হতাশা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প ছেলেদের জীবনটা এমন এক জীবন যেখানে প্রতিটি মুহূর্তকে বুঝে উঠার আগেই, সেই মুহূর্তের স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে হয়। তা আর হবে নাই বা কেন! কিছু দায়িত্ববোধ জাঁকিয়ে ধরে যে!!
হতাশা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পঃ- ‘দায়িত্ব’
“তুই আবার সিগারেট নিয়েছিস! ফেল বলছি ফেল।” অতনু শুভর হাত থেকে টেনে ছুঁড়ে ফেলে দেয় সিগারেট টা।
-“-কি হয়েছে তোর শুভ্র?”
-“কিছু না রে।”
-“তাহলে সিগারেট কেন?”
-“আমাদের জীবনটা তো ঐ সিগারেট এর মতোই।”
-“মানে!”
-“একটু একটু করে পুড়তে থাকি সিগারেট এর মতো। তারপর ধোঁয়া তারপর ছাই।” বলে হাসে শুভ্র।
“তোর কি হয়েছে বলবি!”
-“জীবনের শেষ প্রান্ত অবধি তো তুইই আমার সাথে ছিলিস।”
-“এসব কি কথা হ্যাঁ! ‘জীবনের শেষ প্রান্ত’ এসব কি ইয়ার্কি হচ্ছে?”
-“বাবা আমাকে মারধোর করে বের করে দিয়েছে রে বাড়ি থেকে, বলেছে ক্লাস টেন অবধি পড়ে ছেড়ে দেওয়া বেকার ছেলে কে আমি এভাবে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াতে পারব না। কাজ খুঁজে নিতে বলল। টাকা না রোজগার করা পর্যন্ত বাড়ি ঢুকতে দেবে না আমায়। মা খুব কাঁদছিল জানিস যখন আমাকে বাবা মারছিল । এই দেখ আমার ঘাড়ে, পিঠে, বুকে, হাতে বেল্ট এর কালসিটে। রক্তও বেরোচ্ছে অনেক।”
অতনু দেখে শুভ্রর গোটা শরীর ছিন্ন বিচ্ছিন্ন। “কাকু এটা কি করলেন! বকাঝকা দিতে পারতেন কিন্তু এইভাবে…” অতনু আর্তনাদ করে বলে ওঠে।
-“না রে ভাই, মুখের কথা বুকে আঘাতের তীব্রতার চেয়ে বেল্ট বা চাবুকের আঘাতের তীব্রতা অনেক কম।”
পড়ুনঃ- শিক্ষণীয় ছোট ছোট মোটিভেশনাল গল্প
-“দাঁড়া আমি ওষুধ আনি, এত সাংঘাতিক ক্ষতগুলো,, খুব যন্ত্রণা করছে বল? ইস! দগদগ করছে পুরো। আমি এখনি ওষুধ নিয়ে আসছি।” ব্যস্ত হয়ে বলে অতনু।
শুভ্র অতনুর অস্থিরতা দেখে ওর হাত ধরে মাথা নাড়িয়ে বলে , “আমাদের যন্ত্রণা থাকতে নেই, আমাদের যন্ত্রণা হয় না।”
-“কি যা তা বলছিস তুই! এত সাংঘাতিক ক্ষত! পাগলামি করিস করিস না শুভ্র, আমাকে যেতে দে।”
-“যাস না অতনু, আমার কাছে বস একটু। তুই থাকলে আমার কিছু হবে না রে।”
শুভ্রর কথাগুলো শুনে আজ খুবই কষ্ট হচ্ছে অতনুর। দুই বন্ধু হাই ওয়ের একটু সাইডে ফুটপাত টাইপের জায়গায় বসে আছে। একটু এগোলে ব্রিজ আর তার ওপাড়ে নদী।
অনেকক্ষণ পর নিস্তব্ধতা ভেঙে অতনু বলে ওঠে, “শুভ্র, তোর যন্ত্রণা হচ্ছে না?”
-“না রে।”
-“মিথ্যে কথা বলিস না। আমাকে শেখাচ্ছিস!”
-” আমাদের যন্ত্রণা হলেও যন্ত্রণা হচ্ছে বলতে নেই বরং সবার সব যন্ত্রণা নিজের কাঁধে হাসিমুখে তুলে নিতে হয়। চোখের জল এলেও সেটাকে বাইরে আসতে দিতে নেই। কারণ আমরা ছেলে, আমাদের কাঁদতে নেই, কাঁদতে দেওয়া হয় না। আর আমরা হলাম মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে, আমরা এই জগৎটাকে চিনি যে এটা কতটা কঠিন, কতটা কঠোর। সবাই তো কাঁধে চাপড় মেরে সান্ত্বনা বা মোটিভেট করতেই পারে কিন্তু লড়াইটা দিনশেষে আমাদের একার আর নিজেকেই করতে হয়।
এতকিছুর যন্ত্রণা ভোগ করতে করতে বেল্ট এর মারের যন্ত্রণা মনেই থাকে না রে! এখন টাকা ছাড়া সব ফাঁকা। টাকা থাকলেই তুই পরিবারের কাছে দায়িত্বশীল ছেলে, টাকা থাকলেই তুই আত্মীয়ের কাছে নয়নের মনি, টাকা থাকলেই তুই বন্ধুমহলে সেরা, টাকা থাকলেই তুই বহু নারীর হৃদয়হরণকারী! বোনের সেরা দাদা, তোর এলাকায় নামকরা কেউ , সেরা প্রেমিক, সেরা স্বামী, সেরা জামাই, সেরা বাবা..!” বলতে বলতে গলা ধরে আসে শুভ্রর।
অতনু ওর হাতটা ধরে বলে, “ভেঙে পড়িস না বন্ধু, আমরা ঠিক পারব দেখিস! পারবোই আমরা। আজ যাদের সবার কাছে শুনতে হয় বেকার ছেলে তারাই একদিন সবার দায়িত্ব মাথায় তুলে নেবে। ওই যে তুই বললি না যে আমাদের কাঁদতে নেই, তেমন আমিও বলছি, আমাদের ভেঙে পড়তেও নেই। সবসময় এই চওড়া বুকটাতে বল রেখে এগিয়ে যেতে হয়। প্রচুর যন্ত্রণা, প্রচুর কষ্ট, অনেক ক্ষত আমাদের পিঠ ছিন্নভিন্ন করে দেবে কিন্তু আমরাই যে পরিবারের পাঁচিল।
পড়ুনঃ- বাবাকে নিয়ে একটি শিক্ষণীয় গল্প
পাঁচিল ভেঙে পড়লে, দরজা ভেঙে গেলে যেমন বাড়ির সুরক্ষা নেই আমরা ভেঙে গেলে আমাদের পরিবারের সুরক্ষা কার হাতে থাকবে? দরজায় তো বাড়ির লোকেরা কথায় কথায় অনেক লাথি মারে, ধাক্কা মারে, ভাঙে ; কিন্তু তবুও সেই দরজা বা পাঁচিল ঠিকই বাড়ির সবাইকে সুরক্ষিত করে রাখে। দরজার সাথে আমাদের পার্থক্য একটাই, দরজাকে বাড়ির ভেতরের সদস্যরা সারিয়ে তোলে কিন্তু আমাদের সারানো আমাদের নিজেদের কেই করতে হয়। ভেঙে পড়িস না ভাই আমার।”
বিহ্বল হয়ে শোনে শুভ্র, অতনুর কথাগুলো। এটাই যে মধ্যবিত্ত পরিবারের বাণী আর যাদের জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাণশক্তি এইসব কথা গুলো তাদের জাতি হলো পুরুষ। হ্যাঁ ছেলে নয় পুরুষ। জন্ম থেকেই তারা শিশুপুত্র এর চেয়েও পুরুষ সিংহ হিসেবে বেশি সমাদৃত। তাদের জন্ম টার উদ্দেশ্যে একটাই, তাদের ঘাম হোক বা রক্ত – দুইই ঝরিয়ে পরিবারের সবাইকে ভালো রাখা, সবার দায়িত্ব নেওয়া। নিজের ভালো থাকা ভাবার চেয়েও সবার ভালো থাকার দিকে নজর রাখা। নিজের পছন্দের জিনিস টা কিনতে যাওয়ার সময় দশবার ভাবা, আমি যদি এটা কিনি বাড়িতে কোনো অসুবিধা হবে না তো?
-“নাহ, সব ছেলেরা নয় তাই বলে” অতনু বলে ওঠে শুভ্রর ভাবনার উত্তরে।
শুভ্র তাকায় অতনুর দিকে।
অতনু বলে, “তুই ভাবছিস যে সব ছেলেদের জীবনটাই ত্যাগ কিন্তু না ভাই তা নয়, বহু ছেলেরাই বোঝে না লড়াই কাকে বলে। জানে না অভাব কি, সংগ্রাম কি। অনুভব করে না কখনো নিজে না খেয়ে থেকে পরিবারকে খাওয়ানোর আনন্দ কতটা। তাদের গায়ে কখনো পরিশ্রমী বাবার ক্রোধ ও কষ্টমিশ্রিত মার পড়ে না , ওরা শাসন চেনে না, চেনে বিপথে চালিত করা আদর।”
“বরং তারা টাকা ওড়াচ্ছে প্রচুর, যা চায় তাই পায়। এটা কেনে, সেটা খরচা করে। তারা তো জানে তাদের জীবন টা পুরোপুরি ঠিকই আছে। সুখে, বিলাস ব্যসনে ভরা জীবন। অসৎ ভাবে তাই জীবনযাপন করে অনেক ছেলেই, বিশৃঙ্খল আরো অনেক কিছু। কিন্তু তারাও, হ্যাঁ তারাও বড়াই করে বলে, “আমরা ছেলে, পরিবারের পাঁচিল! ”
ওরাই জানে ওরা পাঁচিল নাকি জতুগৃহ।
ওরা করছে করুক, ওদের সব আছে তাই ওরা করছে, কিন্তু আমাদের তো তা নেই ভাই। আর হলেও তা শুধুমাত্র নিজেদের সুখের পেছনে খরচ করার জন্যও গচ্ছিত নয়, সবাইকে ভালো রাখার পর যদি কিছু অবশিষ্ট থাকে তখন নয়তো পরিবারের আনন্দেই আমাদের আনন্দিত হতে হয়। তোকে কি আমি বোঝাতে পারলাম শুভ্র?”
পড়ুনঃ- আপনার গল্পের কিং আপনিই নাকি অন্য কেউ!!
শুভ্র চুপ করে সব শুনছে।
-“চুপ করেই থাকবি নাকি কিছু বলবি? ওষুধটাও দিলি না। বড্ড জেদ তোর জানিস তো শুভ্র।” রেগে বলে ওঠে অতনু।
-“সব যন্ত্রণা চলে গেছে রে তোর কথা গুলো শুনে। তুই ঠিক ই বলেছিস, সত্যিই তো, বাবা কেন আমার গায়ে হাত তুলবে! কতটা কষ্ট পেলে বাবার মতো মানুষ এমন কাজ করে তার সন্তানের সাথে! বাবাও তো আমার মতোই এককালে এই কিশোর ছিল। ছিল অনেক স্বপ্ন, অনেক আশা, অনেক ইচ্ছা। কিন্তু এসবের উপরেও “দায়িত্ব” বলে যে একটা শব্দ আছে। ওই দায়িত্ব শব্দটার কাছে সত্যি বলতে ছেলেদের জীবনের অন্য কোনো কিছু টেকে না, এমনকি পড়াশোনাও, তাই তো মাঝপথে ছেড়ে দিতে হয় বইকে আর গুনতে হয় গা গতরে খাটার পর কয়েকটা টাকা। আর দায়িত্ববান এর মাপকাঠিই তো একমাত্র অর্থ। চল, তুই আর আমি দুজনেই যা কাজ পাই করব। কোনো কাজই তো ছোট নয়, অসৎ পথে না থাকলেই হলো।”
অতনু ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে। শুভ্রও জড়িয়ে ধরে ওর প্রিয় বন্ধু কে।
তখন অনেক রাত। তবুও দুই বন্ধু মিলে একসাথে পথ চলতে থাকে। চোখে আশা দায়িত্ববোধের। মনে ইচ্ছা দায়িত্ববান হওয়ার। বুকে বল দায়িত্ব পালনের জন্য আর চেষ্টা শুরু দায়িত্বের জন্য।
সব রাগ, কষ্ট, অভিমান ভুলে অতনু আর শুভ্র একটা গ্যারেজ এ কাজ পায়। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হয়ত অনেক পরিশ্রম টাও অনেক মনে করতে মন চায় না।
বাবার হাতে টাকা তুলে দেয় শুভ্র। বাবার চোখে জল। হন্যে হয়ে ছেলেকে খুঁজে গেছে। মা সারারাত জেগে, চোখ দুটো ফুলে গেছে কাঁদতে কাঁদতে।
বুকে জড়িয়ে ধরে বাবা বলে, “কোথায় ছিলিস তুই বাবা, রাগের মাথায় তোকে অনেক মেরেছি আমি, অনেক যন্ত্রণা দিয়েছি তোকে। আমাকে ক্ষমা করে দে।”
-“না বাবা, এভাবে বোলো না গো, তোমার ওই মার যে একপ্রকার আশীর্বাদ। ওই মারটা নিজের বাবার বদলে অন্য কেউ যদি দিত তাহলে আরো বেশী যন্ত্রনার হতো, অপমানের হতো। ওই মার শিখিয়েছে যে একটা ছেলের জীবন কতটা কঠোর হতে পারে। জীবনের গভীরতা, মূল্যবোধ সবটা বুঝেছি বাবা।আর অতনু না থাকলে আমি হয়তো এসব কিছু কখনোই বুঝতে পারতাম না।”
ছেলেদের জীবন মোটেও সহজ নয় যে, মেয়ে মানেই যে শুধু বিসর্জন নয়, ছেলে মানেও তো বিসর্জন।
মানব জন্ম মানেই তো কোনো না কোনো ভাবে বিসর্জন দেওয়া নিজেকে।
গল্পের ভাবনায়-
গল্প পাঠাতে পারেন- charpatrablog@gmail.com -এ অথবা সরাসরি WhatsApp -এর মাধ্যমে এখানে ক্লিক করে।
সমস্ত কপিরাইট ছাড়পত্র দ্বারা সংরক্ষিত। গল্পটির ভিডিও বা অডিও বা অন্য কোনো মাধ্যমে অন্যত্র প্রকাশ আইন বিরুদ্ধ। ছাড়পত্র এর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণে বাধ্য হবে।
পড়ুনঃ- একটি শিক্ষামূলক ঘটনা জীবনে ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প
আমাদের সাথে যুক্ত হবেন যেভাবে-
ফেসবুক Group - গল্প Junction
ফেসবুক- ছাড়পত্র
টেলিগ্রাম- charpatraOfficial
WhatsApp Group- ছাড়পত্র (২)
হতাশা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। মধ্যবিত্ত ছেলেদের জীবনের গল্প bengali motivational story.
কি কেন কীভাবের উপর গড়ে ওঠা মানুষের জিজ্ঞাসু মন সর্বদাই নতুন দিগন্তের সন্ধানে পা বাড়ায় ৷ প্রতিটি পদক্ষেপেই নতুন কিছু অভিজ্ঞতা আমাদের ঝুলিতে জমা হয় ৷ সেই অভিজ্ঞতা সকলের সাথে ভাগ করে নেওয়ার মধ্যে এক অফুরন্ত আনন্দ লুকিয়ে থাকে ৷ আর সেই কাজেই হাত বাড়িয়েছে ছাড়পত্রের টিম।
ধন্যবাদ।।