প্রিয় মানুষকে হারানোর কষ্ট, যে প্রিয়জন হারিয়েছে সেইই শুধু জানে, বাকিরা তো শুধু বাহ্যিক আড়ম্বরপূর্ণ ‘সান্ত্বনা প্রদানেতেই’ মানে। প্রিয়জনকে হারানোর বেদনা কোনো শারীরিক বেদনা নয়, যে তার উপশম সহজে করা সম্ভব। এই বেদনা যে একান্ত আন্তরিক, হৃদয়ের গভীর থেকে জন্ম হওয়া বেদনা।

প্রিয় মানুষকে হারানোর কষ্ট:- ‘সৃজা’

সৃজার সাথে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে, এক অনুষ্ঠানে। বেশ মনে আছে, স্কুলের পরীক্ষা শেষে তখন আমি, মামা বাড়িতে ছুটি কাঁটাতে যাই। আমার মামা বাড়ির দাদুর রিটায়ার অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। সেই অনুষ্ঠানেই আমার পরিচয় হয় সৃজার সাথে। তার বাবাও ওই স্কুলেরই একজন শিক্ষক।

যেহেতু আমরা একই শ্রেণীতে পড়তাম, নিজদেরই অজান্তে কখন আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল তা আমাদের নিজেরও জানা ছিল না। মামা বাড়ি থেকে সৃজার বাড়ি বেশি দূরে নয়, তাই মামা বাড়ি গেলেই দাদু নিয়ে যেতেন সৃজাদের বাড়ি। দাদু জমিয়ে গল্প করতেন সৃজার বাবার সঙ্গে, আর এদিকে আমরা দুই ক্ষুদে বন্ধু খেলায় ব্যস্ত।

তখন আমাদের বয়স বেশি নয়, সবে ১২ কি ১৩ বছর হবে। স্বভাবতই বর্তমানের মত স্মার্টফোন বা WhatsApp এর সুবিধা তখন ছিল না। আমার বাড়ির অবস্থাটা তখন এমন ছিল যে, স্মার্টফোন তো দূরের কথা, বোতাম যুক্ত মোবাইলও আমাদের ছিল না। তাই সৃজার সাথে আমার কথা হত, বছরে হাঁতে গোনা মাত্র কয়েকবার।

প্রিয় মানুষকে হারানোর কষ্ট
প্রিয় মানুষকে হারানোর কষ্ট

এভাবেই কেটে গেল কয়েকটা বছর। তবে তখনও কিন্তু আমরা অত ভালো বন্ধু হয়ে উঠি নি। এরপর যখন মাধ্যমিক পাশ করলাম, আমাদের বাড়িতে মোবাইল এল, তখন থেকে প্রায়ই কথা হতে শুরু করে।

ততদিনে আমরাও বেশ বড় হয়ে উঠেছি। আমাদের বন্ধুত্বে বিশাল মোড় তথা আমাদের বন্ধুত্বকে আরও কাছকাছি এনে দেয়, জলপাইগুড়িতে আয়োজিত একটি কুইজ প্রতিযোগিতা। সেই প্রতিযোগিতায় প্রতিটি দলে তিনজন সদস্য ছিল, সৃজার দলে দুইজন সদস্য হলেও আরেকজন কিছুতেই তাদের মনমত হচ্ছিল না, সৃজা তার বাবার পরামর্শে আমাকে তাদের দলে নিয়ে নেয়।

যেহেতু স্কুলের পরীক্ষা শেষের সময় ছিল, তাই পড়াশোনার চাপ ছিল না, থেকে গেলাম মামা বাড়িতেই, সেখান থেকে রোজ সৃজার বাড়িতে গিয়ে কুইজের জন্য সবাই মিলে প্রস্তুতি গ্রহণ করা। জানতে চান সেই প্রতিযোগিতার ফলাফল!

সেই প্রতিযোগিতায় আমরা পুরো জেলার মধ্যে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। এভাবেই আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক আরও মজবুত হয়। তবে মেয়েদের প্রতি আমার বরাবর এলার্জি। আমি সবসময় মেয়েদের এড়িয়ে চলতেই পছন্দ করি। তবে সৃজার বেলায় সেই জারুজুরি কেন যেন কিছুতেই কাজ করছিল না।

পড়ুনঃ- ওয়ান সাইডেড লাভ স্টোরি 

বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানসিকতারও পরিবর্তন হতে শুরু করে। যতই ভাবি মেয়েদের সাথে বন্ধুত্ব করা ঠিক না, সৃজার সাথে আমার বন্ধুত্বে ইতি টানা উচিত, ততবারই বিভিন্ন ঘটনা আমাদের বন্ধুত্বকে আরও মজবুত করেছে।

এখনও সেই স্মৃতি টাটকা আছে। আমি মামারা এবং সৃজা ও তার বাবা-মা জলপাইগুড়ির একটি পার্কে ঘুরতে যাই, বড়রা আছে বড়দের মত, আমরা দুই বন্ধু তিড়িং বিরিং করে ঘুরে বেড়াচ্ছি। এমন তিড়িং বিরিং করে লাফাতে লাফাতে কখন যে পা পিছলে পার্কের পুকুরে পরে গেছি তা আমার ঠিক মত মনে নেই।

তখন আমি মাধ্যমিক পাশ করা ছাত্র হলেও, সাঁতার জানতাম না। উপস্থিত সবাইকে অবাক করে দিয়ে সৃজা সেই পার্কের পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে আমায় ডাঙ্গায় তুলে এনেছিল। মামারা দৌড়ে আসতে আসতে আমি ততক্ষণে বেশ নিরাপদ। বেশ বাহবা কুড়িয়েছিল সেদিন সৃজা। আর আমাকে, বড়ই লজ্জার মুখে পরতে হয়েছিল, লজ্জা তো লাগারই কথা, একজন শহুরে মেয়ে হয়েও সৃজা সাঁতার পারে আর আমি একজন গ্রামের ছেলে হয়েও সাঁতার পারি না।

কিন্তু সেদিন সৃজার এই বাহাদুরি আমাকে বেশ অবাক করেছিল, সে চাইলেই চিৎকার করতে পাড়ত, কিন্তু তা না করে সে নিজের জীবনের কথা না ভেবে আমাকে বাঁচানোর জন্য পুকুরে ঝাঁপিয়ে পরেছিল।

সে যাই হোক এভাবে বেঁচে বাড়ি ফেরার পর, আমার প্রথম কাজ ছিল, ‘যেন তেন প্রকারেণ’ সাঁতার শেখা। এরপর আমি অবশ্য সাঁতার শিখে ফেলি।

প্রিয়জনকে হারানোর বেদনা
প্রিয়জনকে হারানোর বেদনা

এরপরের ঘটনার হিরো অবশ্য আমি, সৃজার জ্যেঠুর ছেলের বিয়ে ছিল। নিমন্ত্রণ পেয়ে আমিও দৌড়ে গেছি। বাড়ির ভিতরে ঢুকতে না ঢুকতেই সৃজার সাথে দেখা, জানি না সে যে ড্রেসটি পরিধান করে ছিল, সেটির নাম কি ছিল, কিন্তু আমি কিছু মুহূর্তের জন্য হলেও তাকে দেখে স্তব্দ হয়ে গেছিলাম। যাক গে সে সব কথা! আসল ঘটনায় আসি।

বিয়ের অনুষ্ঠানের মাঝেই আমাদের সবার কানে একটি চিৎকার আসে। আমি বেশ বুঝে গেছি এটি সৃজার চিৎকার। উপস্থিত সবাই চিৎকার করছে- ‘কাপড় খুলে ফেল কাপড় খুলে ফেল’। আমি দেখলাম সৃজার কাপড়ের বাড়তি অংশে আগুন লেগেছে, বুঝলাম চরকিতে আগুন লাগানোর সময় সেখানে আগুনের ফুরকি পড়েছে।

সবার চিৎকার কে পাত্তা না দিয়ে, দান সামগ্রীর মধ্য থেকে ভাঁড়ি কম্বলটাকে তুলে নিয়ে সৃজাকে সেই কম্বলের ভিতরে পেঁচিয়ে ফেললাম। আমাকে সাহায্য করতে কয়েকজন ছুটে এলেন। আমাদের এই প্রয়াসে আগুন নিমিষেই নিভে যায়। অবশ্য এই টেকনিকটি আমি পড়েছিলাম আমাদের পরিবেশ শিক্ষার বইয়ে। আর সেই টেকনিকটিকেই এখানে কাজে লাগাই। আমি অবাক হয়ে যাই, এটি দেখে যে, এত শত শত মানুষের ভিড় বিয়েতে অথচ, কেউই সৃজাকে বাঁচানোর চেষ্টা না করে দূর থেকে উপদেশ দিচ্ছে!

যাই হোক এই ঘটনায় সৃজার তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি, শুধু ওর প্রিয় জামাটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এভাবেই আমি সৃজা ও তার পরিবারের আরও কাছের হয়ে উঠি।

পড়ুনঃ- ব্রেক-আপ হওয়ার গল্প-Goodbye 

এরপর উচ্চ-মাধ্যমিক পাশ করে কলেজে…। ততদিনে আমাদের বন্ধুত্ব এতটাই মজবুত হয়ে গেছে যে, আমাদের সমবয়সী সৃজার বন্ধু-বান্ধবীরা রটিয়ে বেড়াতে থাকে যে, আমরা দুইজন লাভ রিলেশনে আছি! তা বলুক গে, তাদের কথায় আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হবে কেন!

আমার হাঁতে প্রথম স্মার্টফোন আসে কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে। সৃজা অবশ্য এর অনেক আগেই স্মার্ট ফোন কিনে ফেলেছিল। বন্ধুত্বের সম্পর্কে নতুন মোড় আসে। যোগাযোগ হয়ে উঠে আরও সহজ।

পড়াশোনা থেকে শুরু করে প্রজেক্টের কাজ, সবতেই আমরা একে অপরের সহায়ক।

কিন্তু এহেন সম্পর্কেও টর্নেডোর মত পেঁচিয়ে দুঃখের ঘূর্ণিঝড় চলে আসে। গত ২৩ ডিসেম্বর ২০২২, ঘড়ির কাঁটায় সময় ঠিক ৫.১৫ আমার কাছে সৃজার এক বন্ধুর ফোন আসে। সেই এক ফোনেই আমার বাকরুদ্ধ অবস্থার সৃষ্টি হয়। ফোনের ওপারে থাকা সৃজার বন্ধু কাঁদতে কাঁদতে আমাকে জানায়, গরুবাথান থেকে পিকনিক করে ফেরার পথে তাদের গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।

গাড়িটির গতি এতটাই জোরে ছিল যে, সেটি অনেক দূর পর্যন্ত ছিটকে যায়। আর এই ঘটনায় সৃজা সহ আরও দুইজন জখম হয়েছে। জানালার পাশে বসে থাকায় সৃজা অনেক বেশি চোট পেয়েছে। গাড়ির সাইড পিলার ভেঙ্গে একটি রড তার মাথায় প্রবেশ করেছে। সে জ্ঞান হারিয়েছে, তাকে শিলিগুড়ির একটি নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। 

প্রিয় মানুষ
প্রিয় মানুষ প্রিয় মানুষকে হারানোর কষ্ট
<

সেই পিকনিকে আমারও যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু কাজের চাপে আমি তাদের সাথে যোগ দিই নি।

এরপর আর বিন্দুমাত্র সময় আমি নষ্ট করিনি, বাবা মাকে পুরো ঘটনাটি জানার পর তখনই গাড়ি নিয়ে ছুটি শিলিগুড়ির সেই নার্সিং-হোমে। সেখানে জানতে পারি সৃজাকে ICU তে ভর্তি করা হয়েছে। তখনও জ্ঞান ফেরেনি।

এরপর ঈশ্বরের কাছে দীর্ঘ প্রার্থনা…

কিন্তু এতজনের কাতর প্রার্থনা শুনলেন না ঈশ্বর। নিয়ে গেলেন আমার প্রিয় বান্ধবীকে আমার থেকে অনেক অনেক দূরে। হসপিটালের সেই ভয়াবহ রাতের কথা মনে পরলেই মনটা বেদনায় ভড়ে উঠে।

চারিদিকে শুধু কান্না আর দীর্ঘশ্বাস। সৃজার মা বারংবার জ্ঞান হারাচ্ছেন। তার বাবা হসপিটালের চেয়ারের একটি কোণায় নিশ্চুপ। উপস্থিত সবাই নিস্তব্দ। আমার কাছে এই কয়েকটা ঘণ্টায় যেন পুরো পৃথিবীটাই বদলে গেল। এর আগে অনেক প্রিয় জনকে হারিয়েছি, কিন্তু এতটাও কষ্ট আমার হয়নি যতটা কষ্ট সৃজাকে হারিয়ে হয়েছে।

একে একে মনে পরতে থাকে সৃজার সাথে কাটানো সেই সুন্দর মুহূর্ত গুলি। কিন্তু এরই মাঝে নিজেকে বড্ড পাপী মনে হতে লাগল। গত ১১ ডিসেম্বর রবিবার জলপাইগুড়িতে আমার একটি exam ছিল, কথা ছিল exam –এর পর সৃজার বাড়িতে তার সঙ্গে দেখা করতে যাব। exam শেষে সৃজাকে ফোন করার কথা ছিল, কিন্তু তার বাড়ি গেলেই আমার ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে ভেবে আমি আর ফোন করিনি।

পড়ুনঃ- পরিসমাপ্তি- কলেজ জীবনের প্রেম কাহিনী 

যখন বাড়ি এসে রাতে তাকে এই কথাটা বলি, সে সোজাসুজি আমার উপর রাগ ঝাড়তে থাকে। কিছুক্ষণ কথাও বলে নি। বুঝেছিলাম আমার সেই সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল।

আবার, কয়েকদিন আগেই আমরা, কলেজের কয়েকজন বন্ধু মিলে কোচবিহার ঘুরতে গিয়েছিলাম, সৃজা বায়না ধরেছিল সেও যাবে আমাদের সাথে। কিন্তু, কলেজের বন্ধুদের সাথে সৃজাকে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না, এমনটাই ভেবেছিলাম আমি। কারণ তারা উল্টো-পাল্টা ভেবে বসবে সেই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম। এখানেও সৃজাকে এড়িয়ে গেছিলাম আমি।  

ঘটনার কয়েকদিন আগেই আমাদের whatsapp  গ্রুপে পটাশিয়াম সায়ানাইড-এর টেস্ট নিয়ে কথা হচ্ছিল। সৃজা ঠাট্টা করে বলে যে সে, পটাশিয়াম সায়ানাইড টেস্ট করবে না। তার কথায়- ‘না থাক বাবা, তাহলে টেস্ট নিব না। যদি মরে যাই’। কিন্তু কখনো ভাবতে পারিনি যে, হাসির ছলে বলা এই কথাটাতে লুকিয়ে থাকবে এক হৃদয় ভঙ্গুর বাস্তবতা।

কিছু মানুষ হারিয়ে যায়
কিছু মানুষ হারিয়ে যায়

আসলে আমার ভাগ্যটাই এরকম, যাদেরই আমি হৃদয় থেকে চেয়েছি তারাই আমার থেকে দূরে সরে গেছে নতুবা আমাকে বিদায় জানিয়েছে। কখনো কখনো ভাবি, চিকিৎসা ব্যবস্থা এত্ত উন্নত হয়েছে অথচ পুরনো স্মৃতি ভুলে যাওয়ার কোনো ওষুধ এখনও আবিষ্কৃত হয়নি কেন! আবার পরক্ষনেই মনে হয়, স্মৃতিই মানুষকে নতুন ভাবে বাঁচতে শেখায়, নতুন ভাবে মানুষকে পথ চিনতে শিখায়।

আমি জানি তুমি আমাদের মধ্যেই আছো। তারাদের দেশ থেকেই আমাদের তুমি দেখে যাচ্ছ। যেখানে থাকো ভালো থেকো। তোমার স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরেই আমি এগিয়ে যাব। আমাদের দুইজনের নেওয়া কার্যভার গুলিকে পূর্ণতা দেওয়ার দায়িত্ব সম্পূর্ণ রূপে আমার এবং ছাড়পত্র গ্রুপের। তুমি শুধু ছায়া হয়ে আমার পাশে থেকে কাঁধে হাতটা রেখে সাহস জুটিও।।


© reserved by admin of charpatra.com, publishing of this story in any other platforms (youtube, facebook, blog etc.) is prohibited. Charpatra.com will be forced to take legal actions. 
পড়ুনঃ- 

ইউনিভার্সিটি লাভ স্টোরি

সুপ্ত প্রেমের বেদনাময় কাহিনী

অপরিপূর্ণ ফেসবুকের প্রেম
আপনার গল্প আমাদের মেইল করুন- charpatrablog@gmail.com এ অথবা সরাসরি WhatsApp এর মাধ্যমে পাঠানোর জন্য এখানে ক্লিক করুন। 
এক ক্লিকেই আমাদের সমস্ত আপডেটের জন্য- 

ফেসবুক Group - গল্প Junction

ফেসবুক- ছাড়পত্র

টেলিগ্রাম- charpatraOfficial

WhatsApp Group- ছাড়পত্র (২)


প্রিয় মানুষকে হারানোর কষ্ট। প্রিয়জনকে হারানোর বেদনা। কিছু মানুষ হারিয়ে যায়। 1 new emotional bengali friendship story.

Spread the love

Leave a Reply