ছাড়পত্রের পাতায় আজ যে বাস্তব জীবনের কাহিনী টি থাকছে, সেটি আদতে বাস্তবতার আড়ালে মোড়া এক সত্যি কাহিনী।

বাস্তব জীবনের কাহিনীঃ- “ত্যাগ”

” বাবা তুমি কথা বলছো না কেন ? ও বাবা তুমি চুপ করে আছো কেন ? “
কথাটা বলতে বলতে বিয়ের মণ্ডপে সবার সামনেই বর্ষা কান্নায় ভেঙে পড়লো …. চারদিকটা কেমন যেন ঝাপসা হয়ে উঠলো ওর কাছে…চোখের পলক ফেলতে ফেলতেই দেখতে পেলো ওর বাবা অর্থাৎ মৈনাক বাবু যেন এক গোছা ফুলের তোড়া নিয়ে মেয়ের জন্য দরজায় অপেক্ষা করছেন ….কিন্তু বুঝতে পারলো সেটা বাস্তব নয় তার অলিখ কল্পনা …

রানীগঞ্জ এর কুমারবাজারের বাসিন্দা হলেন মৈনাক বাবু। সংসারী মানুষ উনি , ছেলে মেয়ে আর স্ত্রী তার কাছে নিজের জীবনের থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেন এই কথাটা বলছি জানেন ? না না , জানেন না জানি। তাই একটুক্ষণ থেকেই যান আমার সাথে একটা বাস্তব অভিজ্ঞতার সাক্ষী হতে রানীগঞ্জ এর কলিয়ারি তে ই সি এলের চাকুরে মৈনাক বাবুর সংসারে , তার ছেলে মেয়ে ছোট থেকে কখনোই অভাবের মুখ দেখেনি। যথাসাধ্য চেষ্টা করে সর্বদা ছেলে মেয়ের আবদার পূরণ করে এসেছেন তিনি।

তবে আদরে আবদারে বেড়ে ওটা ছেলে মেয়ে কখনোই কিন্তু বাবার অবাধ্য নয় । তাই মৈনাক বাবুর ইচ্ছেতেই তার মেয়ে কলকাতার মেডিক্যাল কলেজের সদ্য পাস করা এক ডাক্তার। কিন্তু তার যত দুশচিন্তা তার একমাত্র ছেলে সুবোধ কে নিয়ে। ছেলেটা এমনি শান্ত ভদ্র , বাবা অনুগত হলেও তার পড়াশোনাতে খুব একটা মতিগতি নেই। তাই তাকে নিয়ে তার বাবার ও চিন্তার শেষ নেই।

বাস্তব জীবনের কাহিনী
বাস্তব জীবনের কাহিনী

প্রথম প্রথম নানান কোম্পানি তে ইন্টারভিউ দিলেও , ইংলিশে সমস্যা থাকায় কোনো ইন্টারভিউ তেই সুবোধ পাস করতে পারে না । তারপর ভালো কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়ে সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নিলেও তাতেও কোনো সুফল মেলে না । উচ্চ শিক্ষিত দিদির কাছে নিজেকে বড্ড ছোট মনে করতো সুবোধ । দিন দিন তাই ছেলেটার গতিক খারাপ দিকে আগাতে লাগলো ।

বাবার বাধ্য ছেলেটা দিন দিন অবাধ্য হতে শুরু করলো । রাত করে বাড়ি ফেরা , রাস্তার মোড়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া , এমনকি প্রেমিকার খোঁজে গার্লস কলেজের আসে পাশে ঘোরাফেরা করা। এগুলোই হয়ে উঠলো তার নিত্য দিনের অভ্যাস। ছেলের এরূপ অবস্থা দেখে মৈনাক বাবু আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলেন না । তিনিও সরাসরি রাগের বসে, বেশ কয়েকবার ছেলেকে ঘর থেকে বের করে দিলেও, আবার ফিরিয়ে এনে সঠিক পথ দেখানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু ছেলেকে সঠিক পথে আনতে ব্যর্থ হলেন।

এদিকে তার মেয়ে , যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে বললো। মেয়ের ইচ্ছে, তার ভালোবাসার মানুষকে তার বাবা সদিচ্ছায় মেনে নিয়ে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিক । তাহলে ওরা একসাথেই বিদেশে পড়াশোনা করতে যেতে পারবে। একসাথে চারদিকের সমস্যা তাকে ঘিরে ফেললেও তিনি শান্ত মাথায় তার ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাওয়া সংসারকে , আবার সুখের সংসার বানাতে সচেষ্ট হয়ে উঠলেন।

** রহস্যের দুনিয়ায় আপনাকে স্বাগতম পড়ুন অসাধারণ সব রহস্যময় গল্প এখানে ক্লিক করে**  

মেয়ের বিয়ে ঠিক করে দিলেন। ছেলেকেও কথা দিলেন , কিছুদিনের মধ্যেই সে ভালো চাকরি পেয়ে যাবে , তার ব্যবস্থা মৈনাক বাবু নিজে করেছেন । তাই পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠলো। দিদির বিয়ে নিয়ে সুবোধ ও বেশ ব্যস্ত হয়ে উঠলো। পুরো পরিবার আবার মেতে উঠলো নিজেদের নিয়ে। দেখতে দেখতে বিয়ের দিন ও চলে এলো , লোকের সমাগমে বাড়ি মুখরিত , বিয়ের এক একটা অনুষ্ঠান খুব সুন্দর ভাবে পেরিয়ে যাচ্ছে পরের পর , এবার শুধু রাত্রে বিয়েটা ভালো ভাবে মিটলেই হলো , তাহলেই মৈনাক বাবু চিন্তা মুক্ত।

বর সমেত বরযাত্রী উপস্থিত , বিয়েও শুরু হয়ে গেছে , কণ্যাদানের সময় মৈনাক বাবুর ডাক পড়লো। কিন্তু মৈনাক বাবু কোথায় ? তাকে তো কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না , গেলেন কোথায় তিনি ? চারদিকে মৈনাক বাবুকে খোঁজাখুঁজি শুরু হলেও , কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলো না। এদিকে তার ছেলে তার রুমে ফোন নিতে গেলে দেখতে পেলো টেবিলের ওপর নামানো একটা কাগজ , সেটা হাতে নিয়ে পড়া শুরু করতেই তার পায়ের মাটি যেন সরে গেলো, পুরো আকাশ টা সেই মুহূর্তে যেন তার মাথার ওপর ভেঙে পড়লো।

বাস্তব-জীবনের-গল্প
বাস্তব-জীবনের-গল্প

” বাবু , যখন তুই এই চিঠি টা পড়বি। তখন হয়তো আর আমি তোদের মাঝে উপস্থিত থাকবো না। জানিস তো বাবা , আমার মা বাবা ইহলোক ত্যাগ এর পর তোর মা আর তোরা দুই ভাই বোন এই ছিলি আমার কাছে সব। তোদের আনন্দে সুখে রাখাটাই ছিল আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য । তাই তোদের সব ইচ্ছে পূরণ করার চেষ্টা করেছি এতদিন। তোর দিদির বিয়েটাতে আমার মোটেও সমর্থন ছিল না , কিন্তু মেয়েটার আনন্দের কথা ভেবে আমি রাজি হয়ে গেলাম। তুই ও কোনো চাকরি না পেয়ে কেমন খারাপ পথে চলে যাচ্ছিলি বল, সেটা আমার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। তাই আমি স্যারের সাথে কথা বলেছিলাম তোর চাকরির ব্যাপারে ।

উনি বললেন পরীক্ষাতে পাস করলে তবে চাকরি , নইলে আরেকটা পথ আছে যদি আমি রিটার্ড করার আগে মারা যাই, তাহলে আমার চাকরিটা আমার উত্তরাধিকারী পাবে। কথাটা শুনে বিশ্বাস কর একটা আসা জাগলো মনে । আমার কালকে রিটার্ড এর দিন , তাই হাতে একদম সময় নেই , ইচ্ছে থাকলেও তোর দিদির বিয়েটা সম্পূর্ণ করে যেতে পারলাম না। তার জন্য ওর কাছেও আমি ক্ষমা চেয়ে নিয়েছি , পরে হয়তো ও চিঠিটা পাবে। এমনি তেও আর কতদিন বাঁচবো বল , তোদের হাসি মুখেই তো আমার সুখ। আর জীবিত থেকে যদি সেই সুখটাই না পাই , তার চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়।

পড়ুনঃ- সুন্দর ছোট গল্প- 'চির বসন্ত' 

তবে আমার শেষ ইচ্ছে ” তুই ভাই হয়ে তোর দিদির বিয়েটা সম্পন্ন কর , বাবার দায়িত্ব টা তুই পূর্ণ কর বাবা। আর তোর মা কে একটু দেখে রাখিস , পাগলীটা আমায় ছাড়া খুব কষ্ট পাবে তবে তোরা ওকে দেখে রাখিস , ওকে অবহেলা করিস না কোনোদিন। সুখে থাকিস বাবা ,ভালো থাকিস।

পুরোটা পড়া শেষ করার পর নিজেকে সামলে যখন সুবোধ নিচে নামলো তখন মণ্ডপে সানাইয়ের সুরের বদলে কান্নার আওয়াজ কানে ভেসে এলো। ততক্ষনে তার বাবার শব্ দেহ পুলিশ রানীগঞ্জ রেল স্টেশন থেকে উদ্ধার করে বাড়ি নিয়ে এসেছে। সব কেমন যেন ছারখার হয়ে গেলো , বরযাত্রী দের চাপে কিছুটা জোরের বসেই সিঁদুর পরিয়ে বিয়েটা সম্পন্ন হলো । মেয়েটা কিছুটা হলেও বুঝতে পারলো , তার বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়েটা কখনোই তাকে সুখ দিতে পারবে না।

bengali real life story
bengali real life story
<

একদিকে মেয়েকে নিয়ে বরের গাড়ি আর অন্যদিকে ময়না তদন্ত করতে মৈনাক বাবুর শব দেহের গাড়ি , দুই ভিন্ন রাস্তায় রওনা দিলো। সুবোধ তার মা কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে , এতদিনের করা ভুলের ক্ষমা চাইতে লাগলো। মৈনাক বাবুর সাথে সাথেই তার সুখের সংসার টা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো।

কি অদ্ভুত বাস্তব তাই না । আমাদের জীবনে মায়েদের ভূমিকা সবসময় মনে থাকলেও , আড়ালে জীবন পণ করে যাওয়া মানুষটার ভূমিকা আমাদের মনেই থাকে না , আসলে কঠিনের আবরণে ভেতরের কোমল মন টা কে আমরা কখনো দেখার চেষ্টাই করি না। কিন্তু প্রতি মুহূর্তে “বাবা” নামের এই মানুষটা আমাদের প্রতি সব দায়িত্ব কর্তব্য পালন করে প্রমাণ করে দেন, যে বাড়ির তলায় বাস করছি তার মূল ভীত এই হলো তিনি নিজে।

এরূপই একজন বাবার দায়িত্ত্ব পালনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেলেন মৈনাক বাবু নিজে , যেখানে সন্তানের জন্য জীবন বিসর্জন দেওয়ার বিষয়েও তিনি সুখের হদিস পেয়েছেন ।

গল্প পাঠাতে পারেন- charpatrablog@gmail.com -এ অথবা সরাসরি WhatsApp -এর মাধ্যমে এখানে ক্লিক করে। 

সমস্ত কপিরাইট ছাড়পত্র দ্বারা সংরক্ষিত। গল্পটির ভিডিও বা অডিও বা অন্য কোনো মাধ্যমে অন্যত্র প্রকাশ আইন বিরুদ্ধ। ছাড়পত্র এর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণে বাধ্য হবে।

পড়ুনঃ- 

প্রেমের গল্প- বিবাহ অভিযান

কয়েক লাইনের ছোট ছোট স্যাড লাভ স্টোরি  
আমাদের সাথে যুক্ত হবেন যেভাবে- 

ফেসবুক Group - গল্প Junction 

ফেসবুক- ছাড়পত্র

টেলিগ্রাম- charpatraOfficial

WhatsApp Group- ছাড়পত্র (২

বাস্তব জীবনের কাহিনী। বাস্তব জীবনের গল্প bengali real life story

Spread the love

Leave a Reply