জীবনের চরম বাস্তবতা যে বড়ই কঠিন তাই তুলে ধরা হয়েছে এই গল্প টিতে। কিভাবে ক্ষমতাসীনের সঙ্গে একটি সামান্য বিবাদ একটি পরিবারকে শেষ করে দেয়, তাই রয়েছে এই গল্পটিতে।

জীবনের চরম বাস্তবতা। জনপ্রতিনিধি যখন ভক্ষকঃ-

সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে জয়া। তার বাবা শহরের পোষ্ট অফিসের একজন অবসর প্রাপ্ত কর্মী। তার বাবার বিবাহ হয়েছিল অনেকটা দেড়িতে। তাই জয়া এখনও কলেজেই পড়ে। বেশ ভালোই চলছিল দিন। বাবা-মা সঙ্গে রয়েছেন, আর বাবার পেনশনে বেশ আরামেই চলছিল পরিবারটা।

একদিন বিকেলে থানা থেকে কয়েকজন পুলিশ এসে জয়ার বাবাকে ধরে নিয়ে গেল। অভিযোগ তিনি নাকি ভুয়ো কাগজ পত্র দিয়ে চাকরি তে ঢুকেছিলেন। বড়ই আজব ব্যাপার চাকরি শেষ, একজন পেনশন ভোগীকে নিয়ে এভাবে ছেলেখেলা করার মানেটা কি? খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেল, অভিযোগ তথা মামলা করেছেন তাদেরই MLA সাহেব।

MLA সাহেবের কথা বলতেই জয়ার মায়ের মুখটা কেমন যেন ফ্যাঁকাসে হয়ে গেল। অনেক জোর করার পর জয়ার মা জয়াকে জানান- তখন তাদের সদ্য বিবাহ হয়েছে। একবার পাড়ার মোড়ে MLA সাহেবের ছেলে কয়েকজন মেয়েকে বিরক্ত করছিল। জয়ার বাবা সেই সময় অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিলেন, ঘটনা চোখে পড়তেই, তিনি MLA সাহেবের ছেলেকে চর কষিয়ে দেন। বিদ্যুতের মত এই খবর ছড়িয়ে যায় গোটা মহল্লায়। এরপর MLA শাসানি দিয়ে যায় তার বাবাকে। কিন্তু সেই ঘটনার মীমাংসা তো আগেই হয়ে গেছে, তাহলে কি আবার সেই পুরনো কাসন্দি ঘাটতে চাইছেন MLA বাবু!

জয়ার মায়ের মুখটা ভয়ে কালো হয়ে যেতে লাগল। এদিকে জয়ার বাবার পেনশনটাও বন্ধ হয়ে গেল। কিছুদিন পর এরকম সুন্দর একটা পরিবার পথে বসে যেতে লাগল। বাড়িতে জমানো যা টাকা ছিল, তা দিয়ে কিছুদিন তাদের চলল। সময়ের সাথে সাথে তাদের অবস্থা এমন হয়ে যেতে লাগল যে, ফিক্সড ডিপোজিট গুলি ভাঙ্গিয়ে আনতে বাধ্য হলেন জয়ার বাবা।

এদিকে জয়ার বাবার উপর থানা থেকে চাপ আসতে থাকে, যে যতগুলি বেতন তিনি পেয়েছেন সব যেন ফেরত দিয়ে দেন সুদ সহ। আশ্চর্য! কোর্টের কোনো আদেশ নেই, মামলা নেই, আর এমনই বললেই হবে! জয়ার বাবা মেয়েটার দিকে দেখে নিরাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। “আচ্ছা বাবা তুমি এই বিষয়টা নিয়ে কোর্টেও তো যেতে পার যে, একজন MLA কিভাবে তোমাকে Harass করছে!”

politician real life story
জীবনের চরম বাস্তবতা bengali real life story

কিন্তু জয়ার বাবা, মেয়ের জীবনের জন্য কোথাও যেতে রাজী হলেন না। কারণ MLA এর বিরুদ্ধে মুখ খুললেই প্রাণের ঝুঁকি বাড়বে। হাঁ ভগবান, এরকম দুঃসময়ে ঈশ্বরও কাথামুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে থাকেন বুঝি!

এদিকে চিন্তায় জয়ার মায়ের অবস্থা দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। টাকার অভাবে কোনো বেসরকারি হসপিটালে ভর্তিও করা যাচ্ছে না। সরকারের দেওয়া স্বাস্থ্য-সাথী নামের কার্ড টাও স্বাস্থ্য রক্ষায় সাথী হচ্ছে না। প্রতিটি হসপিটাল সেই কার্ড গ্রহণ করতে অস্বীকার করে দেয়। কারণ, সরকার নাকি তাদের বকেয়া টাকা মিটিয়ে দেয়নি নি।

আশ্চর্যের বিষয় হল, যে ডাক্তারেরা Doctor’s day তে মিষ্টি মিষ্টি ভাষণ ছাড়েন, বলেন- “আমাদের কাছে আসুন, বিনা মুল্যে সব হবে। টাকা, মানবতার কাছে কিছুই নয়! তারাই আজ মুখ ফিরাচ্ছেন। কোথায় গেল তাদের সেই ভাষণ! কোথায় গেল তাদের সেই মানবতা!

পড়ুনঃ-  বাবাকে নিয়ে একটি শিক্ষণীয় গল্প

কষ্টে ধুঁকে ধুঁকে সরকারী হসপিটালের নুয়ে পরা চিকিৎসা ব্যবস্থার কাছে পরাজিত হলেন জয়ার মা। বাবার পেনশন বন্ধ হয়ে যাওয়াতে যতটা আঘাত পায়নি, মাকে আচমকা হারিয়ে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি আঘাত পেয়েছে জয়া।

সপ্তাহে দুই দিন মাছ-মাংস না হলে যে পরিবারের চলত না, সেই পরিবার আজ অনাহারে থাকছে, দিনের পর দিন। নিজের মেয়ের ভবিষ্যৎটা এভাবে নষ্ট হতে দেখে চোখের জল আটকাতে পাড়েন নি, জয়ার বাবা।

জয়ার বাবার অফিসের কর্মচারীরা কুলিকের এমন অবস্থা দেখে থাকতে পারেননি। কাছের ষ্টেশনেই সবাই মিলে চাঁদা উঠিয়ে খুলে দিয়েছেন একটি চায়ের দোকান।

সেই চায়ের দোকানের সাহায্যেই ধীরে ধীরে অনাহারে থাকা জয়ার পরিবারের মুখে একটু অন্নের জোগান হতে থাকে। এভাবেই চলতে থাকে দিন। বাবা সারাদিন ষ্টেশনে চা বিক্রি করেন, আর জয়া তাকে যতটা পারে সাহায্য করে।

সময়ের সাথে সাথে জয়াও আবার পড়াশোনার মূল স্রোতে ফেরার পরিকল্পনা করে। কিন্তু ভগবান বুঝি তাদের দিকে কিছুতেই তাকানোর প্রয়োজন মনে করেন না! বয়সের ভাঁড়ে আর অনাহারে থাকার ফলে জয়ার বাবার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পরে। বাধ্য হয়ে তাকে বিছানায় আশ্রয় নিতে হয়।

বাবার ওষুধ কেনার টাকা জোগাড় করতে সংসারের হাল ধরতে হয় কলেজ পড়ুয়া, জয়াকে। তার বয়সী ছেলে- মেয়েরা এখনও বাস্তব জীবনের সঙ্গে ততটাও পরিচিত নয়, কিন্তু এই কয়েকটা বছর জয়া বাস্তবতার সাথে থেকে যা কিছু শিখেছে, তা সে কিছুতেই ভুলবে না।

bengali real life story
bengali real life story বাংলা গল্প

একদিন জয়া সকালে ষ্টেশনে তাদের চায়ের দোকানে যায়। কিন্তু একি! তাদের দোকান কোথায় গেল! শঙ্কিত জয়া, যাকে দেখে তাকেই জিজ্ঞাসা করে- “দাদা এখানে একটি দোকান ছিল, দোকানটি কি হল!” কিন্তু কেউই জয়ার কথার উত্তর দেয় না।

শেষে একজন বৃদ্ধ, যিনি জয়ার দোকানের উল্টো পাশে বসেই পাঁপড় ভাজা বিক্রি করতেন, তিনি জানালেন- “গতকাল তুমি দোকান বন্ধ করে বাড়ি যাবার পর, রেল পুলিশ এসে তোমার দোকান ভেঙ্গে দিয়েছে। তোমার দোকান নাকি অবৈধ জায়গায় নির্মাণ করা হয়েছে। তোমরা নাকি অনুমতি নাওনি!”

“কিন্তু বাবার সহকর্মীরা তো, রেল অফিসারের কাছে অনুমতি নিয়েই এখানে দোকানটা বানিয়ে দিয়েছিল। তখন তো তারা কিছু বলেনি!” কথাটা শেষ হতে না হতেই জয়া হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কাঁদতে থাকে! কিন্তু তাকে চুপ করাবে কে, মা যে তাকে ছেড়ে চলে গেছে অনেক আগেই, আর বাবাও যে শয্যাশায়ী, তাকে সান্তনা দেওয়ার মত কোনো মানুষও যে সেখানে উপস্থিত নেই!

অতীতে ঘটে যাওয়া একটি সাধারণ ঘটনা নিয়ে MLA সাহেব তাদের জীবনে বন্যা বইয়ে দিলেন। থানার একজন শিক্ষিত অফিসার MLA –এর কথাতে উঠছেন বসছেন! মিথ্যে মামলার ভয় দেখিয়ে বন্ধ করে দিয়েছেন বাবার পেনশন। সরকারের দেওয়া অচল স্বাস্থ্য সাথী কার্ডটা মাকে বাঁচাতে অপারগ। বাবার কুলিকেরা একটু সাহায্য করে এই দোকানটা গড়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু সেটাও চোখে সইল না! শেষ সম্বলটাকেও কেড়ে নিল তারা।

বাংলা গল্প জীবনের চরম বাস্তবতা
বাংলা গল্প জীবনের চরম বাস্তবতা
<

হঠাৎ মেঘ গর্জে ওঠে, শুরু হয় তুমুল বৃষ্টি। মানুষজন দৌড়াদৌড়ি করে লুকোতে থাকে, আর জয়া এখনও তাদের দোকান যে জায়গাটায় ছিল সেখানে হাঁটু গেড়ে বসে কেঁদেই যাচ্ছে।

যার জীবনে এত বন্যা বয়ে গেছে, তার কাছে মেঘের এই তুমুল বৃষ্টি আর গর্জন চুনোপুঁটি মাত্র। সত্যি ঈশ্বর শুধু মাত্র বড়লোক আর দাপুটে মানুষদের বাড়িতেই থাকেন, গরীবদের দিকে অসহায়দের দিকে তাকানোর প্রয়োজন তিনি মনে করেন না! নেতা-মন্ত্রী এরা নাকি জনগণের প্রতিনিধি। কিন্তু এরা আসলে জনগণের প্রতিনিধি নয়, এরা হল জনগণের রক্ততে সুখ খোঁজা নরপিশাচ!   

© reserved by ছাড়পত্র. We don't give you the right for making videos or republish this content. We will be forced to take legal action.

আপনার লেখা গল্প পাঠাতে পাড়েন- charpatrablog@gmail.com -এ 
পড়ুনঃ- বাস্তব জীবনের শিক্ষণীয় গল্প- বাজ হয়ে উঠার লড়াইটা সহজ নয়! 
আমাদের সাথে যুক্ত হবেন যেভাবেঃ- 

টেলিগ্রাম- ছাড়পত্র

ফেসবুক গ্রুপ- গল্প junction


ফেসবুক- ছাড়পত্র

” জীবনের চরম বাস্তবতা। বাংলা গল্প। bengali real life story”

Spread the love

Leave a Reply