আজ গোপাল ভাঁড়ের গল্পনিয়ে আমাদের যে সিরিজ চলছিল, তাঁরই দ্বিতীয় পর্ব তথা গোপাল ভাঁড়ের আরেকটি নতুন গল্প নিয়ে হাজির হলাম। এই দ্বিতীয় পর্বের গল্পটি গোপাল ভাঁড়ের পণ্ডিত জব্দ নিয়ে লেখা। তাহলে দেড়ি না করে গোপাল ভাঁড়ের হাসির গল্পটি শুরু করা যাক।

গোপাল ভাঁড়ের গল্প। পণ্ডিত জব্দ। gopal bharer golpo:-

কাশী, কাঞ্চী, দ্রাবিড় প্রভৃতি স্থানের পণ্ডিতগণকে তর্কে পরাজিত করে, এক দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত নবাবের দরবারে উপস্থিত হয়ে বললেন— জাহাঁপনা, আপনি বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব, আপনার এই বিশাল রাজ্যে যদি এমন কোনো পণ্ডিত থাকে যিনি আমাকে তর্কে হারাতে পাড়বেন— তবে আমার সঙ্গে তর্কে প্রবৃত্ত হতে বলুন। যিনি আমাকে তর্কে পরাজিত করতে পারবেন— আমি আজীবন তাঁর চাকর হয়ে থাকব, আর তিনি যদি আমার কাছে তর্কে পরাজিত হন তবে আমার কাছে তাঁকে আজীবন চাকর হয়ে থাকতে হবে।

নবাব চিরদিনই কৌতুকপ্রিয়, তিনি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে একটি চিঠি লিখে, জানালেনঃ কাশী, কাঞ্চী, দ্রাবিড়, বিদর্ভ প্রভৃতি স্থানের সকল শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতগণকে পরাজিত করে এক পণ্ডিত আমার দরবারে উপস্থিত হয়েছেন। তিনি আমার রাজ্যের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতের সঙ্গে তর্কে প্রবৃত্ত হতে চান। আমার রাজ্যের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতগণ সকলেই নবদ্বীপ অঞ্চলে বাস করেন। অতএব আপনি অবিলম্বে একজন শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত পাঠিয়ে আমার মুখ রক্ষা করুন। দিগ্বিজয়ী পণ্ডিতের একটি শর্ত আছে—যাঁর কাছে তিনি পরাজিত হবেন— আজীবন তিনি তাঁর চাকরের কাজ করবেন, আর আমাদের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতকে যদি দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত তর্কে পরাজিত করতে পারেন, তবে সেই পণ্ডিতকে আজীবন কাল উক্ত দ্বিগ্বিজয়ী পণ্ডিতের চাকর হয়ে কাটাতে হবে।

মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র নবাবের চিঠি তার সভার সকল পণ্ডিতদেরই পড়ে শোনালেন। তাঁরা কেউ চাকর হবার ভয়ে দিগ্বিজয়ী পণ্ডিতের সঙ্গে তর্কে প্রবৃত্ত হতে রাজী হলেন না। মহারাজ তখন নবদ্বীপের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতদের ডেকে পাঠালেন।

 funny story of gopal bhar. gopal varer hasir golpo. gopal bharer golpo
funny story of gopal bhar. gopal varer hasir golpo. gopal bharer golpo

কিন্তু তাঁরাও কেউ দ্বিগ্বিজয়ী পণ্ডিতের সঙ্গে তর্কে প্রবৃত্ত হতে রাজী হলেন না। তাঁরা সবাই একবাক্যে বললেন— মহারাজ, অতবড় পণ্ডিত তিনি। কাশী, কাঞ্চী, বিদর্ভ প্রভৃতি স্থানের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতগণকে হারিয়ে এখানে এসেছেন। তাঁর সঙ্গে তর্ক করে কি শেষ পর্যন্ত চাকরের কাজ করে জীবন কাটাব, আমরা কেউই তার সঙ্গে তর্কে প্রবৃত্ত হতে রাজী নই।

এদিকে নবাব আর একখানা চিঠি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্ৰকে পাঠালেন, অবিলম্বে রাজ্যের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতকে তাঁর দরবারে পাঠাবার জন্য। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র মহা-ঝামেলায় পড়লেন। এদিকে নবাবের জোর তাগিদ, অপর দিকে কোন পণ্ডিতই তর্কে প্রবৃত্ত হতে রাজী নয়। অথচ নবাবের অনুরোধ না পালন করলে সমূহ বিপদের সম্ভাবনা, যা খেয়ালী নবাব।

মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র সিংহাসনে বসে নানা কথা ভাবছিলেন— এমন সময় গোপাল রাজসভায় প্রবেশ করে মহারাজকে জিজ্ঞেস করলেন- “মহারাজ আপনি কি কোন তিক্ত ঔষধ সেবন করেছেন, নতুবা আপনার মুখের অবস্থা এরূপ কেন?”

মহারাজ গম্ভীর স্বরে বললেন- “গোপাল! সব সময় ভাঁড়ামি আমার পছন্দ নয়। আমি কিনা চিন্তায় হাবুডুবু খাচ্ছি— আর তুমি দিব্যি ভাঁড়ামি করছ?”

গোপাল করজোড়ে বলল- “হুজুর আমার অপরাধ ক্ষমা করুন আপনার চিন্তিত হবার কারণ জানতে পারি কি? মহারাজ তখন নবাবের চিঠির কথা, দ্বিগ্বিজয়ী পণ্ডিতের সঙ্গে কোনো পণ্ডিতেরই তর্কে প্রবৃত্ত হতে রাজী না হওয়ার কথা – একে একে সবই গোপালকে বললেন।

রাজার কথা শুনে গোপাল হাসিমুখে বলল— “এর জন্যে আপনার এত ভাবনা? আমি তর্কে প্রবৃত্ত হব।“

তাচ্ছিল্যভরে মহারাজ বললেন— “তুমি তর্ক করবে, দ্বিগ্বিজয়ী পণ্ডিতের সঙ্গে? সভাস্থ সকল লোকই হেসে উঠল।

গোপাল গম্ভীর স্বরে বলল—“হ্যাঁ আমিই প্রবৃত্ত হবো তর্কে। দেখি কেমন সে পণ্ডিত— আমি আগামীকালই নবাব-দরবারের উদ্দেশে রওনা হবো।“

গোপালের কথা শুনে মন্ত্রীমশায় ব্যঙ্গভরে বললেন- “খাচ্ছিল ভাঁড়, ভাঁড়ামি করে। এবার যে তার চাকরামি ঘাড়ে।”

গোপাল বলল— “কে কার চাকর হয়, পরেই বোঝা যাবে।“

পরদিন সকালেই গোপাল পণ্ডিত সেজে তিনটি গোরুর গাড়ি ভর্তি; পাঁজি পুঁথি নিয়ে নবাব দরবারের উদ্দেশ্যে রওনা দিল।

gopal varer hasir golpo. gopal bharer golpo
gopal varer hasir golpo. gopal bharer golpo IMAGE

গোপাল নবাব দরবারে পৌঁছেই নবাবকে সেলাম করে বলল- “জাহাঁপনা আমাকে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র পাঠিয়েছেন। আমি দ্বিগ্বিজয়ী পণ্ডিতের সঙ্গে তর্কে প্রবৃত্ত হতে চাই। আমি তাঁর জয়ের গর্ব ভেঙে চুরমার করে দিতে চাই। কোথায় সে অর্বাচীন, যে নবদ্বীপবাসী পণ্ডিতগণের সঙ্গে তর্কে প্রবৃত্ত হতে চায়?”

দ্বিগ্বিজয়ী পণ্ডিত তখন নবাব দরবারেই বসেছিলেন। তিনি গোপালের বিরাট পণ্ডিত সুলভ চেহারা দেখে এবং একজন অনুচরের মুখে তিনখানা গোরুর গাড়ি ভর্তি পুঁথি আমার কথা শুনে ভীষণ ঘাবড়ে গেলেন। তিনি বললেন – “আজ তো তর্কে প্রবৃত্ত হওয়ার সময় নেই, আগামী কালই তর্ক করব।“

নবাব গোপালকে বললেন- “পণ্ডিতমশায় আপনি অতদুর থেকে এসেছেন, আজ বিশ্রাম গ্রহণ করুন, আগামীকালই তর্কে প্রবৃত্ত হবেন।“

গোপাল বলল- “বেশ, আমি যে কোন সময়েই তর্কে প্রবৃত্ত হতে রাজী আছি।“

গোপাল নবাবের অতিথিশালায় গিয়ে তিন গাড়ি পুঁথিপত্র নিয়ে উঠল। অতিথিশালার অপর পার্শ্বেই দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত উঠেছিলেন। তিনি সেদিনই সন্ধেবেলা তাঁর একজন অনুচরকে গোপালের পাণ্ডিত্যের বহর জানবার জন্য পাঠালেন।

দ্বিগ্বিজয়ী পণ্ডিতের অনুচর গোপালকে এসে জিজ্ঞাসা করলেন—“পণ্ডিতমশাই আপনি তিন গাড়ি বোঝাই এত কি পুঁথি এনেছেন।“

গোপাল বলল – “জ্ঞান ভাণ্ডারের কি শেষ আছে বৎস? এতে অনেক পুঁথি আছে। আর এমন সব পুঁথি আছে যে, দ্বিগ্বিজয়ী পণ্ডিত সে সকল পুঁথি নামই শোনেনি।“

“কয়েকখানার নাম বলুন তো?”

গোপাল বলতে শুরু করল- “ক্ষুদ্র খট্টাঙ্গ পুরাণ, বৃহৎ খট্টাঙ্গ পুরাণ, স্বর্গচতুর্ভূজ সপ্তদশ খণ্ড, কৈবল্য-রত্নসন্দর্ভ, নিখিল-বিশ্ব-চঞ, চাঞ্চল্য-বিভব-কৈবল্য-রসামৃতনিধি ইত্যাদি ইত্যাদি।“

গোপালের মুখে এ ধরনের সব পুঁথির নাম শুনে দ্বিগ্বিজয়ী পণ্ডিতের অনুচর ভীষণ ঘাবড়ে গেল।

গোপাল তাকে বলল- “আমার বাড়িতে এখনও অষ্টাদশ জন দ্বিগ্বিজয়ী পণ্ডিত দাসত্ব করছে—একে নিয়ে অবশ্য উনবিংশ হবে, আমার আরও একজন দাস দরকার।“

গোপাল ভাঁড়- পর্ব ০১

in case you miss it…

পড়ুনঃ- 18 টি মোটিভেশনাল উক্তি বাংলা

দ্বিগ্বিজয়ী পণ্ডিতের অনুচর সব কথা শুনে গিয়ে তার প্রভুকে নিবেদন করল।

দ্বিগ্বিজয়ী পণ্ডিত সব শুনে বললেন—’যঃ পলায়তি, সঃ জীবতি।’ আজ রাতের অন্ধকারেই আমাদের এ রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে যেতে হবে।“

গোপাল ভোর রাতে অতিথিশালার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখল দ্বিগ্বিজয়ী পণ্ডিত চুপে চুপে অনুচরবর্গসহ পালিয়ে যাচ্ছেন।

গোপাল পরদিন নবাব দরবারে গিয়ে বলল— “কোথায় সেই অর্বাচীন দ্বিগ্বিজয়ী পণ্ডিত?”

নবাব দ্বিগ্বিজয়ী পণ্ডিতকে অতিথিশালা থেকে ডেকে আনার জন্য লোক পাঠালেন।

তারা ফিরে এসে বলল— “দ্বিগ্বিজয়ী পণ্ডিত রাতারাতি পালিয়ে গেছে কোথাও তাঁর টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।“

গোপাল বলল—“হুজুর সে আমার নাম শুনেই, আর তর্ক করতে সাহস পেল না।“

নবাব সন্তুষ্ট হয়ে গোপালকে দু’হাজার আশরফি পুরস্কার দিয়ে বললেন— “আপনার মতো পণ্ডিত যে কষ্ট করে নবাব দরবারে এসেছেন তাতেই নবাব দরবার ধন্য হয়ে গেছে।“

গোপাল ভাঁড়ের গল্প। গোপাল ভাঁড়ের হাসির গল্প
গোপাল ভাঁড়ের গল্প। গোপাল ভাঁড়ের হাসির গল্প
<

নবাব গোপালের মারফত রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে একখানা চিঠি দিয়ে জানালেন- মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র, আমি আপনার প্রতি খুব সন্তুষ্ট। আপনি এমনই একজন পণ্ডিত পাঠিয়েছিলেন— যার সঙ্গে তর্কে প্রবৃত্ত হতে ভয় পেয়ে স্বয়ং দ্বিগ্বিজয়ী পণ্ডিত রাতারাতি সঙ্গ-বঙ্গ নিয়ে পালিয়ে গেছেন।

গোপাল নাচতে নাচতেই নবাবের চিঠিসহ কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে গিয়ে পৌঁছল। নবাবের চিঠি পড়ে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র অবাক হয়ে গেলেন। গোপালের মুখে আনুপূর্বিক সকল ঘটনা শুনে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লেন।

আমাদের ফেসবুক পেজ লিংকঃ- গল্প আর গল্প

click here to join with us on telegram charpatra 1
click the image to join our telegram group

গোপাল ভাঁড়ের গল্প। গোপাল ভাঁড়ের হাসির গল্প। new 1 top funny story of gopal bhar. gopal varer hasir golpo. gopal bharer golpo.

Spread the love

Leave a Reply