সমাজে বাস করলেই শুধু সামাজিক হওয়া যায় না। সৎ ভাবনা চিন্তাই মানুষকে সামাজিকতার পথে চালিত করে। আজকের এই অসাধারণ ছোট গল্প টির মাধ্যমে সমাজের একটি তিক্ত অভিশাপের বিরুদ্ধে এক তরুণীর সংগ্রামকে এঁকেছেন লেখিকা।
অসাধারণ ছোট গল্পঃ- ‘রক্ষাকর্ত্রী
আচমকা বাসের ব্রেক টা কসাতেই টিয়া লক্ষ্য করলো , সামনে যেন কিছু একটা বড়মাপের ঝামেলা হয়েছে । বাস থেকে সবাই নেমে যেতে শুরু করল কিন্তু এই সন্ধ্যার অন্ধকারে সে ঠিক কি করবে স্থির করতে পারছিল না । ফাঁকা বাস আর ফাঁকা রাস্তার পরিস্থিতি যে সমান সেটা বোঝার পর টিয়া দ্রুত গতিতে বাস থেকে নেমে পড়লো।
চারপাশটা বারবার লক্ষ্য করতে করতে এগিয়ে চললো , চারিদিকের ঘন অন্ধকার যেন তার দিকে ধেয়ে আসছে বলে মনে হচ্ছিল ওর। বারবার মনে পড়ছিল তার মা তাকে আগেই বলেছিল বন্ধুদের সাথে বিকেলে দেখা না করতে , সন্ধ্যা হয়ে গেলেই এই রুপমহলের রাস্তাটা মেয়েদের জন্য ঠিক সুবিধার নয়।
মায়ের কথা অমান্য করে সে বন্ধুদের কাছে গিয়েছিল এখন যদি কোনো বিপদ হয় তাহলে তার দায় শুধু তার এই । বাবাও বলেছিল মেয়েদের রাত্রে বেলা বাড়ি থেকে বেরোনো বা ঢোকা কোনোটাই সোভা পায়না। খবরের কাগজে প্রায় এই যা সব ঘটনা দেখা যায় তাতে মেয়েদের জন্য দিনকাল সুরক্ষিত নয় । কিন্তু বাবা মায়ের এসব কথাকে অবান্তর বলেই উড়িয়ে দিয়েছে টিয়া। তবে আজ সত্যিই ও ভীষণ ভয় পাচ্ছে । হটাৎ করে কিসের যেন একটা আওয়াজ উঠলো পেছন ফিরে তাকাতেই তার মাথায় কেউ যেন খুব জোরে আঘাত করলো…।
জ্ঞান ফিরলো যখন তখন ও হসপিটালের বেড এ। খুব দূর্বল অনুভব করলো । আশে পাশে দেখলো কিন্তু তার মা বাবা বা কোনো আত্মীয় কে দেখতে পেলো না । একটি নার্স কে দেখতে পেয়ে ডেকে জিজ্ঞাসা করলো ‘দিদি আমার কি হয়েছে ?’ নার্স মেয়েটি মাথা নিচু করে জানালো ” বেশ কয়েকদিন হলো তুমি এখানে ভর্তি আছো। কয়েকদিন আগে রাত্রে বেলায় পুলিশ তোমায় নিয়ে আসে , তোমার কোনো পরিবারের সদস্য আমাদের সাথে যোগাযোগ করেনি । তারা তোমায় চিনতে অস্বীকার করেছে। কথাগুলো বিশ্বাস করতে পারে না টিয়া, ও আবার জিজ্ঞাসা করে -” আমার কি হয়েছে ” ?
নার্স মেয়েটি কাপা গলায় বলে, “তোমাকে সমাজের কিছু কিট কামনাপূর্তির উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছে।” বিশ্বাস করতে পারছিল না টিয়া খবরের কাগজে পড়েছে ধর্ষনের কথা কিন্তু আজ সে নিজেও তার শিকার । সবটা সামলে উঠতে তার সময় লাগে। পুলিশ জ্ঞান ফেরার পর জেরা করতে শুরু করে। কিন্তু টিয়ার কাছে কোনো উত্তর নেই, কারণ রাত্রের অন্ধকারে সেদিন ও সত্যি কিছুই দেখতে পায়নি। হসপিটাল থেকে ছুটি পাওয়ার পর বাড়ি ফিরে আসার সময় রাস্তায় তাকে অনেকেই ভৎসনা করে। বাড়ির দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই তার বাবা তাকে মেয়ে বলে অস্বীকার করে , বের করে দেন বাড়ি থেকে ।
পড়ুনঃ- গল্পের মাধ্যমে নৈতিক শিক্ষা
টিয়া দিশেহারা হয়ে খুঁজে পায়না কোথায় যাবে সে! সে কয়েকটি বান্ধবীর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে তবে তাকে সাহায্য করতে কেউ রাজি হয়না, সবার একই কথা বাড়িতে মেনে নেবে না। টিয়া এটুকু বুঝতে সক্ষম হয় যে বন্ধুদের সাথে দেখা করার জন্য আজ তার এই অবস্থা সেই বন্ধুরা তার ঠিক কতটা আপন! টিয়ারই এক সহপাঠী হলো অরুণ , ছেলেটি খুবই চুপচাপ আর শান্ত স্বভাবের। টিয়ার ঘটনাটি শোনার পর, সে বেশ কয়েকবার তাকে হসপিটালে দেখতেও গেছিলো কিন্তু সবার অজান্তে। তবে টিয়া অরুণ কে খুব একটা পছন্দ করত না বরঞ্চ মাঝে মধ্যে ওকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করতো।
আজ এই বিপদের দিনে সেই অরুণই টিয়ার পাশে এসে দাড়ালো। একটি ভাড়া বাড়িতে থাকে সে, সেখানেই নিয়ে গেলো টিয়াকে সাথে করে । টিয়াকে কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করতে বারণ করলো আর নির্দ্বিধায় টিয়ার সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলো।
মাস তিনেক পেরোলো এর মধ্যে রুপমহলের রাস্তায় টিয়ার মত আরো ৩ টি মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছে । এবার সে ঠিক করলো এর একটা বিহিত করা উচিত। তার মতো আর অন্য মেয়েদের জীবন নষ্ট হতে সে দেবে না। অরুণ এর সাথে সে একটা প্ল্যান করলো , অরুণ মেয়ে সেজে রাত্রের অন্ধকারে ওই রাস্তা দিয়ে নূপুর পরে যাবে আর আড়ালে টিয়া পুলিশ নিয়ে অপেক্ষা করবে। ওই রাস্তার জানোয়ার গুলোকে আজ অব্দি অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও পুলিশ ধরতে পারেনি তাই পুলিশ ওদের সাহায্য করবে বলে কথা দিল।
নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও অরুণ রাত্রে বেরিয়ে পড়লো মেয়ে সেজে । হঠাৎ করে একটা আওয়াজও উঠলো অরুণ পিছু ফিরতেই মাথায় নয় সিধা একটা গুলি ওর পেটের ওপর আঘাত করলো। পুলিশ ওই জানোয়ার গুলোকে অ্যারেস্ট করলেও, উঁচুতলার মানুষের সহায়তা তে ছাড়া পেয়ে গেলো কিন্তু অরুণ হসপিটালের বেড এ ভর্তি, তার জীবন সংকট এখনো কেটে উঠেনি।
টিয়ার প্রতিশোধ এর স্পৃহা আগুন এর মত জ্বলে উঠলো , নিজেই তার মতো অত্যাচারিত মেয়েদের খোঁজ করে করে একটি টিম গড়ে তুললো। তারা নিজেরাই নিজেদের বদলা নেবে বলে প্রতিজ্ঞা করলো। পুলিশ বেশ অবাক একসাথে রূপমহলের ওই রাস্তায় ৭ টা লাশ , সেগুলো আবার ওই জানোয়ার গুলোর । আসলে টিয়া আর ওর টীম এর কাজ ছিল এটি। কিন্তু পুলিশ কোনো কূলকিনারা পেলো না কিভাবে এতগুলো খুন হলো। পরিকল্পনা মাফিক প্রমাণ ছাড়াই সবটা করেছিল ওরা।
পড়ুনঃ- বাস্তবতার গল্প- জনগণের রক্তে সুখ খোঁজা নরপিশাচ
এরপর টিয়া অরুণ কে নিয়ে নিজের স্বপ্নের সংসার কিভাবে গড়ে তুলবে সে নিয়েই চিন্তায় যখন মত্ত হঠাৎ করে হসপিটাল থেকে কল এলো অরুণ আর নেই । প্রথমে পরিবার তারপর অরুণ সবার একে একে তাকে ছেড়ে চলে যাওয়া আর সহ্য করতে পারলো না টিয়া , আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু শেষ বারের মত অরুণকে দেখতে ছুট্টে গেলো হসপিটালে , অনাথ অরুণ একদিন এই অনাথ টিয়াকে আশ্রয় দিয়ে তার দায়িত্ব নিয়েছিল কিন্তু আবার তাকে অনাথ করে দিয়ে চলে গেলো।
হসপিটাল পৌঁছে অরুণ এর একটা চিঠি পেলো যেখানে অরুণ এর শেষ ইচ্ছে টিয়া ওর মতো নির্যাতিত মেয়েদের পাশে দাড়াক আর গড়ে তুলুক নিজেকে রক্ষাকর্ত্রী রূপে।
এরপর ১০ বছর পেরিয়ে গেছে এখন টিয়াকে পুরো দেশ চেনে। ধর্ষণকারীদের যম নামেই ও বেশি পরিচিত। নৃশংস ভাবে হত্যা করে সমাজের কীটদের নির্দ্বিধায়, কিন্তু প্রমাণ ছাড়া। মন বলে কিছুই নেই আর ওর কাছে যা আছে তা শুধু অত্যাচারিত মেয়েদের প্রতিশোধের স্পৃহা। পুলিশ চেষ্টা করলেও তার ধরা ছোঁয়া পায়না আবার কোনো কোনো বার সাধারণ মানুষের অজান্তেই পুলিশ ও তাকে সাহায্য করে । এভাবেই টিয়া সমাজ কে নির্মল করতে, মেয়েদের জন্য সুস্থ সমাজ গড়ে তুলতে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে এই সমাজকল্যাণ মূলক কাজে।
সত্যিই সমাজকে নির্মল করতে হলে এমন টিয়ার বড্ডো প্রয়োজন আমাদের। আমাদেরই গড়ে তুলতে হবে গল্পের টিয়ার বাস্তব রূপকে। নিজেকেই নিজের রক্ষা করতে হবে…।
গল্পের ইতিবাচক ভাবনায় –
ছাড়পত্রে লেখা পাঠাতে পারেন- charpatrablog@gmail.com -এই মেইল অ্যাড্রেসে, অথবা আপনার লেখাটি WhatsApp -এর মাধ্যমে পাঠানোর জন্য এখানে ক্লিক করুন।
আলোরানির যে লেখাগুলি পাঠকের পছন্দ হয়েছে- একটি শিক্ষণীয় ঘটনা মধ্যবিত্ত ছেলেদের জীবনের গল্প রহস্যময় সেই রাত
ছাড়পত্রের সমস্ত আপডেট পাবেন যেখানে-
ফেসবুক Group - গল্প Junction
ফেসবুক- ছাড়পত্র
টেলিগ্রাম- charpatraOfficial
WhatsApp Group- ছাড়পত্র (২)
অসাধারণ ছোট গল্প। সামাজিক ছোট গল্প। 1 best bengali short story
কি কেন কীভাবের উপর গড়ে ওঠা মানুষের জিজ্ঞাসু মন সর্বদাই নতুন দিগন্তের সন্ধানে পা বাড়ায় ৷ প্রতিটি পদক্ষেপেই নতুন কিছু অভিজ্ঞতা আমাদের ঝুলিতে জমা হয় ৷ সেই অভিজ্ঞতা সকলের সাথে ভাগ করে নেওয়ার মধ্যে এক অফুরন্ত আনন্দ লুকিয়ে থাকে ৷ আর সেই কাজেই হাত বাড়িয়েছে ছাড়পত্রের টিম।
ধন্যবাদ।।