এক সন্ন্যাসিনী হাজির হলো। কপালে রক্তচন্দন, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, হাতে ত্রিশূল।

সেরা রূপকথার গল্প। রাজপুত্রের গল্প
সেরা রূপকথার গল্প। রাজপুত্রের গল্প RUPKOTHAR GOLPO

কোটালপুত্র বললে—আপনি কে? —আমি সন্ন্যাসিনী সদর দরজা ছেড়ে দাও, আমি রাজ্যে ঢুকবো।

কোটালপুত্র বললে, যদি আপনাকে ঢুকতে না দিই! সন্ন্যাসিনীর চোখ দুটো ভাঁটার মতো জ্বলে উঠল, গম্ভীরকণ্ঠে বললে—আমাকে যদি ঢুকতে না দাও, রাজ্যের অমঙ্গ ল হবে। তোমাকেও আমি অভিশাপ দেবো। কোটালপুত্র মনে মনে সাংঘাতিক ভয় পেয়ে গেলো। এ নিশ্চয়ই রাক্ষসী নয়, ইনি নিশ্চয়ই সন্ন্যাসিনী। অতএব কোটালপুত্র সন্ন্যাসিনীকে রাজ্যের অভ্যন্তরে ঢুকতে দিলো।

আবার পরদিন সকাল বেলা তিন বন্ধু আর এক মর্মবিদারক সংবাদ শুনতে পেলো। শিবমন্দিরের পুরোহিতের দুটো গরু খেয়ে, রাক্ষসী হাড়গোড় চত্বরে ফেলে গেছে। আবার তিন বন্ধু পরস্পর চোখ চাওয়া-চাওয়ি করল। রাজপুত্র বললেন— আমার সদর দরজা দিয়ে আমি গতকাল কাউকেই ঢুকতে দিইনি।

মন্ত্রীপুত্র বললেন—আমার সদর দরজা দিয়ে একটা মশা পর্যন্ত ঢুকতে পারেনি কাল এমন কড়া পাহারা দিয়েছি আমি। কোটালপুত্র মাথা নত করে বললেন—আমার ভুল হয়ে গেছে, কাল সন্ধ্যার পর একজন সন্ন্যাসিনীকে রাজ্যে ঢুকতে দিয়েছিলুম।

—রাজপুত্র বললেন— যা হবার হয়ে গেছে, গতস্য শোচনা নাস্তি। রাক্ষসীটা দেখছি মেয়েছেলের রূপ ধরেই আসে। আজ আর কোনো দরজা দিয়ে যে কোন মেয়েছেলেকে ঢুকতে দেওয়া না হয় তা যে বেশেই আসুক।

সন্ধ্যার পর পশ্চিমের সদর দরজায় চারিদিকে নজর রেখে, মন্ত্রীপুত্র উন্মুক্ত খড়া হাতে সদর দরজায় পাহারা দিচ্ছে। এমন সময় সদর দরজায় মাথায় পাগড়ী বাঁধা একটা লোক এলো।

মন্ত্রীপুত্র জিজ্ঞেস করলেন—আপনি কে?

লোকটা বললে—আমি একজন বিদেশী সওদাগর। ঝড়ে আমার জাহাজ ডুবে যায়। তবুও আমরা চারজন বেঁচেছিলুম। কোন রকমে সাঁতরে আমরা চারজন এই রাজ্যের তীরে উঠেছিলুম।

লোকটা কাঁদতে কাঁদতে বললে সে দুঃখের কথা আর বলবেন না। বিপদের ওপর বিপদ। বিপদ যখন আসে—তখন চারিদিক থেকেই আসে। আমরা চারজন তীরে উঠতেই দূর থেকে একটা ভীষণ রাক্ষসী হাঁউ-মাঁউ-খাঁউ করে ছুটে এলো। ওদের তিনজনকে গিলে ফেললো। আমি একটু দূরে ছিলুম। এক ছুটে পালিয়ে এলুম। এই দেখুন, এখনও হাফাচ্ছি।

বিদেশী সওদাগরের কথা শুনে মন্ত্রীপুত্রের খুব দয়া হলো—বিদেশী সওদাগরকে তিনি রাজ্যের অভ্যন্তরে ঢুকতে দিলেন। ঢুকতে দেওয়ার আগে মনে মনে একবার অবশ্য ভেবে নিলেন—এই লোকটা নিশ্চয়ই রাক্ষসী হবে না। রাক্ষসী হলে তো মেয়েছেলের রূপ ধরেই আসতো।

পরদিন সকালে আবার আর এক দুঃসংবাদ পাওয়া গেলো। দুটি বাচ্চা মেয়ে সন্ধ্যের পর পাশের বাড়ী থেকে নিজেদের বাড়ী ফিরছিল, এমন সময় রাক্ষসীটা তাদের খেয়ে ফেলেছে। শুধু হাত-পা খায়নি। সে-গুলো রাজপথের ওপর ছড়িয়ে রেখে গেছে।

আবার তিনবন্ধু পরস্পরের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। কোটালপুত্র বললেন—আমি কাল আমার সদর দরজা দিয়ে কাউকেই ঢুকতে দিইনি। সাংঘাতিক কড়া পাহারা দিয়েছি।। রাজপুত্র বললেন—আমিও কাল সদর দরজা দিয়ে কাউকেই ঢুকতে দিই নি।

চারদিকে নজর রেখে সারারাত জেগে পাহারা দিয়েছি। মন্ত্রীপুত্র বললেন—আমিও কালকে আমার সদর দরজা দিয়ে কোন মেয়েছেলেকে ঢুকতে দিইনি। তবে আমার সদর দরজা দিয়ে কাল একজন বিদেশী সওদাগর ঢুকেছিল। কিন্তু সে তো মেয়েছেলে নয়—আমি ভাল করে পরখ করে দেখেছি। তার তো ইয়া লম্বা গোঁফ ছিল।

রাজপুত্র বললেন—ওটা নিশ্চয়ই রাক্ষসী হবে, রাক্ষসীটা মায়াবিনী!। পুরুষের বেশও ধরতে পারে। অতএব আজ থেকে সন্ধ্যের পর কোন দরজা খোলা থাকবে না। আমাদের কাউকে—পাহারা দিতেও হবে না। আজ থেকে তিনটে সদর দরজাই সন্ধ্যে হওয়ার কিছু আগেই বন্ধ হয়ে যাবে, আবার খোলা হবে পরদিন ভোরবেলা সূর্য ওঠার পর।

সারা রাজ্যে ট্যাড়া পিটিয়ে রাজপুত্রের এই সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করে জানিয়ে দেওয়া হলো। সবাইকে সন্ধ্যের আগেই বাইরের কাজ সেরে নিতে হবে, সন্ধ্যের পর কাউকে কোন সদর দরজা দিয়েই ঢুকতে দেওয়া হবে না।

রাজপুত্রের এই নতুন ব্যবস্থায় কিন্তু ফল হলো। রাজ্যের অভ্যন্তরে রাক্ষসীর অত্যাচার বন্ধ হয়ে গেলো। রাক্ষসীরও তো প্রাণে ভয় আছে, অতএব দিনের বেলা রাজ্যের ভিতর ঢুকবে কোন সাহসে? তাছাড়া সন্দেহজনক লোককে রাজ্যে থাকতে দেওয়া হবে না, রাজার হুকুম প্রজারাও মেনে অতি পরিচিত আত্মীয়-স্বজন ছাড়া কেউ কারো বাড়ীতে নতুন কাউকে থাকতে দিচ্ছে না। আর রাক্ষসীর তো মানুষ আত্মীয় হতে পারে না। যে, দিনের বেলা মানুষের বেশ ধরে কারো বাড়ীতে থাকবে— আর রাত্রি বেলা রাক্ষসের রূপ ধরে মানুষ গরু খাবে।

অবশ্য রাক্ষসী একবার রাজ্যের মধ্যে ঢুকে দাসীবৃত্তি জোটাতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু রাজার হুকুমে রাজ্যের কেউ আর নতুন দাসী বা চাকর রাখতে রাজী নয়— পরিচয়ের সূত্র চাই। অতএব রাক্ষসী বিফল মনোরথ হয়েই আবার রাজ্যের বাইরে জঙ্গলে ফিরে এসেছে। আর সন্ধ্যের পর রাজ্যের ভেতর ঢোকারও উপায় নেই, তিনদিকের বিরাট বিরাট সদর দরজা সন্ধ্যে হওয়ার এক ঘণ্টা আগেই বন্ধ হয়ে যায়। একটা মশা-মাছিরও ঢোকবার উপায় থাকে না।

মন্দিরে বা মঠে নূতন বিদেশী সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীদেরও থাকতে দেওয়া হয় না—রাজার হুকুম। অতএব রাক্ষসী আর রাজ্যে ঢুকতে পারে না।

কিন্তু রাজ্যের বাইরে রাক্ষসীর অত্যাচার বেড়ে চললো। যারাই রাজ্যের বাইরে যায়, তারা আর ফিরে আসে না। অথচ ব্যবসা-বাণিজ্যের খাতিরে বাইরে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। নদীর ঘাটে বিভিন্ন রাজ্য থেকে জাহাজ আসে— মালপত্র আনতে হলে নদীর ঘাটে যেতেই হবে। নগরের বাইরে ক্ষেত, ক্ষেতের ফসল আনতে হলেও যেতে হবে। সৈন্য পাহারা দিয়ে কত লোককে আর আসা যাওয়ায় সাহায্য করা যায়?

অতএব রাজা আবার মহা ভাবনায় পড়লেন। রাক্ষসীকে না মারতে পারলে—রাজ্যে পরিপূর্ণ শাস্তি কিছুতেই ফিরে আসতে পারে না। অবশ্য রাজকুমার কথা দিয়েছেন, এক মাসের মধ্যেই রাক্ষসীকে যে করেই হোক মেরে ফেলবেই। মাত্র সাতদিন হয়েছে, এখনও তেইশ দিন বাকী। রাজকুমার রাজার মুখে সব কথা শুনে, কোটালপুত্র ও মন্ত্রীপুত্রের সঙ্গে যুক্তি করলেন। তারপর একদিন তিনজনেই ছদ্মবেশ ধারণ করে, রাজ্যের তিন সদর দরজা দিয়ে তিনজন তিনদিকে বেরিয়ে গেলেন।

মন্ত্রীপুত্র ঘোড়া ছুটিয়ে প্রায় দশ ক্রোশ দূরে গেলেন, কিন্তু রাক্ষসীর কোনো সন্ধান পেলেন না। অতএব সন্ধ্যের আগেই ঘোড়া ছুটিয়ে রাজপুরীতে ফিরে এলেন। কোটালপুত্রও চারিদিকে বহু খোঁজাখুঁজি করেও রাক্ষসীর কোন সন্ধান পেলো না। ফেরার পথে একটা বাঘ মেরে ফিরে এলো। বলা যায় না যদি রাক্ষসীটা বাঘের রূপ ধরে থাকে।!

রাজপুত্রও ঘোড়া ছুটিয়ে অনেক দূর চলে গিয়েছিলেন, কিন্তু কোথাও রাক্ষসীর পাত্তা নেই। রাক্ষসীটা হাওয়ায় উড়ে গেলো নাকি? রাজপুত্র হতাশ হয়ে ফিরেই আসছিলেন। হঠাৎ বনের মধ্যে এসে দেখতে পেলেন—এক পরমাসুন্দরী কন্যা একটা গাছের নীচে বসে কাঁদছে। চোখ দিয়ে মুক্তোর মতো অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়ছে। চাঁপা ফুলের মতো গায়ের রঙ্, মেঘবরণ চুল। যেন বন আলো করেছে রূপবতী।

রাজপুত্র কন্যার রূপ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন, এর আগে কখনও এতো সুন্দরী নারী দেখেনি। ঘোড়া থেকে নেমে কন্যার কাছে এগিয়ে গিয়ে বললেন কে তুমি? কন্যা কাঁদতে কাঁদতেই বললে—আমার নাম নুপুর। রূপনগরের রাজকন্যা আমি। রাক্ষসের অত্যাচারে আমাদের রাজ্যে কেউ বেঁচে নেই। আমার বাবা মাকে রাক্ষসেরা খেয়ে ফেলেছে। আমি প্রাণ ভয়ে ছুটে পালিয়ে এসেছি। বলাগড় রাজ্যে গিয়েছিলুম সেখানেও কেউ আমাকে আশ্রয় দিলে না। ওখানকার রাজার হুকুম, অপরিচিত পুরুষ বা নারীকে রাজ্যের ভিতর কেউ আশ্রয় দিতে পারবে না। তাই আমি এই বনে বসে কাঁদছি। রাজপুত্র বললেন—রূপবতী, আমি তোমাকে আশ্রয় দেবো। আমি বলাগড়ের রাজকুমার। আমি তোমাকে বলাগড়ে নিয়ে যাবো। আমি তোমাকে বিয়ে করবো। আমি তোমার সকল দুঃখ ভুলিয়ে দেবো।

অবশ্য রাজকুমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসবার আগে একবার ভাল করে ভেবে নিয়েছিলেন—এমন রূপ যার, সে রাক্ষসী হতে পারে না। চাঁপার মতো রঙ, মেঘবরণ চুল। রাজকুমার প্রথম দর্শনেই নুপুরের রূপ দেখে ভুলে গেলেন, অত চিন্তার তাঁর সময় কই।

নুপুরকে ঘোড়ায় উঠিয়ে একেবারে রাজবাড়ীতে নিয়ে এলেন। নুপুরের রূপ দেখে রাজ্যের সবাই মুগ্ধ হয়ে গেলেন। এমন রূপ দেবীরই হতে পারে। রাজ্যের সকলেই একবাক্যে রাজকন্যা নুপুরের রূপের প্রশংসা করল।

নতুন রূপকথার গল্প RUPKOTHAR GOLPO সেরা রূপকথার গল্প
নতুন রূপকথার গল্প RUPKOTHAR GOLPO সেরা রূপকথার গল্প image
<

পরদিনই রাজকুমারের সঙ্গে রাজকন্যা নুপুরের মহা ধুমধামে বিয়ে হয়ে গেলো। রাজ্যের লোকেরা পেটপুরে খেলো। অনেক দিন পর সারা রাজ্য আনন্দে মেতে উঠল। নাচ-গান হৈ-হল্লায় মেতে উঠল। পরদিন নগর কোটাল আরও সুসংবাদ নিয়ে এলেন—গতকাল রাজ্যের ভেতরে বা বাইরে রাক্ষসীর কোন অত্যাচার হয়নি।

কোটালপুত্র গোঁফে তা দিয়ে বললে— কাজটা আমারই। আমিই কাল রাক্ষসীকে হত্যা করেছি। রাক্ষসীটা বাঘের রূপ ধরে আমায় ভয় দেখাতে এসেছিল। আমি খড়ড়্গ দিয়ে কেটে ফেলেছি। সবাই হাতে তালি দিয়ে কোটালপুত্রকে অভিনন্দন জানালেন।

রাজাও ঘোষণা করলেন—হে কোটালপুত্র! তুমি যদি সত্যিই রাক্ষসীকে হত্যা করে থাকো, আগামী সাত দিনের মধ্যে যদি রাজ্যে বা রাজ্যের বাইরে রাক্ষসীর অত্যাচারের কোন খবর না পাওয়া যায়, তোমাকে অর্ধেক রাজ্য দেবো। আর রাজকন্যার সঙ্গে তোমার বিয়ে দেবো।

কোটালপুত্র আনন্দে খুশীর হাসি হাসল। আর বারবার গোঁফে তা দিতে লাগল। কিন্তু সাত দিনও পেরোল না। তিন দিন পরেই আবার দুঃসংবাদ পাওয়া গেলো। এবার আর রাজ্যের বাইরে নয়, নগরের অন্য কোন খানে নয়— একেবারে খোদ রাজবাড়ীতে। সকাল বেলা এসে রাজার গো-শালার রক্ষক খবর দিলে—হুজুর, ধবলীকে রাক্ষসীতে খেয়ে ফেলেছে। ধবলী রাজার গো-শালার সব চাইতে ভালো গাই ছিল। দুবেলা মিলিয়ে প্রায় দেড় মণ দুধ দিতো। রাজকুমারও খবর শুনে খুব মর্মাহত হয়ে পড়লেন, একেবারে রাজবাড়ীতেই রাক্ষসীর কীর্তিকলাপ শুরু হয়ে গেলো। গো-শালায় গিয়ে রাজকুমার দেখলেন ধবলী যেখানে ছিল, সেখানে হাড়গোড় পড়ে আছে। আর সেখান থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্তের দাগ একেবারে রাজবাড়ীর অন্দরমহলের কাছে এসে শেষ হয়েছে।

রাজ-অন্তঃপুরের দাসী বা পরিচারিকা, ভৃত্য সকলকেই ডাকা হলো। প্রশ্ন করা হলো, কারো আত্মীয় বা আত্মীয়া দু’একদিনের মধ্যে এসেছে কি না? অনেক জেরার পর একজন পরিচারিকা বললে আমার এক বোনঝি দুদিন হলো এসে আমার কাছেই আছে, ওর মা মারা গেছে। রাজপুত্র সাংঘাতিক রেগে গিয়ে বললেন- ও তোমার বোনঝি নয়। বোনঝি সেজে সেই রাক্ষসীটাই এসেছে।

পরিচারিকাটাও রাজপুত্রের কথা শুনে ঘাবড়ে গেলো হতেও পারে ওটা রাক্ষসী। হয়তো বোনঝির রূপ ধরে রাক্ষসীটাই এসেছে। রাক্ষসীরা সব পারে। সঙ্গে সঙ্গে বোনঝিকে রাজপুত্রের সামনে হাজির করা হলো। রাজপুত্রের হুকুমে সঙ্গে সঙ্গে কোটাল তার গর্দান কেটে নিল। তারপর বস্তায় বন্দী করে রাজ্যের বাইরে নদীতে ফেলে দিয়ে এলো। কোটালপুত্রের অর্ধেক রাজ্য আর রাজকন্যাকে লাভ করার আশা লুপ্ত হয়ে গেলো। সবাই কোটালপুত্রের মাথায় গাঁট্টা মেরে ঠাট্টা করতে লাগলো।

দুদিন বেশ ভালোয় ভালোয় কাটল। তিনদিনের দিন সকালবেলায় রাজার হাতীশালার রক্ষক আর এক দুঃসংবাদ নিয়ে এলো। রাজা হাতীশালায় গিয়ে দেখলেন—হাতীটা যে জায়গায় বাঁধা ছিলো সে জায়গায় শুধু হাড়গোড় পড়ে আছে। সেই পরিচারিকাটি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো, তবে তাঁর বোনঝি রাক্ষসী ছিলো না, রাক্ষসীটা এখন রাজবাড়ীর কোথাও লুকিয়ে আছে। দাস-দাসী আর পরিচারিকাদের ডাকা হলো। তারা বললে তাদের কোন আত্মীয় বা আত্মীয়া কেউ আসেনি।

রাজবাড়ীর সদর দরজার পাহারাদারকে তলব করা হলো, সে বললে—অপরিচিত কেউ ঢোকেনি, তবে তিন দিন আগে একটা কুকুর ঢুকেছিলো। তন্ন তন্ন করে সেই কুকুরটাকে সবাই মিলে খুঁজতে লাগল, শেষে রাজবাড়ীর পুকুর-ঘাটে পাওয়া গেলো। কুকুরটাকে ধরে এনে রাজার হুকুমে কোতল করা হলো। কিন্তু পরদিন সকালেই আর এক দুঃসংবাদ পাওয়া গেলো। রাজার ঘোড়াশালার রক্ষক এসে বলল— রাজপুত্রের সাদা ঘোড়াটাকে রাক্ষসীতে খেয়ে ফেলেছে।

রাজপুত্র অশ্বশালায় গিয়ে দেখলেন, ঘোড়াটার হাড়গোড় পড়ে আছে। ওখান থেকে রক্তের দাগ একেবারে রাজ-অন্তঃপুরের দোতলা পর্যন্ত এসেছে। তারপর কে যেন পা দিয়ে মুছে ফেলেছে। রাজপুত্র রাণীর মহলে এসে দেখলেন, রাণী তখনও অঘোরে ঘুমুচ্ছে। রাণীর পায়ের পাতায় রক্তের দাগ। রাজপুত্রের মনে সন্দেহ জাগল, কিন্তু এই সন্দেহের কথা উনি কাউকে কিছু বললেন না।

সেদিন রাত্রে রাজপুত্র ঘুমালেন  না, ভাণ করে রাণীর পাশে শুয়ে রইলেন। মাঝরাতে দেখলেন রাণী বিছানা থেকে উঠল, তারপর পা টিপে টিপে দরজা খুলে বাইরে গেলো। রাজপুত্র আস্তে আস্তে কিছু দূরত্ব বজায় রেখে রাণীর পেছন পেছন গেলেন। রাণী এদিক-ওদিক ভালভাবে লক্ষ করে অশ্বশালায় ঢুকে গেলেন। তারপর রাক্ষসীর মূর্তি ধারণ করে একটা ঘোড়াকে খেয়ে হাড়গোড় কড়মড় করে চিবোতে লাগলেন।

রাক্ষসীর গল্প নতুন রূপকথার গল্প
রাক্ষসীর গল্প নতুন রূপকথার গল্প

রাজপুত্র দূর থেকে সব দেখে, নুপুর ফেরবার আগেই বিছানায় এসে ঘুমের ভাণ করে পড়ে রইলেন। ঘোড়াটা খাওয়ার পর রাক্ষসীটা আবার রাণীর মূর্তি ধরে পা টিপে এসে রাজপুত্রের পাশে শুয়ে পড়লো। তারপর কিছুক্ষণ নাক ডাকিয়ে ঘুমুতে লাগলো। সে-কী গভীর ঘুম! রাজপুত্র আস্তে আস্তে উঠে বিছানার পাশে রাখা খড়্গ তুলে নুপুরের গলা কেটে ফেললেন। নুপুর তখন আর নুপুর নেই, বিকট রাক্ষসীর রূপ ধরে দাপাতে দাপাতে মরে গেলো।

আমাদের টেলিগ্রামে আড্ডা দেওয়ার গ্রুপ :- Join our Telegram group

চীৎকার শুনে রাজা-রাণী, রাজপুরীর সবাই ছুটে এলো। এসে যা দেখলেন, তাতে তারা সাংঘাতিক অবাক হয়ে গেলেন নুপুরের পালঙ্কে নুপুর নেই, সেখানে এখানে ভয়ঙ্কর রাক্ষসী গলা কাটা অবস্থায় মরে আছে।

রাজপুত্র কথা দিয়েছিলেন যে এক মাসের মধ্যে রাক্ষসীকে হত্যা করবেন। তা তিনি তাঁর কথা রেখেছেন এক মাস পুরো হতে আর অনেকদিন বাকী ছিলো। আর এভাবেই গোটা রাজ্য রাক্ষসীর অত্যাচার থেকে রক্ষা পেল।

এই ছিল আজকের রূপকথার গল্প। এই নতুন রূপকথার গল্পটি তোমাদের কেমন লেগেছে, তা আমাদের ভুলো না যেন। আর যদি তুমিও গল্প লিখতে চাও অবশ্যই আমাদের সঙ্গে যুক্ত হতে পারো। কিভাবে যুক্ত হবে সেই সম্পর্কিত ভিডিওর লিংক পেয়ে যাবে এই পেজের একটু নীচে।

নতুন রূপকথার গল্প। সেরা রূপকথার গল্প। রাজপুত্রের গল্প। রাক্ষসীর গল্প। rupkothar golpo

Spread the love

Leave a Reply