মা নিয়ে গল্প। মায়ের স্নেহ প্রতিটি মেয়ের জীবনে কিছু স্বপ্ন থাকে, যেগুলি একান্তই তার নিজের। কিন্তু বেশিরভাগ সময় ডায়রির পাতায় লিখে রাখা সেই স্বপ্ন গুলি অপূর্ণ থেকেই যায়। আর একটা সময় পর সেই ডায়রির পাতা গুলিও ডায়রি থেকে ছিঁড়ে গিয়ে ছেড়া পাতার কালিমা লিপ্ত হয়।

মা নিয়ে গল্পঃ- ‘মায়ের ডায়রি’

বারেবারে একটা কথা বলো না মা , একবার যেটা না করেছি সেটা আর কিছুতেই হ্যাঁ হবে না। মেনে নেবো না আমি এইসব । বিয়ে আমি মরে গেলেও করবো না।

অপর্ণা দেবী মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন , মৃদু স্বরে বললেন ” বুকের বাম পাশ টা ভীষণ ব্যাথা করছে, আর থাকতে পারছি না “
পাশের ঘর থেকে তার একমাত্র মেয়ে স্নিগ্ধা শুনতে পেয়ে ছুট্টে এসে ,জলের বোতল থেকে জল খাইয়ে ইনহেলার টা দিয়ে বলে উঠলো ” কিছু হবে না মা ” একটু অপেক্ষা করো, আমি ব্যবস্থা করছি সব।

লাল বাতি জ্বালানো ওই অ্যাম্বুলেন্সে করে অপর্ণা দেবীকে নিয়ে যাওয়া হলো নার্সিংহোমে। ডাক্তার স্নিগ্ধাকে এসে বললো ” হার্ট অ্যাটাক হয়েছে ওনার “। আমরা আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম কিন্তু ওনার ভাগ্যটা বড্ডো ভালো তাই এই যাত্রায় রক্ষে পেয়ে গেলেন। তোমায় বলি মা শোনো, “মায়ের খেয়াল রাখবে , এমন কোনো কাজ করো না , যেটাতে উনি কষ্ট পান। খুব সাবধানে রাখবে। কোনো আঘাত যেন উনি না পান । ওনার অবস্থা কিন্তু মোটেও ভালো নেই।”

মা নিয়ে গল্প
মা নিয়ে গল্প

স্নিগ্ধার কপালে চিন্তার রেখা আরো প্রসারিত হলো । সে ভালো করেই জানে তার মায়ের চিন্তার আসল কারণ কি!

অপর্ণা দেবী সেই ছোট থেকে একা হাতে মেয়েকে বড়ো করে তুলেছেন। সাহায্য করার মতো তেমন কাউকে পাশে পাননি, তাই একা হাতে সবটা সামলাতে সামলাতে বেশ জেদী আর মেজাজি হয়ে উঠেছেন দিনদিন।

তবে স্নিগ্ধা অর্থাৎ তার মেয়ে , সে কিন্তু বেশ শান্ত দরাজ প্রকৃতির। খুব একটা বুদ্ধিমতী না হলেও , লেখালিখি আর ছবি আঁকাআঁকি তে, সে বেশ পারদর্শী। মায়ের এক্কেবারে বাধ্য মেয়ে। মায়ের কথাই তার কাছে গুরুবাক্য সমান। তবে তার জীবনেও কিছু স্বপ্ন আছে যেগুলো সে শুধু তার মা কে নিয়েই দেখতে চায়। কিন্তু অপর্ণা দেবীকে আশেপাশের কলোনির লোকেরা বেশ চাপে ফেলেছে , তাদের মতানুযায়ী এরম হাতের কাজে মেয়ের ভবিষ্যত অন্ধকার। তাই কোনো সু-পাত্র দেখে তার হাতেই মেয়ের জীবনের ডোর বেঁধে দেওয়া সমুচিত হবে।

প্রথম প্রথম লোকের কথায় পাত্তা না দিলেও , ধীরে ধীরে তার মনের পরিবর্তন ঘটে। বাকিদের মত তিনিও চান সু-পাত্র দেখে কন্যাদান করতে। এদিকে মেয়ে যতই মায়ের বাধ্য হোক , সে বিয়ে করতে নারাজ । তার একটাই কথা ” আমার বিয়ে দিয়ে দিলে , তোমায় কে দেখবে বলতো? আর তোমায় নিয়ে দেখা আমার স্বপ্ন গুলো পূরণ হবে কি করে ?”

পড়ুনঃ- বাবাকে নিয়ে একটি শিক্ষণীয় গল্প 

অপর্ণা দেবী , তার মেয়ের কথা হেসেই উড়িয়ে দেন। মেয়ের বয়স হলেও তার কথা বার্তা গুলোকে তিনি বাচ্চাসুলভই মনে করেন।

হাসপাতাল থেকে ফেরার পর স্নিগ্ধা বারেবারে তার মা কে বোঝাতে চায়, সে ছাড়া তাকে দেখার মতো কেউ নেই , তাই সে বিয়ে করবে না। কিন্তু অপর্ণা দেবী তার নিজের কথায় স্থির। তাই মেয়ের কাছে অসুস্থতার দোহাই দিয়ে কিছুটা জোরের ওপরেই বিয়ে দিয়ে দেন এক সরকারি, মোটা মাইনের কর্মচারী সু-পাত্রের সাথে। বয়সের তারতম্য থাকলেও মেয়ের ভবিষ্যত যাতে সুখের হয় তাই বিয়ে দিতে তার দ্বিধা জন্মেনি। স্নিগ্ধা ও মায়ের আনন্দের কথা ভেবে চুপচাপ সবটা সহ্য করে নেয়।

শশুর বাড়ী যাওয়ার পর তার অনেক দায়িত্ব বেড়ে যায়। পুরো সংসার যেন তার ওপরেই নির্ভরশীল। প্রথম প্রথম ভুল ত্রুটি হলেও , শান্ত স্নেহময়ী শাশুড়ি মায়ের আদরে আর শিক্ষায়, সে সবটা আয়ত্ত করে নেয়।

বিয়ের পরে মা কে বারেবারে কল করে খোঁজ নেওয়া , দেখতে যাওয়া সেই স্নিগ্ধা দিনদিন ব্যস্ত গৃহিণী হয়ে উঠে। দেখা করতে যাওয়া তো দূরের কথা , দিনে একবার কল করে খোঁজ নিতেও সে ভুলে যায়। এভাবেই মাসের পর মাস কাটতে থাকে , মা মেয়ের মধ্যেকার দূরত্বের প্রাচীরটাও বেশ বাড়তে থাকে।

মায়ের স্নেহ
মায়ের স্নেহ

স্নিগ্ধা কর্মনীপুন বাড়ির কর্ত্রী হয়ে ওঠায় পর তার জীবন অনেকটাই বদলে যায়। ছবি আঁকাআঁকি নিয়ে থাকা মেয়েটা এখন সারাদিন রান্না বান্না নিয়েই থাকে। আর আজ তার শাশুড়ি মায়ের জন্মদিন, সেই উপলক্ষে স্নিগ্ধার রান্নাঘর থেকে বেরোনোর একটুও সময় পায়নি। তাই ড্রয়িং রুমে রাখা ফোনটার প্রতিও তার খেয়াল ছিল না । সব সেরে ফোন টা হাতে নিতেই সে চমকে গেলো । সকাল থেকে বেশ কয়েকটা নম্বর থেকেই তার ফোন এসেছে। কিন্তু একটাও তোলা হয়নি।

প্রথমের নাম্বার টা তে কল ব্যাক করা মাত্রই, ওপার থেকে একটা কান্নার আওয়াজ শোনা গেলো। স্নিগ্ধা বারেবারে জিজ্ঞাসা করলেও ওপার থেকে তার কোনো প্রশ্নের উত্তর এলো না। কিছুটা অনুমানের ভিত্তিতেই সে সোজা নার্সিংহোমে উদেশ্যে রওনা দিলো। পৌঁছানোর পর আইসিইউ এর ভেতর দেখতে পেলো তার মায়ের নিথর শরীরটাকে।

স্নিগ্ধা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারলো না , তার মা আর তাদের মধ্যে নেই। এক ফোঁটা জল ও পড়লো না তার চোখ দিয়ে। সে ছুট্টে গেলো তার পুরনো বাড়িতে। ছন্নছাড়া হয়ে নিজের ডায়েরি টা খুঁজতে শুরু করলো । কিন্তু কোথাও পেলো না । শেষ মেষ নিজের মায়ের রুমে গিয়ে বিছানার ওপর একসাথে দুটো ডায়েরির অবস্থান দেখে থমকে গেলো।

ভয়ে কাপতে কাপতে গিয়ে তার মায়ের ডায়েরি টা হাতে তুলে নিলো। পরের পর পাতা উল্টে পড়তে লাগলো।

“মা তোর উদ্যেশ্যে কিছু বলার ছিল , কোনোদিন ডায়েরিটা পেলে পড়ে দেখিস , কেমন –
আজ থেকে এক বছর আগে , যখন তুই সদ্য গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে বললি, পেইন্টিং টাকেই নিজের পেশা বানাবি। তখন জানিস খুব খুশি হয়েছিলাম কিন্ত সেটার বহিঃপ্রকাশ করতে পারিনি। বিয়েটা ও তোর অনিচ্ছা তেই জোর করে দিয়ে দিলাম। তোর মতামতের কোনো মূল্যই দিলাম না। তাই হয়তো তুই আমায় ভুল বুঝেছিস। নিজে যে চাকরি পেয়েও ছেড়ে দিয়েছিস আমার কথা রাখতে, সেটাও একবারও জানাস নি। এত অভিমান কেন করলি মা ?

পড়ুনঃ- ভাই-বোনের ভালবাসা 

জানি না আর কতদিন আমার পরমায়ু , তবে তোর ডায়েরি টা পড়ে নিজেকে ভীষণ পাপী মনে হচ্ছে । বুকের বাম পাশ টাও ভীষণ ব্যাথা করছে। যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে মনের কথা গুলো জানতেও পারবি না। তাই সবটা আমি ডায়েরি তে লিখে যাচ্ছি। সবটা জানা যে তোর বড্ডো দরকার।

জানিস মাঝে মধ্যে শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ত , বারেবারে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যেতাম। কেমন যেন একটা আড়ষ্টতা শরীরটাকে ঘিরে ফেলত। প্রথম প্রথম বিষয় গুলোকে একেবারে পাত্তা দিতাম না । আর তুই যাতে বেকার চিন্তা করে নিজের ভবিষ্যত নষ্ট না করিস তাই কিছু বলতাম না। কিন্তু একদিন বাজারে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাওয়ার পর সেখানের লোকজন হাসপাতালে ভর্তি করেছিল , তখন জানতে পেরেছিলাম হার্ট এর অবস্থা খুব খারাপ । ডাক্তার বলেছিল পরমায়ু নাকি সীমিত কয়েক মাস।

তাই এসব বিষয় থেকে তোকে দূরে সরিয়ে, একটা সুন্দর ভবিষ্যত উপহার দেওয়ার জন্যই, তোর বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। আর দেখ যেটা ভেবেছিলাম সেটাই হয়েছে , তুই সবাইকে নিয়ে বেশ আনন্দে, সুখে সংসার করছিস। জামাই ও হয়েছে মনের মত । আর কি চাই মা বল! তোর হাসি মুখটাই তো আমার জীবনের উৎস… আর লিখতে পারছি না , ব্যাথা টা খুব বাড়ছে। ভালো থাকিস মা , সুখে থাকিস। আর আমায় নিয়ে নাইবা পারলি , ওদের নিয়ে তোর সব স্বপ্ন গুলো পূরণ করিস।

অপর্ণা দেবীর তার মেয়েকে নিয়ে দেখা সুখের সংসার করার স্বপ্নটা ক্ষণিকের মত আসা ঘূর্ণি ঝড়ের ন্যায় তার মৃত্যুতে ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়। ডায়রিটা পড়ার পর অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল স্নিগ্ধা। জ্ঞান ফেরার পর একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। এক ফোঁটা জল ও তার চোখ দিয়ে পড়েনি। ধীরে ধীরে নিস্তব্ধ থাকতে থাকতে সে কেমন বদলে যেতে লাগলো। কোনো কিছুই আর বোধগম্য হতো না ওর। হুটহাট বাড়ির বাইরে বেরিয়ে যেতো , বাচ্চাদের মত মা মা করে কেঁদে বেড়াতো রাস্তায় রাস্তায়। এইসব বিষয়গুলো তার শশুর বাড়িতে কেউ মেনে নিতে পারেনি তাই এক সময়ের সুদক্ষ গৃহিণী আজ তাদের কাছে বোঝা স্বরূপ। তাই শেষমেশ সবার পরামর্শে ওর স্বামী ওকে ব্যাঙ্গালোর মেন্টাল হাসপাতালে রেখে দিয়ে এলো।

bengali sad story of mother and daughter
bengali sad story of mother and daughter
<

অপর্ণা দেবীর দেখা স্বপ্ন গুলো , স্বপ্নই রয়ে গেলো , যে পথে তিনি নিজে মুক্তি পেলেন সেই পথেই তার মেয়ের জীবন থমকে রয়ে গেলো। তাড়াহুড়োর মধ্যে নেওয়া একটা সিদ্ধান্তে দুটো জীবন শেষ হয়ে গেলো। সেদিন বিয়ে না দিলে হয়তো অপর্ণা দেবীর পরমায়ু আরো কিছুদিন বাড়ত। মেয়েটাও নিজেকে অপরাধী ভাবতে ভাবতে এভাবে পাগল হয়ে যেত না। সময় টা অল্প হলেও, হয়তো তাকে নিয়ে দেখা স্বপ্ন গুলো স্নিগ্ধা পূরণ করেই ছাড়ত।

অবাধ স্বাধীনতা স্বৈরচারিতার প্রধান কারণ হলেও। যতটা স্বাধীনতায় একটা মেয়ে খোলা প্রশ্বাস নিয়ে বাঁচতে পারে ততটুকু অন্তত দেওয়া উচিত। দিন না আপনারাও মেয়েদের ডানা, তারাও যে উঁচু উড়ান ভরতে পারে তার প্রমাণ দিক। সব মেয়ের জীবনের মূল লক্ষ্য বিয়ে করাই হয়না, কেউ কেউ অন্য পুরুষ নয় , নিজের মা বাবাকেও সারাজীবন পাশে নিয়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখে, ঠিক স্নিগ্ধার মত…।।

আলোরানি মিশ্র

গল্পের সুন্দর ভাবনায়-
সমস্ত কপিরাইট ছাড়পত্র দ্বারা সংরক্ষিত। গল্পটির ভিডিও  বা অডিও বা অন্য কোনো মাধ্যমে অন্যত্র প্রকাশ আইন বিরুদ্ধ। ছাড়পত্র এর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণে বাধ্য হবে।
গল্প পাঠাতে পারেন- charpatrablog@gmail.com -এ অথবা সরাসরি WhatsApp -এর মাধ্যমে এখানে ক্লিক করে। 

পড়ুনঃ- 
ব্যর্থ প্রেমের শেষ কথা 

মা এক অপ্রকাশ্য ভালবাসা 
আমাদের সাথে যুক্ত হবেন যেভাবে- 

ফেসবুক Group - গল্প Junction 

ফেসবুক- ছাড়পত্র

টেলিগ্রাম- charpatraOfficial

WhatsApp Group- ছাড়পত্র (২)

মা নিয়ে গল্প। মায়ের স্নেহ। bengali sad story of mother and daughter

Spread the love

Leave a Reply