ভালোবাসার মধ্যে ভেদ না থাকলেও, সমাজের কাছে তা অত্যন্ত গুরুতর অপরাধ। আজকের সুন্দর ছোট্ট গল্প টিতে লেখিকা কিছুটা প্রেম, কিছুটা আবেগ, কিছুটা স্নেহের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন।
সুন্দর ছোট্ট গল্পঃ- ‘চির-বসন্ত’
বসন্ত কাল মানেই নাকি রঙকে মাধ্যম বানিয়ে ভালোবাসার ছড়াছড়ি। সরস্বতী পুজোর থেকে দোল পূর্ণিমা পর্যন্ত যেন চারিদিকে শুধু ভালবাসার আমেজ। না না ! ভুল ভাবছেন , শুধু মাত্র প্রেমিক প্রেমিকার কথা আমি বলিনি, ভালোবাসার কথা বলেছি, চির বসন্তের ভালোসার, যে ভালবাসা , রঙ বিহীন মানুষের জীবনকেও , রাঙিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
প্রতিদিনের মতো আজকেও নিকিতা সক্কাল সক্কাল উঠে পুজো সেরে , খবরের কাগজ টা নিয়ে উষ্ণ কফির কাপে চুমুক দিয়ে , পাতা গুলো উল্টে উল্টে পড়তে লাগলো । হটাৎ করে ফোনের রিংটোন টা বেজে উঠতেই , খবরের কাগজটা ওখানেই নামিয়ে । তাড়াহুড়োর মধ্যে বেরিয়ে পড়লো।
আজ দোল উৎসব , চারিদিকে রঙের আমেজে মেতে উঠেছে । মানুষ গুলোর চরিত্রের রঙ, আর বসন্তের পলাশের রঙ যেন মিলেমিশে একাকার । কে বন্ধু , কে শত্রু কিছুই মনে নেই , চারিদিকে ভাঙের নেশা আর রঙের আমেজে মো মো করছে । প্রতিটা বিষয় কে খুব সুক্ষ ভাবে নিরীক্ষণ করে , আলতো একটা হাসি মুখে , নিকিতা সামনের ওই বাংলো টা তে প্রবেশ করলো ।
বাড়িতে প্রবেশ মাত্রই , নিকিতার পুরাতন স্মৃতি গুলো যেন নতুন করে মনে নাড়া দিয়ে উঠলো। মনে পড়ে গেলো দুই বছর আগের কথা …
” পলাশ পালিয়ে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিল আমায় । কেন জানেন?
জাতিগত বৈষম্য, হ্যাঁ ঠিক শুনেছেন , এই একবিংশ শতাব্দীতে দাড়িয়েও আমাদের সম্পর্কে বাঁধা হয়ে দাড়িয়ে ছিলো জাতিগত বৈষম্য। যদিও পলাশ কখনোই সেটাকে গুরুত্ব দেয়নি। উচ্চ রাজবংশী বাড়ির ছেলে ছিল পলাশ , আর আমি ছিলাম সমাজের চোখে শুদ্র বংশীয় কন্যা। তাই বিয়ের পর পলাশ যখন প্রথম বার আমায় এই বাড়িতে নিয়ে এসেছিল, দস্তুর ন্যায় অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিল এই রাজবংশী পরিবার। তবে আমরাও হার মানিনি , নিজেদের মতো করে গড়ে তুলেছিলেন আমাদের সংসার।
সুখ তো ক্ষণস্থায়ী তাই না ! দুঃখটাই দীর্ঘস্থায়ী…
চোখের পলক পড়ার মতো একটা বছর কেটে গেলো । তখন আমি সবে মাত্র রেভিনিউ অফিসার এর পোস্টে join করেছি আর পলাশ ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার। সুখ যেন উপচে পড়ছিল আমাদের সংসারে। ঠিক সেই সময়েই ক্ষণস্থায়ী সুখের মাঝে নেমে এলো গ্রহণের অন্ধকার। পলাশ এক ঝড় জলের রাত্রে বাড়ি ফেরার সময় বজ্রাঘাতে প্রাণ হারালো। এদিকে অপয়া বলে ধিক্কার জানিয়ে, পলাশের নিথর দেহ টা কে একবার দেখতেও দিলো না ওর রাজবংশী পরিবার। পুলিশ হাতে তুলে দিলো পলাশের পার্স টা আর ওর ফোন টা । মন না সায় দিলেও একবার ওর ফোন টা অন করে দেখতে গিয়ে জানতে পারলাম, পলাশ আমায় ছাড়াও , আরো একটি সংসার পেতেছে।
একবারের জন্য হলেও মনে হলো তখন ” ভগবান যা করেন , তা ভালোর জন্যই করেন । ” দুটো জীবন নিয়ে খেলার শাস্তি হয়তো ভগবান নিজ হাতেই ওকে দিয়েছেন।
পড়ুনঃ- না পাওয়া ভালোবাসার গল্প- স্কুল লাইফের ক্রাশ
এরপর আমিও শুধু নিজের কাজে মন দিলাম । ইতিমধ্যে সরকার নোট বন্দী করলো। রণে বনে জলে জঙ্গলে বস্তা বস্তা টাকার হদিস পাওয়া গেলো। পলাশের রাজবংশী পরিবার ও বাদ যায়নি। বাড়িতে রেড পড়লে কয়েক কোটি টাকা পাওয়া গেলো ।
বিপদে পড়ে স্বার্থপর বংশের মনে পড়লো আমার কথা। শ্মশান গামী বুড়োটার উপর সব দোষ চাপিয়ে , নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করলো বাকিরা। তবে আমিও সেদিন ছেড়ে কথা বলিনি । আসল দোষীদের বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় করে, ওই বাড়ির দলিল বুড়ো দাদুর হাতে তুলে দিয়ে ছিলাম । আর আজ সেই দাদুর আমন্ত্রণেই এই বাড়িতে পুনরায় এসেছি। তবে শেষ বারের জন্য
জানি গৃহিনীরা কেউয়ই আমায় সুনজরে দেখেবেন না । তাও শেষ দেখাটা করে আসি।
ঢোকার মুখেই দেখলাম একটা ফুটফুটে বাচ্চা ছেলে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে । চারিদিকে এত রঙ কিন্তু অবাক হয়ে গেলাম ছেলেটাকে দেখে, ওর কোথাও রঙ লেগে নেই, একদম সাদা ধপধপ করছে।
সাদা শাড়ি পরা দেখে , আশেপাশের মেয়েরা সরে দাঁড়ালো । একটা বাচ্চা ছুট্টে এসে রঙ লাগাতে গেলে , এক মহিলা ধরে টানতে টানতে ওকে বাড়ির ভিতরে নিয়ে চলে গেলো । মানুষের গুঞ্জনে শুনতে পেলাম , ওরা বলাবলি করছে ” বিধবা মেয়ে মানুষ , লাজ লজ্জা নেই , কেমন আজ রঙ খেলার দিন , চলে এসেছে । তা বাপু , শুনেছি তো অনেক শিক্ষিত তাহলে এটুকুও কি বোধ নেই যে , বিধবাদের রঙ মাখতে নেই। এছাড়াও জাত পাত তুলেও অবজ্ঞা করতে বাদ দিল না কেউ “
সব শুনে হাসি মুখে , সামনের থালি থেকে এক মুঠো লাল রঙ নিয়ে দাদুর পায়ে দিয়ে প্রণাম করে । বেরিয়ে গেলাম দরজার মুখে , রাঙিয়ে দিলাম ওই ছেলেটার মুখটা। খিল খিল করে হাসতে হাসতে তোতলাতে তোতলাতে বললো ” তোমাতে আমিও রঙ মাতাবো ” সেও একমুঠো রঙ দিয়ে রাঙিয়ে দিল বিধবার সাদা শাড়িতে।
সবাই অবাক হয়ে চেয়ে রইলো আমাদের দিকে !
দাদু এসে শান্ত স্বরে বললেন , এই বাচ্চাটি পলাশের প্রথম স্ত্রীর। মেয়েটি মারা গেছে বিগত তিন বছর আগে। তার মৃত্যুর পরেই পলাশ তোমায় বিয়ে করেছিল। কিন্তু কখনই সাহস করে সবটা তোমায় বলতে পারেনি। এমনকি এই সন্তানের দায়িত্ব নিতেও পিছু পা হয়েছিল তোমার জন্য।
এই সন্তান এর দায়িত্ব যে কেউ নেইনি মা । বাপ মা হারা এই বাচ্চাটার জীবনে, প্রথম বার তুমি রঙ দিয়ে রাঙিয়ে দিয়েছো। নেবে ওর দায়িত্ব ? দেবে ওকে বসন্তের ভালোবাসার দাম?…
গাড়ির সামনের সিটে বসে , বেশ আনন্দ পেয়েছে বসন্ত। হ্যাঁ , আজ থেকে ওর নতুন নাম ,বসন্ত। কারণ ওই আমার জীবনে ফিরিয়ে দিয়েছে ভালোবাসার রঙ… না না ! বসন্তের ভালোবাসার রঙ…
এভাবেই বসন্ত যেন রাঙিয়ে দেয় প্রতিটা মানুষের মন, পুনরায় যেন সব হারানো মানুষ গুলো , ফিরে পায় নতুন কোনো বসন্তকে একবার হলেও যেন তাদের মন গেয়ে ওঠে-
“রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও যাও গো এবার যাবার আগে–
তোমার আপন রাগে,
তোমার গোপন রাগে…”
গল্পের প্রতিচ্ছবি রচনায়-
গল্প পাঠাতে পারেন- charpatrablog@gmail.com -এ অথবা সরাসরি WhatsApp -এর মাধ্যমে এখানে ক্লিক করে।
সমস্ত কপিরাইট ছাড়পত্র দ্বারা সংরক্ষিত। গল্পটির ভিডিও বা অন্য কোনো মাধ্যমে অন্যত্র প্রকাশ আইন বিরুদ্ধ। ছাড়পত্র এর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণে বাধ্য হবে।
পড়ুনঃ-
দুটি ছোট ছোট ব্যর্থ প্রেমের গল্প
গভীর ভালোবাসার গল্প- ১ লা আষাঢ়
ছাড়পত্রের সমস্ত আপডেট পেতে পারেন-
ফেসবুক Group - গল্প Junction
ফেসবুক- ছাড়পত্র
টেলিগ্রাম- charpatraOfficial
WhatsApp Group- ছাড়পত্র (২)
সুন্দর ছোট্ট গল্প। বসন্ত নিয়ে গল্প। 1 awesome bengali short story
কি কেন কীভাবের উপর গড়ে ওঠা মানুষের জিজ্ঞাসু মন সর্বদাই নতুন দিগন্তের সন্ধানে পা বাড়ায় ৷ প্রতিটি পদক্ষেপেই নতুন কিছু অভিজ্ঞতা আমাদের ঝুলিতে জমা হয় ৷ সেই অভিজ্ঞতা সকলের সাথে ভাগ করে নেওয়ার মধ্যে এক অফুরন্ত আনন্দ লুকিয়ে থাকে ৷ আর সেই কাজেই হাত বাড়িয়েছে ছাড়পত্রের টিম।
ধন্যবাদ।।