ভিন্ন ভিন্ন রকমের গল্পের স্বাদ ছাড়পত্র আপনাদের দিয়ে এসেছে, আজ বাস্তবতা নিয়ে একটি গল্প -এর স্বাদ অনুভব করুন। তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের খই ছড়ানোর মত মুখের বুলি যে বাস্তব জীবনে আসলে ধোঁয়াশার মেঘ, তাইই তুলে ধরা হয়েছে এই গল্পটিতে।
বাস্তবতা নিয়ে একটি গল্প- নির্দয়ঃ-
পূজো এসে গেছে তার পূজো পূজো গন্ধ মাখানো অনুভূতি নিয়ে। চতুর্দিকে নতুন নতুন জামা ঝুলছে জামার দোকানে । জুতোর দোকানে জুতোর ঢল নেমেছে। গয়নার দোকানে গয়নার ঝলমলে রঙের আভা। খাবারের দোকান খাবারের গন্ধে ম ম করছে। লোকে লোকারণ্য চারিদিক। পূজোর আনন্দে ব্যস্ত সবাই।
এত আলোর মধ্যেও ফুটপাতে বসে আছে দুটো ছোট বাচ্চা ছেলে মেয়ে, যাদের কেউ নেই এই পূজোর আনন্দের সময় তাদের সাথে আনন্দ ভাগ করতে, তাদেরকে পূজোর জামা বা খাবার বা খেলনা বা অন্য কিছু কিনে দিতে। বাচ্চা দুটো চতুর্দিকে আলো ঝলমলে দেখে বড্ড ভয় পায়। এই আলোটা সদয়ের আলো নাকি নির্দয়ের আলো? এত লোকে আনন্দ করে কিন্তু তাদের মতো অনাথ পথশিশুদের জন্য কি শুধুই সমাজের উপেক্ষা আর অবহেলা!
দিদি সারাদিন এর ওর কাছে গিয়ে ভিক্ষে করতে গেলেই সবাই কেমন যেন দূর দূর করে ওঠে। দেখে মনে হয় লোকগুলোর মতে এসব বাচ্চা যেন গুন্ডাদলের জন্য টাকা তুলছে। কিন্তু না সবাই তাই নয়, সবাই মোটেও এমন নয়। বাচ্চা দুটো অনেককে দেখেছে হাত পা ভাঙার অভিনয় করে প্রথমে অনেক টাকা কোনো একটি লোক ভিক্ষে করে পাওয়ার পর হঠাৎ করেই তার হাত পা গজিয়ে গেল। আবার আরেকটা মেয়েকে দেখেছিল সে ছেঁড়া জামাকাপড় পরে টাকা ভিক্ষে করছে অনেক অসহায় অসহায় কথা বলে কিন্তু পরক্ষণেই মেয়েটাকে দারুণ সাজে দেখা যায় বাইকে করে চলে গেল। তাই লোকে এখন ভিখারী বা অনাথ পথশিশুদের বিশ্বাস করে না।
আরো দেখে বাচ্চা দুটো, স্বভাবে বা অভাবে পকেটমারি , ছিনতাই, ধাক্কাধাক্কি, নোংরামি, অ্যাক্সিডেন্ট, খুন। মানুষের খুনের সাথে সমাজের খুনকেও যেন দেখতে পায় বাচ্চা দু’টো।
অনেক পশুপাখির মৃত্যুও দেখে তারা। দেখে কেউ কাউকে ঠকিয়ে তার টাকায় অনেক অনেক আনন্দ করছে, আবার কেউ বা তাদের মতোই না খেয়ে তাকিয়ে আছে সামান্য খাবারের আশায়।
“ভাই তোর খিদে পেয়েছে খুব তাই না?” বলে ওঠে ছোট দিদি।
“হুম দিদি খুব খিদে পেয়েছে।”
“দাঁড়া আমি কিছু খাবার নিয়ে আসি।” বলে দিদি সামনে দিয়ে যাওয়া ভদ্র লোকের কাছে হাত পেতে বলে, বাবু, কিছু টাকা দিন না, আমার ভাইয়ের খুব খিদে পেয়েছে।”
পড়ুন- বাস্তব জীবনের শিক্ষণীয় গল্প
ভদ্রলোকের স্ত্রী মুখ ভেঙিয়ে বলে ওঠে, “হুঁ! কার না কার পাপের ফল, যা যা দূর হ, কিচ্ছু টাকা ফাকা হবে না। লোক দেখলেই হামলে পড়বে। হা’ঘরে কোথাকার! পথে যখন তোর বাপ মা ফেলেই রেখে গেছে তখন অত খাই খাই করতে হবে না, মরতেও তো পারিস তোরা, বড় হলে তো সেই চোর চামার বা খুনিই তো হবি, এছাড়া তো কিছু না। এই চলো তো, দাঁড়িয়ে থেকো না। ”
পুরো পরিবার টাই চলে গেল শিশুদুটোর করুণ মুখ উপেক্ষা করে। ভাইটি তার দিদির হাত ধরে বলে, “দিদি, দিদি আমার খিদে পায়নি রে, তুই এখানেই বস আমার কাছে, কোথাও যাস না।”
দিদি বলে, “না ভাই, আর একটু দাঁড়া আমি দেখছি কোথাও কোনো খাবার পাওয়া যায় কিনা।”
“আচ্ছা দিদি, সবাই দেখ কত আনন্দ করছে খাচ্ছে কত খাবার, কত খেলনা কিনছে ঐ ছেলে গুলো, কত সুন্দর ঝলমলে চারিদিক। মা বাবার সাথে সবাই কি সুন্দর ঘুরছে, আমি আর তুই কেন এই অন্ধকারে রোজ বসে এর ওর কাছে খাবার চাই? আমাদের কেন কেউ ভালোবাসে না রে?” বলে ভাইটা ।
দিদি খুব হতাশ হয়ে বলে, “জানি না ভাই। জানি না ঐ ঈশ্বর না কি যেন একটা উপরে থাকে , সে এত নির্দয় কেন? আচ্ছা তুই বস, আমি খাবার নিয়ে আসি।”
দিদি চলে যায়। আর ভাই অপেক্ষা করে দিদির জন্য।
দিদি যেতে যেতে দেখে অনেককে অনুরোধ করে অনেককে যেন কিছু খাবার দেয়। কিন্তু সবাই কেন তাদের মতো পথের অনাথ শিশুদের খারাপ দলের কেউ ভাবে? কেন ভাবে না যে তাদের ঘরের ছেলেমেয়েদের বয়সী দুটো বাচ্চাকে একটু খাবার দিলে তাদের খারাপ কিছু হবে না। বোঝে না মেয়েটা এটা মানুষের না দেওয়ার স্বভাব নাকি না দিতে পারার দোহাই। চারিদিকে সবাই অনেক আনন্দে থাকলেও তাদের চোখের জল কারোর অগোচরে নেই , আলোয় চারিদিক মেতে থাকলেও, তাদের অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনে আলো দেওয়ার কেউ নেই , নতুন পোষাকে চারিদিক ঢাকলেও তাদের শরীর শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা সবসময়তেই একটা জীর্ণ, মলিন, ছেঁড়া পোষাকে ঢাকা। চারিদিকে গান বাজছে গমগম করে অথচ ক্ষুধার্ত শিশু দুটির নীরবতার চিৎকার কানে পৌঁছায় না কারোরই ।
পড়ুন- সেরা তিনটি নৈতিক শিক্ষামূলক গল্প
মেয়েটি ভাবে চুরি করবে একটা দোকান থেকে, কারণ সে অনেক লোকের কাছে খাবার চেয়ে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছে। কত লোকে তাকে কি যে বলল তা সে বুঝতেও পারে নি। শিশু মন বোঝে না অপমানের ওজন। যাই হোক, সে চুরি করতে যায় একটা পরোটা। কিন্তু ধরা পড়ে যায়।
কপালে তার একটা পরোটার উত্তম মধ্যম প্রহার, অকথ্য গালাগালি জোটে। সবাই মিলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয় তাকে। বেচারা কাঁদতে কাঁদতে চলে যায় সেখান থেকে। ভাইয়ের জন্য খাবার জোগাড় করতে পারল না।
দূরে তার বয়সের একটা সুন্দরী মেয়েকে তার মা বাবার সাথে দেখতে পায়। মেয়েটা তার মা বাবা কে বলছে, “দেখো মম, দেখো ড্যাড, কীরকম একটা ছেঁড়া জামা কাপড় পরেছে ভিখারী টা, ইস! কি নোংরা দেখতে, তাই না!”
মা আর বাবা বলে, “ওদিকে তাকিও না সোনা, চলো আমরা ঠাকুর দেখতে যাই।”
গরীব মেয়েটা আনন্দে ছুটে যায় তার সমবয়সী মেয়ে দেখে কিন্তু তার আনন্দে জল পড়ে যায়।
একের পর এক অপমান, প্রত্যাখান, লাথি খেয়ে মেয়েটা যখন হতাশ হয়ে ভাইয়ের কাছে ফিরে যাবে হঠাৎ একজন লোক তার হাত ধরে বলে, “খুকি, এসো আমার সাথে, আমি তোমাকে খাবার কিনে দেবো।”
মেয়েটা আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল। বলল, “সত্যি বলছ কাকু, তুমি অনেক ভালো। তোমার ভাল হোক। আমি তোমার সব কাজ করে দেবো, কিন্তু আমাকে একটু খাবার দাও কাকু। আমার ভাইটা না খেয়ে বসে আছে আমার জন্য অপেক্ষা করে।”
“ঠিক আছে চলো আমার সাথে।” বলে লোকটা মেয়েটাকে নিয়ে যায় কোথায়।
ভাই বসে আছে দিদির অপেক্ষায়। গভীর রাত কিন্তু দিদি তো আর খাবার নিয়ে এলো না। খুব ভয় করতে লাগল ভাইয়ের, দিদি এখনো আসছে না বলে।
একদিকে খিদের যন্ত্রনা আর একদিকে দিদির জন্য ভাবনা এই দুইই ভাইয়ের মন নাড়া দেয়। কিন্তু দিদি যে আর কোনোদিন ফিরবে না তার ভাইয়ের কাছে খাবার নিয়ে।
সকাল হয়ে যায়। ভাই পথচারী কিছু মানুষকে বলতে শোনে, দেখো আমরা যতোই কষ্টে থাকি, আমাদের থেকেও অনেক বেশি কষ্টে থাকা মানুষদের কথা মনে রাখলেই নিজের কষ্ট ভোলা যায়। পথের গরীব অনাথ শিশুদের এই পূজোর মতো সময়তে অন্তত একটু সাহায্য করা উচিত। আমরা তো মানুষ, মান আর হুঁশ এর সমন্বয়েই তো তৈরি। মানবিকতা না থাকলে হয়, কি বলো ভায়া।
ভাইটা রেগে যায় এই প্রথম। দাঁতে ঠোঁট কেটে রক্ত বের হয়ে যায় তার। কোথায় গেল তার দিদি, তার জন্য একটু খাবারের খোঁজে? কি অপরাধ করেছিল তারা যে তাদের এই সমাজ অবহেলিত ধূলোকণার মতো দেখে অথচ মুখে বলে বেড়ায় বড় বড় ভাষণ!
ভাই এগিয়ে যায় দিদির খোঁজে।
পেরিয়ে গেছে পূজো। চারিদিক আবার আগের মতো। শুধু আগের মতো নেই তার দিদি। তার দিদি একটা ডাস্টবিনের পাশে নগ্ন অবস্থায় পড়ে আছে। রক্তাক্ত, মৃতদেহ তার। পচে গলে গন্ধ বেরোচ্ছে কিন্তু সবার চোখে মেকি জ্ঞানের, মেকি মানসিকতার পর্দা আটকানো তাই কেউই দেখতে পায়নি।
ভাইয়ের চোখে জল আসে না, সে তার দিদির মাথাটা নিজের কোলে রাখে। সে অনুভব করে তার দিদি বলছে, ‘ভাই, এই সমাজ বড় নির্দয়। মুখে সাধু বাক্য আর স্বভাবে ভন্ড। মানুষকে বিশ্বাস করিস না ভাই। আমাদের মতন পথশিশুদের জন্মও যেমন, মৃত্যুও তেমন। আমরা সবার দয়ার তালিকায় থাকলেও, আসলে ভোগের তালিকায় থাকি। এ সমাজের আমাদের কোনো স্থান নেই ভাই, কোনো স্থান নেই। সবাই শুধু মুখেই বড় বড় কথা বলে, আসলে সবটাই ফাঁকা আওয়াজ। এ সমাজ বড় নিষ্ঠুর ভাই। শিক্ষিতরাই আসলে ভদ্রলোকের মুখোশ পরা অশিক্ষিত। এ সমাজ বড় নির্দয়, এ জীবন বড় নির্দয়!’
আপনার লেখা গল্প বা কবিতা পাঠান- charpatrablog@gmail.com -এ।
গল্পের ভাব যার ভাবনায়-
লেখিকার কলমে পূর্ণতা প্রাপ্ত কিছু লেখা- কলেজ লাইফের লাভ স্টোরি- মেয়েদের জীবনের গল্প- স্পর্শ স্কুল জীবনের দুষ্টুমি- গন্ধচক্রান্ত
আমাদের সাথে যুক্ত হবেন যেভাবে-
ফেসবুক Group - গল্প Junction
ফেসবুক- ছাড়পত্র
টেলিগ্রাম- charpatraOfficial
WhatsApp Group- ছাড়পত্র (২)
“বাস্তবতা নিয়ে একটি গল্প। পথশিশুদের নিয়ে গল্প।। বাস্তবতা নিয়ে গল্প।।”
কি কেন কীভাবের উপর গড়ে ওঠা মানুষের জিজ্ঞাসু মন সর্বদাই নতুন দিগন্তের সন্ধানে পা বাড়ায় ৷ প্রতিটি পদক্ষেপেই নতুন কিছু অভিজ্ঞতা আমাদের ঝুলিতে জমা হয় ৷ সেই অভিজ্ঞতা সকলের সাথে ভাগ করে নেওয়ার মধ্যে এক অফুরন্ত আনন্দ লুকিয়ে থাকে ৷ আর সেই কাজেই হাত বাড়িয়েছে ছাড়পত্রের টিম।
ধন্যবাদ।।