ছেলেদের জীবন কঠিন বটে! কিন্তু মধ্যবিত্ত ছেলেদের জীবনের গল্প টা একটু অন্যরকম। তাদের জীবনেও গল্পের বই থাকে ঠিকই, কিন্তু কালির অভাবে তাদের গল্পের বইয়ের আবছা লেখা, কোনো এক অজানা প্রাচীন লেখকের ভিত্তিহীন কাহিনীর মত মনে হয়, সমাজের কাছে।

মধ্যবিত্ত ছেলেদের জীবনের গল্পঃ- ”পুরুষ”

পুত্র হয়ে জন্ম নিয়ে করলে ঘর আলো , আবার

স্বামী রূপে তুমিই সংসারে মূল প্রদীপটা জ্বালো ।

পিতা হয়ে শিক্ষা দেওয়া তোমার যেন কর্তব্য, আবার

দাদু হয়ে পাশে থাকা তোমার নিস্বার্থ দায়িত্ব।

আজ গল্পটা আমার এক পুরুষকে নিয়ে যার মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠেছে সমাজের সব পুরুষদের অবস্থান।

একদিন কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার সময় বাসের জানালা থেকে দেখতে পেলাম একটি ছেলেকে, দামোদরের ব্রিজটার একদম রেলিং ঘেঁষে ছেলেটা দাড়িয়ে ছিলো। ওকে ওই অবস্থায় দেখে দৌড়ে গেলাম ওর কাছে। জামাটা ধরে হ্যাঁচকা টান না দিলে, হয়তো ও ঝাঁপিয়ে তখনি ওই দুঃখের নদে নিজের জীবন স্রোত হারিয়ে ফেলতো।

ছেলেদের জীবনের গল্প
ছেলেদের জীবনের গল্প

আচমকা এই জীবনের শেষ মুহূর্তে কে ওকে আবার বাঁচাতে চাইলো ভেবে বিরক্তির সাথে , পেছন ঘুরে এক ঝটকা হাত টা ঘোরাতেই, একটু দূরে ছিটকে গেলাম ।
ক্লান্ত অবসন্ন দুটো চোখ ছল ছল করে আমার দিকে আসামির মতো নজর দেগে রইলো ।
“কেন বাঁচালে আমায়? এতো বড়ো ক্ষতি টা কেন করলে ?”
হতবাক হয়ে আমি ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম।
কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞাসা করলো “তোমরা আমাদের কি ভাবো”? “পুরুষ” না “সহ্য করার যন্ত্র” ? কোনটা উত্তর দাও! দাও উত্তর!

দাদার সমবয়সী একটি ছেলের কাছে এমন প্রশ্ন শুনে থমকে গেলাম ।

ছেলেটি ব্যাগ থেকে একটা ডাইরি বের করে হাতে তুলে দিয়ে বললো সময় পেলে এটা পড়ে নিও। আর পারলে পুরুষ জাতিকেও একটু বোঝার চেষ্টা কোরো। আমরাও মানুষ , যন্ত্র নয়। আমাদেরও অনুভূতি আছে…।

এরপর,
ছোট্ট একটা শব্দ “ধন্যবাদ” কানে ভেসে এলো। তারপর ভিড়ের মাঝে সেও যেন কোথায় হারিয়ে গেলো।
তবে তার ডায়রীটা পড়ার পর পুরুষ জাতীর প্রতি সন্মান আরো অনেক গুণ বেড়ে গেলো ।
ছেলেটি তার সমস্ত মনের কথা ওই ডায়রিতে লিখে রেখেছে ।

সরাসরি ডায়রির ভাষাতেই শুরু করা যাক-

ছেলেদের জীবন নিয়ে গল্প
ছেলেদের জীবন নিয়ে গল্প

“আমি নীলাঞ্জন , ভৈরবপুরে আমার বাড়ি । জন্ম থেকেই অভাব অনটনের মধ্যে দিয়ে বড় হয়েছি । বাবা পেশাতে কৃষক। তাই যে বছর ফসল হয় না সে বছর দুবেলা অন্ন জোটাতে বাবাকে অন্যের বাড়ি মুনিশের কাজ করতে হয় । তাও কোনোদিনও বাবাকে আমার পড়াশোনার জন্য চিন্তায় পড়তে হয়নি । সেই ছোট থেকে দোকানে কাজ করে তারপর উচ্চমাধ্যমিকের পর টিউশন পড়িয়ে নিজের পড়াশোনার দায়িত্ব নিজেই নিয়েছি। মাঝে মাঝে স্কুল ফিস বা টিউশন ফিস না দিতে পারার জন্য মাসের পর মাস টিউশন কামাই করেছি , স্কুল থেকে গার্জেন মিটিং এর জন্য ডাকলে দু এক সপ্তাহ স্কুল বন্ধ করে নানান জায়গায় কাজ করে টাকা জমিয়েছি । যখন চারিদিকের চাপা চিন্তা মাথা ঘিরে বসেছে তখন এক ফোঁটাও চোখের জল ফেলতে পারিনি । ছোট থেকেই শিক্ষা দেওয়া হয়েছে আমায় “তুই না ছেলে ,কাঁদছিস কেন? ছি ছি,তুই আবার কি কাঁদবি? ছেলেদের কাঁদতে নেই যে । ছেলেরা কাঁদলে দুর্বল প্রতিপন্ন হবে ।”

হ্যাঁ আমি পুরুষ , আমার শত দুঃখ কষ্ট থাকলেও আমায় কাঁদতে নেই, এই বলেই বারবার নিজেকে সামলে নিয়েছে । সব দায়িত্বকে মাথা পেতে নিতে শিখেছি অল্প বয়সেই । তাই হটাৎ করে যখন মায়ের মৃত্যু হলো তখন পুরো সংসার টাই যেন অগাধ সমুদ্রে ভেসে যাওয়ার মতো অবস্থায় দাড়িয়ে তখন সংসার রক্ষার দায়িত্ব টাও আমার মাথাতেই এসে পড়লো । বাবা পাশের গ্রামের তার এক বন্ধুর মেয়ের সাথে বিয়ে ঠিক করে দিল।

একবারও কেও জিজ্ঞাসা করলো না “নীলাঞ্জন তোর বিয়েতে মত আছে তো?’ তুই মাত্র বাইশ বছর বয়সে একটা মেয়ের দায়িত্ব নিতে পারবি তো ? তোর জীবনে কিছু স্বপ্ন আছে , সেগুলো বিয়ে হওয়ার পর পূরণ করতে পারবি তো? ‘

পড়ুনঃ- রহস্যময় গল্প- যূথিকা টেলারস 

মাত্র বাইশ বছর বয়সে একটি ষোলো বছরের নাবালিকা মেয়ের দায়িত্ব আমার ঘাড়ে তুলে দিয়ে মেয়েটির বাবা বললেন ‘অনেক কষ্ট করে মেয়েকে যত্নে ছোট থেকে মানুষ করেছি । এবার তোমার দায়িত্বে আমার মেয়েকে সমর্পণ করছি বাবা! আমার মেয়ের যেন কোনো অসুবিধে না হয়, সেদিকে একটু খেয়াল রেখো!’

বিয়ের দুই মাস পরেই বাবা একটা টোটো কিনে দিয়ে বলল ‘আর বৌমার ভাতের দায়িত্ব যাতে আমাকে নিতে না হয় তাই চাষের জন্য যে লোনের টাকাটা নিয়েছিলাম সেটাতেই এটা কিনে আনলাম । এবার থেকে এটা চালাবি।’

অবসন্ন মনে জিজ্ঞাসা করলাম ‘বাবা আমি যে M A তে ভর্তি হয়েছি এত কষ্ট করে নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছি । এসব চালাতে শুরু করলে আমার পড়াশোনার কি হবে?’

বাবা বিরক্তির সুরে বলেছিল- ‘ধুর ধুর ওসব পড়াশোনা করে যে কি লাভ? তোর মত অমন কত B.A , M.A পাস করা ছেলে গরু ছাগল চরিয়ে বেড়াচ্ছে তার ঠিক নেই আর সেখানে তো আমি তোকে টোটো কিনে দিলাম, তোর ভাগ্য ভালো। ওসব পড়াশোনার কথা আমার কাছে বলিস না।’

বাবার কথা গুলো তীরের মতো বুকে বিঁধেছিল সেদিন। ভেবেছিলাম বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাবো কিন্তু পিছুটান ছিল মেয়েটা , যার বাবা আমার ওপর তার দায়িত্ব তুলে দিয়েছে।

তারপর থেকে টোটো নিয়ে বেরোলে পাড়ার লোকের উপহাসের পাত্র হয়ে উঠলাম- কেউ দেখলেই বলত ‘ওই যে চললো B.A পাস টোটো-ওয়ালা’ । নিজের শিক্ষার প্রতি নিজের দায়িত্ব কে চড়াও হতে দেখে, ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম । এমন সময় জীবনে যখন আমি দিশেহারা তখন শুরু হলো কম বয়েসী বউয়ের নিত্য নতুন বায়না আর বাহানা । পকেট সবসময় গড়ের মাঠ ,ভরাট হওয়ার কোনো অবসর এই রাখত না আমার বউ।

পড়ুনঃ- দুই বোনের উধাও রহস্য 

সারাদিন কাজ করে বাড়ি ফেরার পর যখন নিজের খাবার টুকুও নিজেকেই বানাতে বসতে হয় তখন সন্ন্যাস জীবনটাকেই সুন্দর মনে হয়। আমার সাথেও হচ্ছিল তাই। বাইরের কাজ বাড়ির কাজ , বউয়ের অহেতুক বায়না সব মিলিয়ে জীবন একেবারে নাজেহাল অবস্থা। ঠিক সেই সময় কিছু পাড়ার লোকের সঙ্গদোষে একটা নেশা আমার ‘বন্ধু’ হয়ে উঠলো। যার মাধ্যমে সব চিন্তা থেকে আমি মুক্তি পেতাম।

বাড়িতে বউয়ের কথা শোনার ভয়ে, পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানের আড়ালে মদের ডেরাতে যাতায়াত শুরু হলো আমার । প্রতিদিন রাত্রে মদের নেশায় টোল হয়ে বাড়ি ফিরে, সব জমিয়ে রাখা রাগ অভিমান , মনের কথা গুলো চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে , পরম শান্তি অনুভব করতাম।

এর কিছুদিন পর থেকেই আমার শশুর বাড়ী থেকে দল দল লোক আসতে শুরু করলো । তাদের বক্তব্য ‘ছেলেটার চরিত্র ভালো শুনে বিয়ে দিয়েছিলাম আমরা। এমন মাতাল ছেলে, জানলে কখনো বিয়ে দিতাম না। জামাই এখনো সময় আছে নিজেকে শুধরে নাও, নইলে কিন্তু নিজেদের মেয়েকে নিয়ে আমরা চলে যাবো। কম বয়স্ক সুন্দরী মেয়ে আমাদের পাত্রের অভাব হবে না।’

পড়ুনঃ- নতুন হাসির জোকস 

সত্যিই আমি খুব ভদ্র শান্ত, কিন্তু মদের নেশায় আমি হয়ে উঠি প্রচন্ড উগ্র। তাই এত কথা শোনার পর দিন দিন আরো কেমন যেন হয়ে উঠলাম আমি! আর কিছুতেই মন বসছে না আমার । বউয়ের কোনো বায়নার পরোয়া করি না। নিজের রোজগার করা টাকা তে শুধু নিজের নেশার কথা ভাবি। এমনই একদিন খুব নেশা করে বাড়ি ফিরেছি তখন দেখি বউ হাতে একটা চাকু নিয়ে দরজার সামনে দাড়িয়ে। ওর কাছে যাবার চেষ্টা করতেই ও বলে উঠলো, ‘তুমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও নইলে আমি নিজেকে শেষ করে ফেলবো’ আমিও ওর হাতের থেকে চাকুটা ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করলে , জোরাজুরির সময় বুঝতেও পারলাম না কখন চাকুটা ও ওর গলায় চালিয়ে নিয়েছে। আমার চোখের সামনে মেয়েটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

আমি কোনরকমে ওকে হসপিটাল নিয়ে গেলে , ডাক্তার বলল বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম। পরের দিন হসপিটাল ভর্তি হয়ে গেল ওদের গ্রামের লোকে। সবাই আমাকে দোষারোপ করতে শুরু করলো। কেউ কেউ হাত তুলতে এলে , নিজেরাই থামিয়ে বললো ‘এই ব্যাটাকে পুলিশের হাতে তুলে দেবো , তারাই একে যোগ্য শাস্তি দেবে।’

আমি ভয়ে পালিয়ে গেলাম সেখান থেকে। পরের দিন এক বন্ধুর কাছে খবর পেলাম , বউয়ের জ্ঞান ফিরেছে , সে ভালই আছে। তবে তার এই অবস্থার জন্য, সে নিজে পুলিশের কাছে আমার নাম নিয়েছে। তাই পুলিশ হন্যে হয়ে আমায় খুঁজছে ।

ছেলেদের কাঁদতে নেই
ছেলেদের কাঁদতে নেই
<

আজ এই diary তে আমি আমার শেষ কিছু কথা লিখে গেলাম। আজ আমি আমার জীবনের কাছে হেরে গেছি। হেরে গেছি শুধুমাত্র একটা কারণেই ‘আমি পুরুষ’। কষ্ট হলে আমাকে কাঁদতে নেই। নিজের স্বপ্ন পূরণের আগে নিজের পরিবারের দায়িত্ব আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ । জীবন সঙ্গীর কাছেও আমি শুধু মাত্র একটা ATM মেশিন মাত্র! তাই সে কখনোই আমাকে বোঝার বা জানার চেষ্টা করেনি শুধু দরকার মত ব্যবহার টুকু করে গেছে। ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখার চেষ্টা করেনি। ‘পুরুষ’ আমি তাই সব সহ্য আমাকেই করতে হবে নইলে সমাজের চোখে হয়ে উঠব ‘ব্যর্থ পুরুষ’ তথা ‘কাপুরুষ’ ! আজ নিজেকে শেষ না করলে হয়তো সারাজীবন টানতে হবে জেলের ঘানি।

কখনও সন্তান কখন স্বামী আবার কখনো বাবা , সব সম্পর্কের মূল ভিত্ টাই তো আমরা । আমাদের ভুল করতে নেই । আমাদের রাগ করতে নেই। আমাদের সবসময় একটা বন্ধনে মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হয় নিজেদের , নইলে যে হেয় প্রতিপন্ন হব সমাজের চোখে । আমাদের বাইরের কঠিন আভরণের ভেতরেও যে একটা নরম , প্রাণোচ্ছল মন আছে সেটা সবার সামনে দেখানো সম্ভব নয় আর সেটাকে কেউ খুঁজে বের করবে এমন মানুষেরও খুব অভাব । তাই আজ এখানেই দুঃখের নদে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়ে মুক্তি পেতে চাই । ডাইরিটা শেষ পাতা জুড়ে শুধু লিখে যেতে চাই ‘পুরুষ মানেই খারাপ নয় , পরিস্থিতির শিকার সবাই হয় । তবে সবাই জয়ী হয়ে উঠতে পারে না ।”

পুরোটা পড়ার পর , নিজে থেকেই অশ্রু বিন্দু গড়িয়ে পড়ছিল ওই ডাইরির পাতায়। বারবার মন আমাকে একটাই প্রশ্ন করে চলেছে সেদিন থেকে ‘ছেলেটিকে বাঁচিয়ে আমি ঠিক করেছিলাম না ভুল?’

পারলে আপনারাই একটু উত্তরটা খুঁজতে সাহায্য করবেন।

আলোরানি মিশ্র

গল্পের নিহিত ভাবনায়-
আলোরানির আরও কিছু লেখা- 

হতাশা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প 

রহস্যময় সেই ভয়ানক রাত! 

মা-কে নিয়ে একটি হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া গল্প 

“মধ্যবিত্ত ছেলেদের জীবনের গল্প। ছেলেদের জীবন নিয়ে গল্প। ছেলেদের কাঁদতে নেই”

Spread the love

Leave a Reply