বেশ কিছু গল্প উঁহু সাধারণ নয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন এর সঙ্গে যুক্ত গল্প নিয়েই আজকের আয়োজন। রবীন্দ্র জন্ম বার্ষিকীতে কবিগুরুর জীবনের সঙ্গে যুক্ত একটি বিশেষ ঘটনা এবং তাঁর জীবনের সঙ্গে যুক্ত কিছু মজার ঘটনা থাকছে আজ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন এর সঙ্গে যুক্ত গল্প- “আমি তোমাদেরই লোক” :-
বিশ্বের বিস্ময় জাতির গৌরব, বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ভারতের তিনি গুরুদেব। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মহাজীবনের পড়তে পড়তে তাঁর সৃষ্টির কল্প কাহিনী ছড়িয়ে আছে বিশ্বময়। রবীন্দ্রনাথের প্রতিটি সৃষ্টির উৎস তাঁর জীবন। তাঁর সৃষ্টি তাঁর জীবন থেকেই নেওয়া। সেই সৃষ্টির রহস্য ভেদও করা যায় তাঁর জীবনী থেকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কোনো সৃষ্টিই তাঁর জীবন থেকে আলাদা নয়।
তখন তিনি সবে একরকম বাধ্য হয়েই জমিদারী দেখা-শোনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। সালটা ছিল ১৮৯১, তিরিশ বছরের সুদর্শন যুবক নতুন জমিদার হয়ে পুণ্যাহ উৎসবে যোগ দিতে গেলেন শিলাইদহ। নতুন জমিদারের আগমন বলে কথা। বন্দুকের আওয়াজ, রোশন চৌকি, উলুধ্বনি, শঙ্খধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠল কাছারি। ধুতি পাঞ্জাবি আর চাঁদর পরিহিত শান্ত সৌম দেবদূতের ন্যায় এক মূর্তি এসে দাঁড়াল সকলের সামনে।
প্রথামত প্রথমে ব্রাহ্ম সমাজের আচার্যের প্রার্থনা হলো। তার পর হিন্দু মতে পূজা এবং পূজা শেষে নতুন জমিদারের কপালে পুরোহিত পরিয়ে দিলেন চন্দনের তিলক। এরই মধ্যে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি গিয়ে পড়লো বসার আয়োজন স্থলে, তিনি বেশ বিরক্ত বোধ করলেন এবং আয়োজকদের সরাসরি বলে বসলেন “এভাবে পু্ণ্যাহ উৎসব চলবে না। পুণ্যাহ উৎসব বিভেদের দিন নয়, মিলনের দিন, কিন্তু এখানে তো দেখছি বিপরীত ব্যবস্থা।” গোমস্তা নায়েবরা পড়লেন মুশকিলে, “এ কি বলেন নতুন বাবু মশাই ? এমন আয়োজনই তো চিরকাল হয়ে এসেছে । নতুন কিছু তো হয়নি।”
রবীন্দ্রনাথ তাদের বললেন “প্রজাদের বসার ব্যবস্থার মধ্যে জাতিভেদ আর ধর্ম ভেদ কেনো?” এ তিনি কিছুতেই মানবেন না। গো ধরে বসলেন এই ব্যবস্থার পরিবর্তন না ঘটালে এই পুণ্যাহ উৎসব হবে না। আর হলেও তিনি থাকবেন না। তাঁদের জমিদারীর প্রজাদের মধ্যে হিন্দু মুসলমান উভয় ধর্মের প্রজা ছিলেন। এর মধ্যে ৮০ ভাগ প্রজা আবার মুসলমান। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের আমল থেকেই এই, পুণ্যাহ উৎসবে জমিদারের উপস্থিতিতে প্রজাদের বসার ব্যবস্থা এভাবেই হয়ে আসছে।
হিন্দুরা সাদা চাদরে ঢাকা সতরঞ্চীর ওপর একধারে। তারমধ্যে ব্রাহ্মনের বসার স্থান আলাদা। চাঁদর ছাড়া শুধু সতরঞ্চীর ওপর অন্যধারে বসার ব্যবস্থা মুসলমান প্রজাদের। সদর ও অন্যান্য কাছারি থেকে আসা কর্মচারী গন নিজের নিজের পদ মর্যাদা অনুযায়ী তাদের নির্দিষ্ট স্থানে বসেন। আর জমিদার বাবু মশাই বসেন মখমলমোড়া সিংহাসনে। বরণের পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এভাবেই বসার কথা। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বসলেন না প্রথামত। বিরক্তি সহ নায়েবকে বললেন এই বিভেদ প্রথা আর চলবে না। ক্রদ্ধ স্বরে বললেন- “এই শুভ অনুষ্ঠানে এ জিনিস এখন থেকে আর চলবে না। সব আসন তুলে দিয়ে, হিন্দু- মুসলমান ব্রাহ্মণ – চন্ডাল সবাইকে এক ধরনের আসনে বসার ব্যবস্থা করতে হবে।” নায়েবে গোমস্তারা অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলেন বললেন, ‘ এই আনুষ্ঠানিক দরবারে পুরোনো রীতি বদল করার অধিকার কারও নেই।’
রবীন্দ্রনাথ বললেন “আমি বলছি এই পুরোনো রীতি তুলে দিতেই হবে। এ রাজ দরবার নয় মিলনানুষ্ঠন।” শেষ কথা বলে দিলেন’ বসার ব্যবস্থার মধ্যে জাতিভেদ প্রথা তুলে না দিলে তিনি কিছুতেই বসবেন না। “প্রাচীন প্রথা আমি বুঝিনা ,সবার জন্য এক আসন করতে হবে। জমিদার হিসেবে এই আমার প্রথম হুকুম।” অবস্থা চরমে পৌঁছে গেলো আমলারা হঠাৎ ঘোষণা করলেন। প্রথার পরিবর্তন ঘটালে তারা একসঙ্গে পদত্যাগ করবেন।
কিন্তু কোনো কিছুতেই রবীন্দ্রনাথকে টলানো গেলো না। তিনি নিজে উপস্থিত প্রজাদের বললেন, “আমার প্রিয় প্রজাগন
তোমরা নিজেরাই আলাদা আলাদা আসন ব্যবস্থা সরিয়ে দিয়ে এক সঙ্গে বসো। আমিও তোমাদের সঙ্গে বসবো। আমি তোমাদেরই লোক।” তখন উপস্থিত সব প্রজারা হল ঘর থেকে সব আলাদা আলাদা আসন সরিয়ে, ঢালাও ফরাশের ওপর বসলেন এবং সবার মাঝখানে গিয়ে বসলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রজারা মুগ্ধ হয়ে দেখলো তাদের নুতন জমিদার বাবু মশাই কে এবং অনুভব করলেন নতুন জমিদার বাবু মশাই প্রকৃত অর্থেই তাদের লোক ।
- কৃতজ্ঞতাঃ– “রবীন্দ্র জীবন কথা”,প্রভাত মুখোপাধ্যায় এবং “ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ”, অমিতাভ চোধুরী।
পড়ুনঃ- ঐতিহাসিক মজার ঘটনা
রবীন্দ্রনাথের মজার ঘটনাঃ- ১
সাহিত্যিক শ্রী বলাইচাঁদ, লোক মধ্যে তিনি বনফুল নামেই অধিক পরিচিত। তাঁর এক ছোট ভাই ছিল। তাঁর ছোট ভাই বিশ্বভারতীতে পড়াশোনা করার জন্য শান্তিনিকেতনে গমন করেন। তিনি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে অন্যদের কাছে বিস্তারিত জানছিলেন। তখনই কেউ একজন তাকে বলে যে, রবীন্দ্রনাথ কানে কম শোনেন। এরপর তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে যান। তাকে দেখে রবীন্দ্রনাথ মুচকি হেসে বললেন- “কী হে, তুমি কি বলাইয়ের ছোট ভাই কানাই নাকি?” তখন বলাইচাঁদ-এর ভাইয়ের মাথায় চলে আসে যে, রবীন্দ্রনাথ কানে কম শোনেন। তাই তিনি জোরে চেঁচিয়ে বললেন-“ আজ্ঞে না, আমি অরবিন্দ।“ রবীন্দ্রনাথ হেঁসে বলে উঠলেন- “ না কানাই নয়, এ যে দেখছি একেবারে শানাই।“
রবীন্দ্রনাথের লেখা- “আমি চিনি গো চিনি তোমারে, ওগো বিদেশিনী, তুমি থাকো সিন্ধুপারে….”গানটি আমরা সবাই শুনেছি। এই গানটির সঙ্গে একটি দারুন মজা লুকিয়ে রয়েছে। ইংল্যান্ডের মরিস সাহেব শান্তিনিকেতনে ইংরেজী এবং ফরাসি পড়াতেন। তিনি প্রায়ই রবীন্দ্রনাথের গান গুন গুন করতেন। একদিন তিনি তাঁর তৎকালীন ছাত্র প্রমথনাথ-কে ডেকে বললেন- “আমাদের গুরুদেব চিনির( তিনি খবার চিনির কথা ভেবেছিলেন) উপর একটি দারুন গান লিখিয়াছেন, গানটি দারুন মিষ্টি” এরপর তিনি গানটি গাওয়া শুরু করে দিলেন-“আমি চিনি গো চিনি তোমারে, ওগো বিদেশিনী, তুমি থাকো সিন্ধুপারে” এই কথাটি শুনে প্রমথনাথ মনে মনে হেঁসে বললেন- “চিনির গান তো মিষ্টি হবেই, কিন্তু এরকম ব্যাখ্যা আপনাকে কে দিয়েছে?” মরিস সাহেব বলে উঠলেন_ “স্বয়ং গুরুদেব আমাকে এই গানের ব্যাখ্যা দিয়াছেন”
রবীন্দ্রনাথের মজার ঘটনাঃ- ২
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বানান সংস্কারের জন্য একটা কমিটি গঠন করে দেওয়ার পড় সেই কমিটি বাংলা বানানের পুরানো রীতি পাল্টে নতুন বানান রীতি চালু করে। এই কমিটি এই কাজ করতে গিয়ে ‘গরু’ বানান নিয়ে সমস্যায় পড়ে। কমিটি ঠিক করে যে ‘গরু’ বানানটি গরু না লিখে ‘গোরু’ লেখা উচিত। কারণ শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃতের ‘গো’ শব্দ থেকে। আদিতে ‘ও’ কার, সেজন্য এখানেও ‘ও’ কার থাকা উচিত। কিন্তু সমস্যা হয়েছে, প্রায় সব বাংলাভাষী লেখক, ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক সবাই ‘ও’ কার ছাড়া গরু বানান লেখেন। কিন্তু কী করা যায়! কমিটির সিদ্ধান্ত হলো, এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের মত নেয়া দরকার। দেখা যাক, উনি কী বলেন। কমিটির প্রধান ছিলেন ভাষাবিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। তাঁর নেতৃত্বে কমিটির লোকজন চলল শান্তিনিকেতনে। সেখানে গিয়ে তাঁরা সাক্ষাত প্রার্থী হলেন কবির।
কবি সাক্ষাত দিলেন এবং তাদের আগমনের হেতু জানতে চাইলে তাঁকে বিষয়টি বোঝানো হলো। বলা হলো, আমরা আপনার মত জানতে এসেছি। রবীন্দ্রনাথ কথাটা শুনে মৃদু হেসে বললেন, “তা তোমাদের ও-কার দিয়ে গরু লেখার ব্যাপারে অন্তত একটা সুবিধাই হবে যে, আমাদের দেশের জীর্ণকায় হাড় জিরজিরে গরুগুলোকে অন্তত একটু মোটা ও তাজা দেখাবে!”
পড়ুনঃ- ছোট হাসির গল্প- বউ নাকি গোয়েন্দা!
রবীন্দ্রনাথের মজার ঘটনাঃ- ৪
জীবনের শেষ দিকে এসে রবীন্দ্রনাথ একটু সামনের দিকে ঝুঁকে উবু হয়ে লিখতেন। একদিন তাঁকে ওভাবে উবু হয়ে লিখতে দেখে তাঁর এক শুভাকাঙ্ক্ষী বলল, “আপনার নিশ্চয় ওভাবে উপুড় হয়ে লিখতে কষ্ট হচ্ছে। বাজারে এখন এ রকম অনেক চেয়ার আছে যেগুলোতে আপনি হেলান দিয়ে বেশ আয়েশের সঙ্গে লিখতে পারেন। ওরকম একটা আনিয়ে নিলেই তো পারেন।” লোকটার দিকে খানিকক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে রবীন্দ্রনাথ জবাব দিলেন, “তা তো পারি। তবে কি জানো, এখন উপুড় হয়ে না লিখলে কি আর লেখা বেরোয়! পাত্রের জল কমে তলায় ঠেকলে একটু উপুড় তো করতেই হয়।”
রবীন্দ্রনাথের মজার ঘটনাঃ- ৫
রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের ছাত্রদের বকাঝকার পক্ষপাতি ছিলেন না। তিনি কাউকে কখনও আঘাত দিতে চাইতেন না। একবার প্রমথনাথ বিশী সম্পর্কে একটা নালিশ এল। এমন অবস্থা যে, তাকে না বকলেই নয়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও গুরুদেব প্রমথকে অনেকক্ষণ ধরে বকলেন। তিনি একটু থামলে প্রমথ বললেন, “কিন্তু ঘটনা হল আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না।”
রবীন্দ্রনাথ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। বললেন, “বাঁচালি। তোকে বকাও হল আবার তুই কষ্টও পেলি না।”
প্রতিনিয়ত আপডেটের জন্য আমাদের ফেসবুক পেজ- গল্প আর গল্প
আমাদের লেখা পাঠাতে হলে- ছাড়পত্র(২)
” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন এর সঙ্গে যুক্ত গল্প। রবীন্দ্রনাথের মজার ঘটনা। রবীন্দ্রনাথের জীবন কাহিনী”
কি কেন কীভাবের উপর গড়ে ওঠা মানুষের জিজ্ঞাসু মন সর্বদাই নতুন দিগন্তের সন্ধানে পা বাড়ায় ৷ প্রতিটি পদক্ষেপেই নতুন কিছু অভিজ্ঞতা আমাদের ঝুলিতে জমা হয় ৷ সেই অভিজ্ঞতা সকলের সাথে ভাগ করে নেওয়ার মধ্যে এক অফুরন্ত আনন্দ লুকিয়ে থাকে ৷ আর সেই কাজেই হাত বাড়িয়েছে ছাড়পত্রের টিম।
ধন্যবাদ।।