জন্ম বার্ষিকীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিয়ে কিছু কথা হবে না, তা কই কখনো হয়? বিশ্ব কবি যে বিশ্ব মানবতার প্রতীক তা নিয়েই একটি লেখা থাকছে আজ। কলমে রয়েছেন- মানব মণ্ডল।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিয়ে কিছু কথা বিশ্ব কবি বিশ্বমানবতার প্রতীক:-

প্রত্যেক সৃষ্টিকর্মে প্রতিফলিত হয় স্রষ্টার মনের ভাবনা, চিন্তা দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গি। যিনি নাস্তিক, তার সৃষ্টিকর্মে  নাস্তিক্য চিন্তা-চেতনার প্রকাশ ঘটে। যিনি আস্তিক, তার সৃষ্টিকর্মেও স্বভাবতই তার আস্তিক্য ভাব-দর্শনের প্রতিফলন ঘটে ।

প্রসঙ্গত রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন। রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষগণ উচ্চবর্ণীয় হিন্দু ব্রাহ্মণ ছিলেন। তবে রবীন্দ্রনাথের ধর্ম-বিশ্বাস সম্পর্কে নিশ্চিত ধারণা লাভ করা সম্ভব নয়। বিশ্বকবিকে অনেক খানি উদার দেখি আমরা। তিনি জীবনের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অনেকটা উদার দৃষ্টিতে গ্রহণ-বর্জনের করছেণ। তাঁর মানস-জগতে ও ধর্ম-বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন ঘটেছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫) নিষ্ঠাবান ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন। জমিদারী দেখাশুনার পাশাপাশি তিনি ধর্ম ও সমাজ-সংস্কৃতি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতেন। ব্রাহ্মধর্মের প্রতিষ্ঠাতা রাজা রামমোহন রায়ের (১৭৭২-১৮৩৩) ঘনিষ্ঠ হয়ে হিন্দুধর্ম সম্পর্কে তাঁর ধারণা বদলে যায় , তিনি হয়ে উঠেন ব্রাহ্মধর্মের অনুসারী ।

বাংলা, সংস্কৃত, ইংরেজি, ভাষায়  সুপন্ডিত ছিলেন রামহোমন রায়। ইংরেজি শিক্ষা-সভ্যতা ও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোকে তাঁর মানসিক চরিত্র পরিবর্তন হয় । খ্রিষ্টান পাদ্রিদের  প্রভাবে অনেক হিন্দু বিশেষত ইংরেজি শিক্ষিত মহাকবি মাইকেল মধুসুদন দত্তের মত  আধুনিক যুবকরা অনেকেই খ্রিষ্টান হয়ে যান।  আধুনিক ইংরেজি শিক্ষিত যুবকদেরকে ধর্মত্যাগে বিরত রাখার জন্য রামমোহন হিন্দুধর্মের সংস্কার করেছিলেন। মহাপ্রভু চৈতন্যের মত হিন্দুদের একেশ্বরবাদ পথে চলা শুরু হয় এখান থেকেই। এই সময় খ্রিষ্টানধর্ম সম্পর্কেও জ্ঞান লাভের চেষ্টা করেন যুব সমাজ। 

ব্রজেন্দ্রনাথের ভাষায় “এই সংশয় প্রথমে মুসলমানি বিদ্যার দ্বারা অনুপ্রাণিত হইয়াছিল, পরে ইংরেজ প্রভাবে ইহা পূর্ণ বিকশিত হইতে প্রায় পনের বছর লাগিয়াছিল।” রামমোহন রায় ব্রাহ্মমতের প্রবর্তন করেন। ব্রাহ্মমতে কোনো মূর্তিপূজা নেই যাকে অনেক ইসলামী প্রভাব বলে দাবি করেন। ব্রাহ্মমতের ভিত্তি স্থাপিত, জ্ঞান-ভিত্তিক, যুক্তি-ভিত্তিক আধুনিক বিজ্ঞানমনষ্ক চিন্তাধারার ভিত্তিতে। শিক্ষিত জ্ঞানী-গুণী হিন্দুগণ এ মতের অনুসরণ করেন। রামমোহন কোনো ধর্ম মন্দির স্থাপন না করলেও দেবেন্দ্রনাথ স্বগৃহে ব্রাহ্মমন্দির স্থাপন করেন এবং সেখানে নিয়মিত প্রার্থণা আর ব্রহ্ম সঙ্গীত গাওয়া হতো।

পড়ুনঃ- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন এর সঙ্গে যুক্ত গল্প। রবীন্দ্রনাথের মজার ঘটনা

60+ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষামূলক বাণী

রবীন্দ্রনাথের খুড়তুতো ভাই গুণেন্দ্রনাথ ব্রহ্মসঙ্গীত রচনা করতেন এবং সকলেই তা ভক্তিভরে গাইতেন ও শুনতেন। রবীন্দ্রনাথ ছেলেবেলা থেকেই এই ধরনের পরিবেশে বড় হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের মানস গঠিত হয় পিতা দেবেন্দ্রনাথের আদর্শে। রবীন্দ্রনাথ নিজেই তাঁর পিতা সম্পর্কে বলেছেন- “ছোটো হইতে বড়ো পর্যন্ত পিতৃদেবের সমস্ত কল্পনা এবং কাজ অত্যন্ত যথাযথ ছিল। হিমালয় যাত্রায় তাঁহার কাছে যতদিন ছিলাম একদিকে আমার প্রচুর পরিমাণে স্বাধীনতা ছিল, অন্যদিকে সমস্ত আচরণ অলঙ্ঘনরূপে নির্দিষ্ট ছিল। ভুল করিব বলিয়া তিনি ভয় পান নাই, কষ্ট পাইব বলিয়া তিনি উদ্বিগ্ন হন নাই। তিনি আমাদের সম্মুখে জীবনের আদর্শ ধরিয়াছিলেন কিন্তু শাসনের দন্দ উদ্যত করেন নাই।”

দেবেন্দ্রনাথের জীবনকালে তাঁর পরিবারের উপর ব্রাহ্মধর্মের আধিপত্য ছিলো। ক্রমান্বয়ে ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রভাব বিলুপ্ত হওয়ায় ব্রাহ্মণ্যসমাজেও মতভেদ সৃষ্টি হয় এবং কেশবচন্দ্র আলদা ব্রহ্মমন্দির স্থাপন করেন। এইসময় যুবক রবীন্দ্রনাথ আদি সমাজের সেক্রেটারি পদে নিযুক্ত হন। এদিকে ‘সাহিত্য সম্রাট’ ও হিন্দু সমাজে ‘ঋষি’ হিসাবে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৩৮-৯৪) জামাই রাখালচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় (১৮২৭-৮৯) সম্পাদিত “প্রচার” এবং অক্ষয়চন্দ্র সরকার (১৮৪৬-১৯১৭)-এর সম্পাদনায় ‘নবজীবন’ ও  নামে দু’টি পত্রিকা প্রকাশিত হওয়া শুরু হল।

বঙ্কিমচন্দ্র এই দু’টি পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় ব্রাহ্মধর্মের বিরুদ্ধে ‘ধর্ম জিজ্ঞাসা’ ও ‘হিন্দু ধর্ম’ শীর্ষক দু’টি প্রবন্ধ লেখেন। ফলে ব্রাহ্মধর্মের প্রচারকগণ কিছুটা হতবল হয়ে পড়ল। সে সময় যুবক রবীন্দ্রনাথ তাঁর রচিত ‘হাস্য-কৌতুক’, ‘স্বপ্ন মঙ্গলের কথা’ ও ‘হিং টিং ছট্’ ব্যঙ্গ কবিতার মাধ্যমে কঠোরভাবে এর জবাব দিলেন। এর মাধ্যমে সহজেই বোঝা যায়, রবীন্দ্রনাথ তাঁর পিতার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ব্রাহ্মধর্মের একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। রামমোহনকে তিনি হিন্দু নবজাগরণের ‘প্রাণপুরুষ’ বলে প্রচার করেন। কিন্তু পরে ব্রাহ্ম ধর্ম অস্তিত্বহীন হয়ে পরে। তখন রবীন্দ্রনাথও তখন ধীরে ধীরে  ব্রাহ্মণ্যধর্ম  মেনে নেন। তাই তার শেষ জীবনের ভ্রমণ কাহিনী গুলোতে হিন্দু ধর্মের লঘু প্রভাব ছিল। এর সাথে সুফিবাদ এবং পূর্ব বাংলার বাউল মতাদর্শ তাঁকে বিশেষভাবে আকর্ষিত করে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিয়ে কিছু কথা rabindra nath tagore
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিয়ে কিছু কথা rabindra nath tagore

দেবেন্দ্রনাথ ফারসি কবি রুমী, হাফিজ প্রমুখের  ভক্ত ছিলেন, এবং নিজে ছেলেদেরকে ফারসি ভাষা শিক্ষাদানের জন্য তিনি বাড়িতে ফারসি মুন্সী নিয়োগ করেছিলেন। পরিবার পরিপার্শ্বেও ফারসি সাহিত্য ও সুফিবাদ রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিক চিন্তায়ও সুফিবাদের ঘনিষ্ঠ প্রভাব দেখা যায়। তাঁর রচিত বিভিন্ন কাব্য-কবিতায় বিশেষত শেষদিকের রচনাগুলিতে এ প্রভাব স্পষ্টভাবে দেখা যায় । রবীন্দ্রনাথের রচনায় উদারতা এবং মানবতার আসে বৈষ্ণবদের প্রভাবে।

১৮৯০ সালে রবীন্দ্রনাথ প্রথম জমিদারি কাজে কুষ্টিয়া শিলাইদহে গিয়ে বাউল সম্রাট লালন শাহ (১৭৭২-১৮৯০) ও গগণ হরকরার (১৮৪৫-১৯১০) দেখা করেন।  তাঁর জীবনের মননে, দর্শনেও পরিবর্তন আসে এই সময়। সৃষ্টিতত্ত্ব দেহতত্ত্ব, আধ্যাত্মচেতনা ও গভীর জীবন জিজ্ঞাসামূলক বাউল গানে প্রতিফলিত জীবনদর্শন কবির জীবন-চৈতন্যকে, অন্তরকে গভীরভাবে ছুঁয়ে যায়।

রবীন্দ্রনাথের লেখায় চিন্তা-চেতনায় বাউল মতবাদের প্রভাব দেখা যায় । এর প্রভাব তাঁর রচিত ‘মানুষের ধর্ম’ গ্রন্থে দেখা যায়। কিন্তু এ সম্পর্কে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ডক্টর এবনে গোলাম সামাদে বলেন “রবীন্দ্রনাথের ‘মানুষের ধর্ম’ নামক বইটির ইতিহাস আমাদের অনেকেরই জানা নেই। এটা লিখিত হয় রবীন্দ্রনাথ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৩০ সালে যে ‘হিবার্ট লেকচার’ দেন, তার ভিত্তিতে। বইটি ১৯৩১ সালে প্রকাশিত হয় ইংরেজি ভাষায় নামে লন্ডন থেকে।

রবীন্দ্রনাথ এতে বলেন, বাংলার বাউলদের ধর্ম হলো মানবধর্ম। কেননা তারা কোনো প্রথাগত ধর্মে বিশ্বাস করে না। সবাই বাউল হতে পারে। বাউল হতে কারো বাধা নেই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের এই কথা যথেষ্ট বস্তুনিষ্ঠ নয়। কেননা, বাউলরা হলেন খুবই গুরুবাদী। তারা মনে করেন, কেবল গুরুর কাছ থেকেই শেখা সম্ভব প্রকৃত আরাধনা পদ্ধতি। যার মাধ্যমে আসতে পারে মানবাত্মার মুক্তি। বাউলদের মধ্যে আছে বিভিন্ন গুরুর শিষ্য। আছে চিন্তার ভেদ। তাই তাদের বলা চলে না, অসাম্প্রদায়িক। বাউলরা খুবই গঞ্জিকাসেবী। এরা যাপন করে শিথিল যৌন-জীবন। পালন করতে চান না, গার্হস্থ্য-ধর্ম। চান না সন্তান-সন্ততির দায়িত্ব নিতে।

পড়ুনঃ- সাহসিকতার গল্প। ধৈর্যের গল্প

রবীন্দ্রনাথ এর আগে অনেক লেখায় বৈরাগ্যের বিরোধিতা করেছেন। কিন্তু মানুষের ধর্ম বইতে প্রশংসা করেছেন বাউলদের; যারা হলেন বৈরাগ্যবাদী। তিনি মানুষের ধর্মে এটা কেন করেছেন, সেটার ব্যাখ্যা করা কঠিন। তবে ক্ষিতিমোহন সেন (১৮৮০-১৯৬০) দাবি করেছেন, মানুষের ধর্ম বইতে বাউল সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ যা বলেছেন, সেই অংশটি লিখেছিলেন তিনি, রবীন্দ্রনাথ নন। ক্ষিতিমোহন সেন ছিলেন বিশ্বভারতীর একজন খ্যাতিমান অধ্যাপক। তাঁর খ্যাতির একটি কারণ হলো, ভারতীয় মরমীবাদী চিন্তার ওপর গবেষণা।

যা এখন রবীন্দ্রচিন্তা বলে প্রচার করা হচ্ছে, তা আসলে হলো ক্ষিতিমোহন সেনের চিন্তা। অবশ্য এক দিক থেকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বাউলদের মিল খুঁজে পাওয়া যায়, বাউলরা খুবই গুরুবাদী। আর রবীন্দনাথও চেয়েছেন কবিগুরু হতে। বিশ্বে আরকোনো কবি সম্ভবত এ রকম কবিগুরু হতে চাননি। তারা কেবলই চেয়েছেন কবি হতে।” (ডক্টর এবনে গোলাম সামাদ : রবীন্দ্রনাথ ও বাংলাভাষী মুসলমান সমাজ, দৈনিক নয়াদিগন্ত, ১৩ মে ২০১৭)

রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বাংলার কিছু মানুষের মাথা ব্যথার কারণ টা তাহলে বোধহয় এখন স্পষ্ট হল। দুই বাংলায় রবীন্দ্রনাথ বিরোধী মানুষ আছে তাদের একটা পরিচয় তার হিন্দু বা মুসলমান নয় তাঁরা মানবতা বিরোধী। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পান। নোবেল পুরস্কার লাভের পূর্বে রবীন্দ্রনাথ ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য বিলাতে গিয়েছিলেন। তবে তিনি পড়া শেষ না করেই দেশে ফিরে আসেন। নোবেল পুরস্কার লাভের পর সারা তিনি ইউরোপ, আমেরিকা, চীন, জাপানসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিয়ে কিছু কথা

হেগেল, ফ্রয়েড, এঙ্গেলস, কার্লমার্কস প্রমুখ আধুনিক চিন্তানায়ক ও দার্শনিকদের যুগান্তকারী চিন্তা-চেতনার  প্রভাবিত রবীন্দ্রনাথ নতুন করে নিজেকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করেন। এটাই তার অপরাধ। একটি পত্রিকাতে রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে লেখা হচ্ছে – ” তিনি জন্মসূত্রে উচ্চবর্ণীয় হিন্দু, তাঁর স্ব-সমাজের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হিন্দু, সেই হিসাবে নিজের আত্মপ্রতিষ্ঠা এবং ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তিনি সম্ভবত পূর্বপুরুষদের সনাতন আদর্শ-ঐতিহ্যের অনুসারী হিসাবে আত্মপরিচয় দেওয়াই নিরাপদ ও যুক্তিযুক্ত মনে করেন।

তাই দেখা যায়, বিপুল জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও গভীর মানবিক বোধসম্পন্ন অনুভূতিপ্রবণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরবর্তীকালে নিজেকে একজন খাঁটি হিন্দু বলে পরিচয় দিতে গৌরববোধ করেছেন। তবে ইতোপূর্বে তাঁর বিশ্বাস ও আচরণে ব্রাহ্মধর্মের যে ছাপ লেগে গিয়েছিল, সেটাকেও তিনি সম্পূর্ণ বর্জন করেননি। বরং হিন্দুধর্ম ও ব্রাহ্মধর্ম যে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত অথবা সনাতন হিন্দুধর্মের আধুনিক সংস্করণ হলো ব্রাহ্মধর্ম, প্রকারান্তরে এটাই যেন তিনি বলতে চেয়েছেন।”

ইসালাম মৌলবাদ এর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, খিলাফত কিংবা ওহাবী মতবাদ যখন ইসলামধর্মমুখী করতে চাইছেন, তখন বিবেকানন্দ রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এর মত মানুষরা, ধর্ম এর সংস্কার ভেঙে ফেলতে চাইছেন, মানবতা আর মানব সেবা কে ধর্ম বলে ব্যাখা দিতে চাইছেন।

রবীন্দ্রনাথের হিন্দুত্ব সম্পর্কে পরমেশ চৌধুরী বলেন : “বিশ্বমানবতা, আন্তর্জাতিকবাদ অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি এসব কিছুর মূলই রবীন্দ্রনাথের হিন্দুত্ব। আধুনিক রবীন্দ্রসমালোচকদের অনেকেই রবীন্দ্রনাথের আন্তর্জাতিকতা, বিশ্বমানবতা, ধর্মনিরপেক্ষ মনোভাব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এ-কথাটা ভুলে যান যে হিন্দুত্বই তাঁর ‘প্রতিষ্ঠাভূমি’ তিনি কোন নূতন মতবাদ, নূতন কোন আদর্শ প্রচার করতে চাননি। চিরন্তন হিন্দুত্বের আদর্শ বা ভারতীয় আদর্শগুলোর পুনর্জাগরণই চেয়েছিলেন তিনি, এবং নাটকে, গানে, প্রবন্ধে কবিতায় প্রচার করে যাবার চেষ্টা করেছেন যথাসাধ্য। এসব কথা যে মনগড়া নয় তা ‘আত্মপরিচয়’ প্রবন্ধটি পড়লেই উপলদ্ধি করতে পারবেন জিজ্ঞাসু পাঠক।” (দ্রষ্টব্য : ঐ, পৃ. ১৫)।

শান্তি নিকেতনে স্কুল প্রতিষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথের প্রচেষ্টাও তাই কিছু মানুষের কাছে, প্রাচীন কালের গুরুগৃহ বাসের মত সমস্ত নিয়ম বলে মনে হয়েছিল। ছাত্র অবস্থায় ধনী-দরিদ্র সকলেই কঠিন ব্রহ্মচর্য্যে গ্রহণ করা কথা, ছেলেবেলা হইতে ব্রহ্মচর্য্য শিখিয়ে প্রকৃত হিন্দু করা ফাদ মনে হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গ্রন্থে বলেছিলেন “আমি ভারতীয় ব্রহ্মচর্য্যরে প্রাচীন আদর্শে আমার ছাত্রদিগকে নির্জনে নিরুদ্বেগে পবিত্র নির্মলভাবে মানুষ করিয়া তুলিতে চাই। বিদেশী মেচ্ছতাকে বরণ করা অপেক্ষা মৃত্যু শ্রেয়, ইহা হৃদয়ে গাঁথিয়া রাখিও।”

উপরোক্ত উক্তি থেকে সুস্পষ্ট হয় যে, রবীন্দ্রনাথ প্রাচীন ভারতের ব্রহ্মচর্য ও তপোবনের আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন এবং সে আদর্শে নতুন প্রজন্মের তরুণদেরকে গড়ে তোলার কাজে সচেষ্ট ছিলেন। তাঁর উপরোক্ত মন্তব্যে কে বিকৃত করে বলা হয়, তিনি ভারতীয় মুসলিমদেরকে ‘বিদেশী’ এবং ‘ মেচ্ছ’ বলে উল্লেখ করেছেন। মানবতাবাদী উদারচিত্ত রবীন্দ্রনাথ মুসলিমদেরকে তুচ্ছাত্বকভাবে ‘মেচ্ছ’ বলে মনে করেননি। অন্তত ভারতের জাতীয় সঙ্গীত সে কথা বলে দেয়।

মুক্ত-চিন্তার অধিকারী কাজী আব্দুল ওদুদ (১৮৯৪-১৯৭০) বলেন “রবীন্দ্রনাথের জন্ম এক মহৎ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হিন্দুধর্মের সংস্কারকের পুত্ররূপে। পিতার ব্যক্তিত্ব চিরদিন তাঁর অন্তরে জাগিয়েছে সম্ভ্রম আর প্রেরণা। …রবীন্দ্রনাথের স্বাভাবিক নিসর্গপ্রীতি আর বঙ্কিমের প্রবর্তিত চিন্তাধারার প্রতি আহৃত বিরূপতা হয়ত নিরূপিত করেছিল তাঁর প্রতিভার গতিপথ। পরবর্তীকালে অবশ্য এমন সময় রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় এসেছিল, যখন প্রায় বঙ্কিমের ধরনের হিন্দু জাতীয়তাবাদী তিনি হয়ে পড়েছিলেন।”(কাজী আব্দুল ওদুদ : শাশ্বত বঙ্গ, পৃ. ৭৩)।

রবীন্দ্রনাথ মত প্রতিভা ইসলাম ও হিন্দু মৌলবাদী জন্য রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ ছিলেন। ঊর্দু ও হিন্দি ভাষা দ্বন্দ সমাধানে ব্যর্থ গান্ধী, বঙ্গ ভঙ্গের প্রস্তাব গৃহীত। বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় রবীন্দ্রনাথ, তার রাখি বন্ধন উৎসব। বাঙালি ধর্ম আচার গুলোকে সামাজিক উৎসবে পরিণত করতে শিখেছে রবীন্দ্রনাথ, নজরুলদের থেকে। তাই আজ উগ্র মৌলবাদীর কাছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। হিন্দুধর্মের মাহাত্ম্য বর্ণনায় রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অকুণ্ঠ। এটা দোষের কিছু নয়, যে কেউ তার ধর্মে আস্থাশীল হয়ে স্বধর্মের মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে পারেন। কিন্তু কেউ যদি স্বধর্মের মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে গিয়ে অন্য ধর্মকে হেয় প্রতিপন্ন করে এবং বিধর্মীর প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশ করেনি।কখনো  হেয় প্রতিপন্ন করে, বিধর্মীর প্রতি বিদ্বেষ উদ্গীরণ করেনি কখনো।

নীরোদ চৌধুরী (১৮৯৭-১৯৯৯) লিখেছেন, “রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ সবাই জীবনব্যাপী সাধনা করেছেন হিন্দু ও ইউরোপীয় চিন্তাধারার সমন্বয় সাধনের জন্য। মুসলমানদের চিন্তাচেতনা, ভাবধারা, ঐতিহ্য কখনোই তাঁদের স্পর্শ করেনি। ” তার একটি কারণ ইসলামী শাসন পতনের সময়েই ইংরেজি শাসন প্রতিষ্ঠা, মুসলিম শাসন থেকে মুক্তি পেয়ে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হতে যখন চেষ্টা করেছে হিন্দুরা, তখন শুধুই ধর্মকে অস্ত্র করে, মুসলিমরা ইংরেজ বিরোধী তাও করেছে। বাঁশেরকেল্লা থেকে সিপাহী বিদ্রোহ সব কিছু তেই ইসলাম ধর্মলম্বীদের স্বার্থ আঘাতই ঘটেছে তাই তারা লড়াই করছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিয়ে কিছু কথা rabindra nath tagore
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর rabindra nath tagore
<

ইংরেজদের বা খ্রীষ্ট ধর্মের প্রতি বিদ্বেষী মন আধুনিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যখন শিক্ষা গ্রহণ করেছে, তখন তারা অনেক পিছিয়ে পরেছে, তাই নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে, দেশভাগের ষড়যন্ত্র শামিল হয়েছেন ধর্মান্ধদের জন্য, এবং যে কোনো মহৎ চেষ্টা কে অসন্মানিত করেছে। “জন-গন-মন” গানে কবিগুরু হিন্দু শক্তির উত্থান হিসেবে শিবাজীর গুণকীর্তন করেছেন বলে , অনেকে দাবি করেন তিনি হিন্দুদের কবি। সত্যি মারাঠাদের জয়গান শোনা গেছে তার কন্ঠে, সাথে দ্রাবিড়দের জয় গান শোনা যায় তার কন্ঠে। কবির কোনো ধর্ম হয় না। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে একজন হিন্দু ধর্ম প্রচারক বলে চিহ্নিত করার চেষ্টার কঠোর বিরোধীতাও করা উচিত। তিনি বিশ্ব মানবতার প্রতীক।

কলমে- মানব মণ্ডল facebook

আমরা এখন ফেসবুকেও- গল্প আর গল্প

“রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিয়ে কিছু কথা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্ব কবি বিশ্বমানবতার প্রতীক”

Spread the love

Leave a Reply