লেখার শুরুতেই সবাইকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা রইল। বাংলা নববর্ষ নিয়ে উৎসাহ-উদ্যমের শেষ নেই। কিন্তু এই বাংলা নববর্ষের ইতিহাস জানেন কি? কিভাবেই বা এল এই বাংলা নববর্ষ। মানব মণ্ডলের কলমে  আজ রইল তারই চুলচেরা বিশ্লেষণ।

বাংলা নববর্ষের ইতিহাস। বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখের প্রবর্তক কে?

বাংলা নববর্ষের ইতিহাস সম্পর্কে বিভিন্ন মত রয়েছে। আমরা ধাপে ধাপে প্রতিটি মত নিয়ে আলোচনা করব।

বাংলা নববর্ষের ইতিহাস- প্রথম মতঃ-

বাংলা নববর্ষের উৎপত্তি জানতে হলে আমাদের একটু পিছিয়ে গিয়ে ইতিহাসের পাতা উল্টাতে হবে। বাংলা বছরকে সন বা বাংলা সাল বলে ডাকা হলেও সন ও সাল শব্দ দুটি যথাক্রমে আরবি এবং ফারসি শব্দ। সুতরাং এর শুরুটা মুঘলদের কেউ করেছিলেন। পৃথিবীর প্রথম নৃতত্ত্ববিদ আল বিরুনির “কিতাব উল হিন্দ”-এ(রচনাকাল আনুমানিক ১৩৩০ খ্রি:)ভারতবর্ষের যে সব অব্দের যেমন-  শ্রীহর্ষাব্দ, বিক্রমাব্দ শকাব্দ, বলভাব্দ ও গুপ্তাব্দ এর নাম উল্লেখ করেছেন তাতে বঙ্গাব্দ নেই।

সুতরাং তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে বঙ্গাব্দ তখনও চালু হয়নি। বঙ্গাব্দ চালু হয় এর অনেক পরে ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের দিকে অর্থাৎ সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহণের বছর থেকেই,  এবং মেনে নিতে হয় সম্রাট আকবরের রাজজ্যোতিষী আমীর ফতে উল্লাহ সিরাজীই হলেন এই নতুন অব্দের প্রচলিত করার  মূল কান্ডারি।

বাংলা নববর্ষের ইতিহাস বাংলা নববর্ষ নিয়ে কিছু কথা সম্রাট আকবর
বাংলা নববর্ষের ইতিহাস বাংলা নববর্ষ নিয়ে কিছু কথা সম্রাট আকবর

বাংলা সন শূন্য থেকে শুরু হয়নি, যে বছর বাংলা সন প্রবর্তন করা হয়, সে বছর হিজরি সন ছিল ৯২৩ হিজরি। তাই সম্রাটের নির্দেশ প্রবর্তনের বছরই ৯২৩ বছর বয়স নিয়ে  বাংলা সনের হিসাব শুরু হয়েছিল। আকবরের সিংহাসনে আরোহনের ২৫ দিন পর অর্থাৎ বুধবার ২৮ রবিউস সানি (১১ মার্চ) তারিখে নতুন বর্ষের সূচনা হয়েছিল। এই দিনটি ছিল পারসিক বছরের নওরোজ।

এই বাংলা বর্ষ প্রবর্তনের আগে ভারতে সৌরবর্ষের প্রচলন ছিল। আর এই সৌরবর্ষের চেয়ে চন্দ্রবর্ষ ১০/১২ দিন কম হবার ফলে কৃষকদের কৃষিকাজ সংক্রান্ত কাজে দিনক্ষণের সঠিক হিসাব রাখা কঠিন হয়ে গিয়েছিল।

৯৬৩ হিজরী সনের মহররম মাসের ১ তারিখ থেকে বৈশাখী সনের প্রথম দিন গণনা শুরু হয়। হিজরি ৯৬৩ সনের ১লা মহররম আর ১লা বৈশাখ ৯৬৩ একই দিন ছিল। তাই  হিজরি ৯৬৩ সনের সাথেই বঙ্গাব্দ যুক্ত হতে থাকে। আগেই বলেছি  চন্দ্রমাসভিত্তিক হিজরি সন ১০/১২  দিন কম হওয়ায় হিজরি সনের তুলনায় বিগত কয়েকশত বছরে বঙ্গাব্দ বেশ কম। ঐতিহাসিকগণ মনে করেন, বাংলা সন চালুর ভিত্তি হলো হিজরি সন। হিজরি সনের বর্তমান বয়স ১৪৪৪ বছর। বাংলা সন ও হিজরি সনের মধ্যে ব্যবধান মাত্র ১৪ বছর। তবে এই পার্থক্যের কারণ হলো আরবি মাস কখনো ২৯ দিনে হয়ে থাকে। তবুও এই হিসাবটিতে একটু সন্দেহ থেকেই যায়।

বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ তখন ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হত।এটি কৃষকদের কাছে ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিত হয়, যা পরে ‘বাংলা সন’ বা ‘বঙ্গাব্দ’ নামে প্রচলিত হয়ে ওঠে।

কিন্তু আকবরের শাসনামলের অনেক আগে থেকেই দুটি শিব মন্দিরে বঙ্গাব্দ শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। পরে সম্রাট আকবর তার শাসনামলে খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে রাজজ্যোতিষী ফতেউল্লাহ শিরাজির সহায়তায়  এটি পরিবর্তন করে ঋতু পরিবর্তনের সাথে সামঞ্জস্য আনেন। কিন্তু এই মতটি যথার্থভাবে মেনে নেওয়া যায় না।

তবে এটা ঠিক যে, আকবরের আমল থেকে বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দিনে, সবাইকে বাধ্যমত খাজনা বা শুল্ক দিতেই হত। এর পরের দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ ভূস্বামীরা তার নিজস্ব অঞ্চলের অধিবাসীদের বিভিন্ন মিষ্টান্ন খাওয়ানোর প্রচলন ছিল। এভাবেই নতুন একটি বছরকে মিষ্টি মুখে আপ্যায়ন করা হত।

বাংলা নববর্ষের ইতিহাস- দ্বিতীয় মতঃ-

কয়েকজন ঐতিহাসিক তাই বাংলা দিনপঞ্জি উদ্ভবের কৃতিত্ব আরোপ করেন ৭ম শতকের গৌড়েশ্বর মহারাজাধিরাজ শশাঙ্কের   উপর। ভারতের পূর্বাঞ্চল ও উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর নববর্ষের উৎসবগুলোর সঙ্গে হিন্দু বিক্রমী দিনপঞ্জির  মিল আছে। সেই হিসাবে বিক্রমাদিত্যকে বাংলা দিনপঞ্জির আবির্ভাবের স্বীকৃতি দিলে একটা অসুবিধা হয়। ঐ  অঞ্চলের মতো বাংলায় বঙ্গাব্দের সূচনা ৫৭ খ্রিস্টপূর্বে হয়নি, বরং ৫৯৩ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হয়েছিল, যা নির্দেশ করছে বঙ্গাব্দের সূচনা প্রমাণ সময়কে কোন একসময় পরিবর্তিত করা হয়েছে। মনে করা হয় শশাঙ্কের শাসনামলেই এই পরিবর্তন হয়েছে। কোনো কোনো পণ্ডিত দের মতে শশাঙ্ক ৫৯৩ খ্রীষ্টাব্দের ১২ এপ্রিল থেকেই স্বাধীনভাবে রাজত্ব শুরু করেছিলেন।

বাংলা নববর্ষের ইতিহাস- তৃতীয় মতঃ-

অন্য পণ্ডিতদের মতে স্রংসন নামে এক তিব্বতী রাজা ৬০০খ্রিষ্টাব্দের কিছু আগে মধ্য ও পূর্ব ভারত জয় করেন। তিনি তিব্বতের কৃষি কাজের প্রচলিত রীতি ভারতবর্ষে চালু করেন। স্রংসন –এর  নামের শেষাংশ থেকে সন শব্দ টি এসেছে বলে তারা মত দেন।

আরও একটি কথা, নববর্ষ উদযাপন উৎসব নিয়ে বলতে হয়‌।  ইসলামে উৎসব বলতে শুধু দুটি উৎসব রয়েছে প্রথমত ঈদুল ফিতর এবং দ্বিতীয়ত ঈদুল আযহা। সেই হিসাবে এটি একটি ইসলামবিরোধী উৎসব। কারণ এই উৎসবে অনেক বিধর্মীদের সংস্কৃতি পালন করা হয়। ইসলামে এই দিনটি উদযাপনের কোনো নির্দেশনা নেই‌। এটি সম্পূর্ণ হিন্দুধর্মাবলম্বীদের একটি উৎসব। এই দিনে বিভিন্ন ধরনের মঙ্গল শোভাযাত্রা, বিভিন্ন ধরনের মুখোশ প্রদর্শনী, উল্কি আঁকা, বিভিন্ন কাজ করা হয় যা ইসলামবিরোধী।

বাংলা বারো মাসের নাম কিভাবে এল?

আবার বাংলা বারো মাসের নামকরণ করা হয়েছে বিভিন্ন নক্ষত্র থেকে। যেমন- বিশাখা নক্ষত্র থেকে বৈশাখ, জায়ীস্থা থেকে জৈষ্ঠ্য, শার থেকে আষাঢ়, শ্রাবণী থেকে শ্রাবণ ,ভদ্রা থেকে ভাদ্র, অশ্বিনী থেকে আশ্বিন, কৃত্তিকা থেকে কার্তিক, আবার মৃগশিরা নক্ষত্রের অপর নাম অগ্রহায়ণী থেকে অগ্রহায়ণ।  পুষা  থেকে পৌষ, মঘা থেকে মাঘ, ফাল্গুনী নক্ষত্রের নামানুসারে ফাল্গুন এবং শেষের চৈত্র মাসের নাম হয় চিত্রা নক্ষত্র থেকে থেকে। এভাবেই বাংলায় নক্ষত্রের নামে মাসের নামকরণ করা হয়।

পহেলা বৈশাখের প্রবর্তক কে history of bengali new year
পহেলা বৈশাখের প্রবর্তক কে history of bengali new year ছবি

তাই বলা যেতে পারে- খ্রিস্টপূর্ব ৫৭ অব্দে প্রাচীন ভারতের রাজা বিক্রমাদিত্যের নামানুসারে হিন্দু বিক্ৰমী পঞ্জিকা প্রণয়ন করা হয়েছিল। এই পঞ্জিকা অনুসারে ভারতের পূর্বাঞ্চল, উত্তর পূর্বাঞ্চল ও নেপালের বিভিন্ন অংশে বসবাসরত গ্রামীণ বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যে নিছক একটি ঋতু উৎসব হিসেবে প্রচলিত ছিলো পহেলা বৈশাখ। তবে তার আমেজ বাংলা অব্দি পৌছতে চলে এসেছিলো ৫৯৩ খ্রিস্টাব্দ। ৭ম শতকে বাংলা বর্ষের প্রমাণ সময়ে বেশ পরিবর্তন এনে বাংলার বুকে বাংলা দিনপঞ্জির উদ্ভব ঘটান বাংলার প্রথম স্বাধীন নৃপতি গৌড়েশ্বর মহারাজাধিরাজ শশাঙ্ক।

✍🏻 কলমে- মানব মণ্ডল (facebook)

বাংলা নববর্ষের ইতিহাস। বাংলা নববর্ষ নিয়ে কিছু কথা। বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখের প্রবর্তক কে? unknown history of bengali new year 1429

প্রতিনিয়ত আপডেটের জন্য ফেসবুক পেজ-অবাক বিশ্ব অথবা আমাদের গ্রুপ- AMAZING FACT(অজানা তথ্য) 

টেলিগ্রাম- ছাড়পত্র-charpatra.
পড়ুনঃ-
বিল গেটস ও পেপার বয়-অনুপ্রেরণার গল্প

অদ্ভুত কিছু ঘটনা

charpatra whatsApp group invite 2
<
Spread the love

Leave a Reply