আজ আবার আমরা হাজির আরেকটি নতুন বাংলা গল্প নিয়ে। এটী এক রাজপুত্রের গল্প। যে তার পিতার জিজ্ঞাসা করা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিভিন্ন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে।

রাজপুত্রের গল্প। রাজপুত্র ও রাজার প্রশ্ন।

রাজ্যের নাম রামগড় রাজার নাম রাজসিংহ। রাজা রাজপুত্রকে একজন ভালো গুরুর কাছে পাঠালেন—যেন সর্ব বিষয়ে শিক্ষালাভ করতে পারে। রাজপুত্র গুরুগৃহে মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করে কিছুদিনের মধ্যেই বিভিন্নশাস্ত্রে পণ্ডিত হয়ে উঠলেন। রাজপুত্রের জ্ঞানের কথা সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল। এদিকে রাজা বৃদ্ধ হয়ে পড়েছেন, রাজপুত্রেরও শিক্ষা প্রায় সমাপ্ত অতএব গুরুগৃহ থেকে রাজপুত্রকে ডেকে পাঠান হল। রাজপুত্র রাজধানীতে ফিরে এলেন রাজা কাছে ডেকে একমাত্র পুত্রের গায়ে হাত বুলিয়ে বললেন—শুনেছি তোমার শিক্ষা প্রায় শেষ?

রাজপুত্র বললেন—আমি কিছুটা শিখেছি মাত্র, শিক্ষার তাতে শেষ নেই। রাজা বললেন—আমার একটি সামান্য প্রশ্নের উত্তর দাও তো?

—আজ্ঞা করুন, পিতা!

-আচ্ছা বল তো, এ পৃথিবীতে কোন ফল সব চেয়ে বড়?

রাজপুত্র সাংঘাতিক ভাবতে লাগলেন, কিন্তু কিছুতেই কিছু হদিস করতে পারলেন না, তাছাড়া পৃথিবীর সব জায়গায় তো রাজপুত্রের যাওয়া হয়নি! আর প্রশ্নটাও অনেকটা ধাঁধার মতো। রাজপুত্র রাজাকে বললেন — আপনার প্রশ্নের উত্তর দেব, কিন্তু আমাকে সাত দিন সময় দিন। প্রশ্নটা আপাত-দৃষ্টিতে সহজ মনে হলেও, খুব কঠিন। রাজা রাজপুত্রের প্রতি সাংঘাতিক চটে উঠলেন, এই সামান্য প্রশ্নের উত্তর দিতে তোমার সাতদিন লাগবে? তবে তুমি কি লেখাপড়া শিখেছ? ছি! ছি! ছি! তুমি পণ্ডিত হয়েও মূর্খই রয়ে গেছে। ঠিক আছে, আমি তোমাকে  তোমার কথামত সাতদিনের সময় দিলাম, কিন্তু এই সাতদিনের মধ্যে তুমি যদি আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারো — তবে আমার রাজ্যে আর তোমার স্থান হবে না — আমি তোমাকে ত্যাগ করে পোষ্য পুত্র গ্রহণ করব।

রাজপুত্র নিজের কক্ষে এসে ভাবতে লাগলেন। সে ভাবনার শেষ নেই। দিন যায়, রাত যায়। আহারেও রুচি নেই। পুঁথিপত্র ঘাঁটতে লাগলেন — কিন্তু কোথায়ও সদুত্তর পেলেন না। দিনে অস্থির ভাব, রাত্রে ঘুম নেই। রাজপুত্রের ভাবনার শেষ নেই। দেখতে দেখতে চারদিন পেরিয়ে গেল—  আর তিনদিনের মধ্যে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলে নির্বাসন দণ্ড মাথা পেতে নিতে হবে। এ রাজ্য, রাজধানী ছেড়ে যেতে হবে।

life-changing story rajputrer golpo
life-changing story rajputrer golpo

 একবার ভাবলেন, কাঠালই তো ফলের মধ্যে সবচেয়ে বড়। আবার ভাবলেন- না, এ প্রশ্নের উত্তর এত সহজ হবে না। তাছাড়া পৃথিবীর সব দেশ তো তার দেখা হয়নি — কি করে তিনি জানবেন কোন দেশের কোন ফল বড়? বই-পত্র ঘাঁটাঘাঁটি করেও ফলতত্ত্ব সম্বন্ধে কিছুই আবিষ্কার করতে পারলেন না। দেখতে দেখতে ছয়দিন পেরিয়ে গেল। হাতে আর মাত্র একদিন বাকী। সাত দিনের দিন ভোরে রাত্রে কাকপক্ষী ডাকার আগেই রাজপুত্র একবস্ত্রে রাজপুরী ত্যাগ করে বেরিয়ে এলেন কেউ জানতে পারল না।

 পিতার সৈন্যদের হাতে ঘাড় ধাক্কা খাওয়ার আগেই তিনি নিজেই রাজপুরী ত্যাগ করে চলে এলেন। রাজপুত্রের সঙ্গে সেবিকা নেই, সঙ্গে ভৃত্য নেই। তিনি সম্পূর্ণ একা। প্রথমে এলেন তিনি গুরুগৃহে। গুরুকে প্রশ্ন করলেন — আচ্ছা, গুরুদেব পৃথিবীতে কোন ফল সবচেয়ে বড়। গুরুদেবও শিষ্যের প্রশ্ন শুনে মহা ভাবনায় পড়লেন। শিষ্যকে বললেন — সারাপৃথিবী তো আমি ঘুরিনি, কি করে বুঝব বলো — পৃথিবীতে কোন ফল সবচেয়ে বড়? হয়তো অনেক ফলের নামও জানি না। বহু বই-পত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে গুরুদেবও প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেন না। রাজপুত্র বিমর্ষ হয়ে গুরুগৃহ থেকে বেরিয়ে এলেন।

এখন কি করবেন তিনি? সারা পৃথিবী ঘুরে দেখবেন, কোন ফল বড়। রাজপুত্রের সঙ্গে তো কোনো অর্থ নেই। অতএব ভিক্ষে করে খেতে হবে, পায়ে হেঁটে পথ চলতে হবে। রাজপুত্র দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।  কষ্ট স্বীকার করতে তার কোনো আপত্তি নেই। পৃথিবীতে কোন ফল বড়, তাকে জানতে হবেই। রাজপুত্র পথ চলতে লাগলেন, শহর পেরিয়ে, গ্রাম পেরিয়ে রাজ্যের সীমা পেরিয়ে আর এক রাজ্যে। রাজপোশাক খুলে বিক্রি করে সাধারণ পোশাক পরে নিলেন। সেই পোশাকও জীর্ণ হয়ে গেল। চুলে তেল নেই। রাজপুত্রকে আর রাজপুত্র বলে চেনা যায় না। ধুলি-মলিন দেহ। একজন সাধারণ মালবাহী কুলীর মতোই তার চেহারা হল।

সেদিন বন দিয়ে রাজপুত্র যাচ্ছিলেন। জঙ্গলে ফল নেই, তৃষ্ণার জল নেই।রাজপুত্র কাতর হয়ে পড়লেন। সেই পথে তখন এক রাজা পাল্কী চড়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ পাল্কীর একটা বেহারা চলতে চলতে অসুস্থ হয়ে পড়লো। পাল্কী থেকে রাজা বললেন – আরে এইতো জঙ্গলের মধ্যে আর একটা লোক, এই লোকটাকে ধরে নিয়ে এসো। এই লোকটাকেও কুলীর মতোই দেখতে। পাল্কী নিশ্চয়ই বইবে। রাজার লোকেরা কুলীবেশি রাজপুত্রকে ধরে নিয়ে এলো।

কুলীবেশী রাজপুত্র রাজাকে বললেন — পাল্কী আমি বইতে পারি, তবে আমার একটা শর্ত আছে। কুলীর মুখে বড় বড় কথা শুনে রাজা চমকে উঠলেন। কুলীটা আবার বলে কি? কুলীর আবার শর্ত কি? পাল্কী থেকে রাজা হো হো করে হেসে উঠলেন। মন্ত্রী মশায় ঘোড়ায় চড়ে পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তিনি রাজামশায়কে বললেন- “ আগে কুলীটার শর্তই শোনা যাক, জীবনে এমন অদ্ভুত কথা শুনিনি, কুলীর সঙ্গে আবার শর্ত করতে হয় নাকি? মন্ত্রীর মুখে দুবার ‘ কুলী ’ শুনে রাজপুত্রও চটে গিয়ে বললেন — মশাই। আমি কুলী নই, রাজপুত্র। পাল্কী থেকে রাজামশাই কুলীবেশী রাজপুত্রের উত্তর শুনে হো হো করে আবার হেসে উঠলেন — তা তোমার বেশভূষা রাজপুত্রের মতোই বটে! তা তোমার শর্ত কি তাড়াতাড়ি বলে ফেলো?

শিক্ষণীয় গল্প কর্মফল নতুন গল্প
শিক্ষণীয় গল্প কর্মফল নতুন গল্প

 

রাজপুত্র বললেন — আমাকে তৃষ্ণার জল দিতে হবে, ক্ষুধার অন্ন দিতে হবে। তবেই আমি পাল্কী বইতে পারি। আমি পথশ্রমে বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। রাজা বললেন — এতো শর্ত নয়, এতো পারিশ্রমিক। তা তোমাকে দেওয়া হবে। অতএব রাজার আদেশ মত রাজপুত্রকে ক্ষুধার অন্ন, তৃষ্ণার জল, দেওয়া হল। রাজপুত্র অন্য বেহারাদের সঙ্গে একত্র হয়ে পালকী বইতে লাগলেন। কিন্তু রাজপুত্র পাল্কী বইতে পারবেন কেন? পাল্কী বইতে হলে অভ্যাসের প্রয়োজন।

 জঙ্গলের পথ উঁচুনীচু। কোথাও গর্ত, কোথাও চড়াই। পাল্কী-বাহকদেরবাঁচিয়ে চলতে হয়। নইলে রাজা মাথায় ঠোক্কর খাবেন। অতএব রাজপুত্রের ভুলে রাজা বারবার মাথায় ঠোক্কর খেলেন। শেষে বিরক্ত হয়ে পাল্কী থামাতে বললেন। রাজপুত্রের ভুলের জন্য রাজার লোকেরা রাজপুত্রকে বেত মারলো! রাজপুত্রের জায়গায় জায়গায় কেটে গিয়ে রক্ত ঝরতে লাগলো। শুধু কি তাই? রাজার লোকেরা রাজপুত্রকে পথের এক পাশে ধাক্কা দিয়ে ফেলে চলে গেলো। মন্ত্রী মশাই আবার মন্তব্যও করলেন — বেটা আগে শর্ত করে খেয়ে নিয়েছে। জোচ্চোর কোথাকার! কাজের বেলা টু টু। রাজা পাল্কী ছেড়ে ঘোড়ায় চাপলেন। রাজার লোকেরা দূরে চলে গেলো।

জনমানবহীন জঙ্গলে রাজপুত্র একা পথের পাশে যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে গোঙাতে লাগলেন। রাজপুত্র একটা গাছে উঠে রাত কাটিয়ে দিলেন। পরদিন আবার চলতে চলতে আর এক রাজ্যে চলে এলেন। এ রাজ্যের সভাপণ্ডিত খুব মস্তবড় জ্ঞানী। তার জ্ঞানের খ্যাতি সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। রাজপুত্র একেবারে রাজসভায় চলে এলেন। রাজা জিজ্ঞেস করলেন — তুমি কে? রাজপুত্র বললেন — আমি একজন বিদেশী। শুনেছি আপনার সভাপণ্ডিত মহাজ্ঞানী, আমি তার কাছে একটা সামান্য প্রশ্ন করতে চাই। আপনি রাজা, এ রাজসভাআপনার, তাই আপনার কাছে প্রশ্ন করার অনুমতি চাই। এ ছাড়া আমার কোনো প্রার্থনা নেই। রাজা বললেন — বিদেশী, আমি তোমাকে প্রশ্ন করবার অনুমতি দিলাম। সভাপণ্ডিতও টিকি দুলিয়ে বললেন — কি তোমার প্রশ্ন, বিদেশী? সভার অন্যান্য সকলে, এমনকি রাজা পর্যন্ত প্রশ্ন শোনার জন্যে আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলেন।

 রাজপুত্র বললেন — এই পৃথিবীতে কোন ফল সবচেয়ে বড়?

প্রশ্ন শুনে সভাপণ্ডিতের টিকি দোলানো থেমে গেলো, হতবাক হয়ে সবার মুখের দিকে তাকালেন।

রাজা সভাপণ্ডিতকে বললেন — বিদেশীর এই সাধারণ প্রশ্নের সত্ত্বর উত্তর দিন পণ্ডিতমশাই! বিদেশীর এই সামান্য প্রশ্নের উত্তর দিতে আপনার মতো সভাপণ্ডিতকেও যদি অনেকক্ষণ ভাবতে হয় — তবে বিদেশীর কাছে আমার সম্মান থাকবে কি করে? সভাপণ্ডিত ভাবতে লাগলেন। ভেবে ভেবে কোন কূলকিনারা করতে পারলেন রাজা সভাপণ্ডিতের মুখের দিকে রাগে কষায়িত নেত্রে তাকিয়ে বললেন তাড়াতাড়ি উত্তর দিন, পণ্ডিতমশাই। আপনার উত্তর দিতে দেড়ি দেখে বিদেশীর কাছে লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে।

 পাঁচ মিনিট সময় চলে গেলো। এক ঘন্টা সময়ও চলে গেলো। ধীরে ধীরে সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়লো। রাজা অস্থির হয়ে সভাপণ্ডিতের মুখের দিকে তাকালেন। সভাভঙ্গ হওয়ার সময় আসন্ন। পণ্ডিতমশায়ের মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। রাজা এবার সভাপণ্ডিতের ওপর সাংঘাতিক রেগে গেলেন। কম্পিত কণ্ঠে বললেন- আপনি যদি আর কিছুক্ষণের মধ্যে বিদেশী যুবকের প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারেন, সবার সমক্ষে আপনার টিকি কেটে ফেলা হবে। অনেক চিন্তায় পড়ে গেলেন সভাপণ্ডিত। এতদিনের তার সম্মান,  লম্বা টিকি, রাজপ্রদত্ত বৃত্তি সবই আজ  নষ্ট হয়ে আবার যাবে। ক্রমশঃ গম্ভীর চিন্তামগ্ন রাতের অন্ধকার রাজসভায় নেমে এলো।   

rajputrer golpo রাজপুত্রের গল্প
rajputrer golpo রাজপুত্রের গল্প life-changing story
<


 
পণ্ডিতমশাই ভেউ ভেউ করে কেঁদে বললেন — বিদেশীর প্রশ্নের উত্তর দেওয়া  অসম্ভব। আমি পারব না। রাজার আদেশে রাজার লোকেরা  এক বিরাট কাঁচি দিয়ে কচ্ করে পণ্ডিমশায়ের টিকি কেটে ফেললেন। রাজার লোকেরা শুধু টিকি কেটেই ক্ষান্ত হল না,পণ্ডিতমশায়ের ঘাড় ধরে রাজসভা থেকে বের করে দেওয়া হল। পণ্ডিতমশায় মনের দুঃখে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ী চলে গেলেন। রাজপুত্র আবার রাজসভা থেকে বেরিয়ে পথ চলতে লাগলেন। পৃথিবীর পথ অনন্ত, পথের শেষ নেই। যেতে যেতে যত গাছ পড়ল, তাদের ফলের দিকে তাকিয়ে দেখলেন — কিন্তু কাঁঠালের চেয়ে বড় আকারের কোন ফল দেখতে পেলেন না।যেতে যেতে রাজপুত্র আবার গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করলেন। কোথায়ও জনমানবের সাড়া নেই।

তবুও ধীরে ধীরে পথ পেরিয়ে একটা গ্রামে এসে পড়লো। প্রথম যে বাড়ীটা পড়ল, সে বাড়ীটা ছিল এক গরীব বামুনের। স্বামী-স্ত্রী দুজন। সম্বল একটা গাই গরু। ছয় সের দুধ দেয়। সেই গরুর দুধ বেচে কোন রকমে ওদের দুজনের পেট চলে যায়। রাজপুত্র এসে গরীব বামুনের কাছে আশ্রয় চাইলেন, বললেন — আমি বিদেশী। আমার কেউ নেই, ক্ষুধায় বড়ই কাতর হয়ে পড়েছি। আমাকে কিছু খেতে দিন। গরীব বামুন রাজপুত্রকে আশ্রয় দিলেন, আহার্যও দিলেন।

 গরীব বামুন রাজপুত্রকে বললেন তুমি এখানেই থেকে যাও, গরুর দুধ বেচে আমাদের তিনটে পেট কোন রকমে চলে যাবে। আমার তোমার মত ছেলে ছিল। পাশের জঙ্গলে বাঘ তাকে গত বছর খেয়ে ফেলেছে। অতএব তোমার মধ্যেই আমরা আমাদের পুত্রকে খুঁজে পেয়েছি। গরীব বামুনের দু’চোখ বেয়ে জলের ধারা নেমে এল, বামনীও রাজপুত্রকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল — বাবা, তুমি এখানেই থেকে যাও। তোমাকে দেখে তবু ছেলের দুঃখ ভুলে থাকতে পারব। রাজপুত্রও ওখানে থাকতে রাজী হয়ে গেলেন। কারণ রাজপুত্র ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন।

পড়ুনঃ- মস্তিষ্কের অজানা তথ্য

 তাছাড়া রামগড় রাজ্যে ফিরে যাওয়ার মুখও রাজপুত্রের নেই। অতএব  রাজপুত্র গরীব বামুনের সংসারে রয়ে গেলো। রাজপুত্রের কাজ হল গরুর ঘাস কেটে এনে গরুকে খাওয়ানো আর গরুর দুধ বিক্রী করে বাজার থেকে অন্যান্য জিনিস কেনা। বামুন অবশ্য প্রথমে গরুর জন্যে রাজপুত্রকে ঘাস কাটতে দিতে মোটেই রাজী হননি, অনেক আপত্তি করেছে। কিন্তু রাজপুত্রও নাছোড়বান্দা। কিন্তু একদিন মাঝরাতে রাজপুত্র উঠে দেখল বামুন গরুর দড়ি ধরে বারান্দায় বসে আছে।

রাজপুত্র জিজ্ঞেস করলেন-বাবা আপনি এখনও ঘুমোননি?

বামুন বললেন- “ আমি  তো কোনদিন রাতে ঘুমুই না, গরুর দড়ি ধরে বারান্দায় বসে থাকি। এ রাজ্যে যা চোরের উপদ্রব। আমাদের তো আর অন্য গরু নেই, একটাই গরু। তাই গরুর দড়ি ধরে সারারাত বারান্দায় বসে থাকি। রাজপুত্র বামুনের কথা শুনে মনে বড় দুঃখ পেলেন, রাজপুত্র ঘরের ভেতর আরামে ঘুমোন, আর বুড়ো বামুন সারারাত গরুর দড়ি ধরে পাহারা দেন।  রাজপুত্র বললেন — আগামীকাল থেকে আমি গরু পাহারা দেবো, আপনি ঘুমোবেন। রাজপুত্ৰ বামুনের কোনো আপত্তি শুনলেন না। বললেন — আগামীকাল রাত থেকে আমাকে গরু পাহারা না দিতে দিলে আমি এ-দেশ ছেড়ে চলে যাব। অতএব  বামুনকে বাধ্য হয় অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজপুত্রকে গরুর পাহারায় রাখতে হল।

পরদিন রাতে বামুন ঘরের ভেতর ঘুমাতে চলে গেলো। রাজপুত্র গরুর দড়ি ধরে বারান্দায় বসে রইল। কতক্ষণ বসে বসে রাজপুত্রের চোখ ঘুমে জড়িয়ে এল। রাজপুত্র ঘুমিয়ে পড়লেন।আর ইতিমধ্যে চোর এসে গরু নিয়ে চম্পট। মশার কামড়ে রাজপুত্রের ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর রাজপুত্র দেখল হাতে গরুর দড়ি ঠিকই আছে, অথচ গরু নেই। চোর গরুর দড়ি কেটে নিয়ে চম্পট দিয়েছে। রাজপুত্র ছুটলেন গরুর খোঁজে। কিছুদূর গিয়ে দেখল, একটা লোক গরু নিয়ে ছুটে পালিয়ে যাচ্ছে। রাজপুত্র চোরের পেছনে পেছনে ছুটতে লাগলেন। ছুটতে ছুটতে ওরা আর এক রাজ্যে চলে এল। রাজ্যের নাম লাভপুর। শেষ পর্যন্ত রাজপুত্র চোরকে ধরে ফেললেন। কিন্তু চোর কিছুতেই গরুর দাবী ছাড়তে রাজী নয়।

শিক্ষণীয় গল্প কর্মফল
শিক্ষণীয় গল্প কর্মফল life-changing story image

চোর বললে — এটা আমার গরু, তুই বেটা চোর।

রাজপুত্র বললেন — এটা আমার গরু, তুই বেটা চোর। এই নিয়ে রাজপুত্র আর চোরের মধ্যে খুব বচসা হল। রাজার লোকেরা ওদের দুজনকে ধরে রাজসভায় নিয়ে গেল।

রাজপুত্র রাজাকে দেখে চিনতে পারলেন, এই রাজারই পালকি রাজপুত্র বয়েছিলেন। রাজাও রাজ পুত্রকে দেখে চিনতে পারলেন। রাজার মেজাজ রাজপুত্রের ওপর সেই পাল্কী টানার দিন থেকেই বিগড়ে ছিল। তাছাড়া চোরটা আবার এই রাজবাড়ীরই একজন চাকরের আপন ভাই। চোরটার নিত্য মণ্ডা মিঠাই খাওয়ার অভ্যেস, তাই এখানে সেখানে গরু চুরি করে বেড়ায়। কিন্তু বিচারের ফল উল্টো হল। রাজা বললেন — আমার চাকরের ভাই কখনও গরু চুরি করতে পারে না এই লোকটাই চোর। অতএব দোষীকে ছেড়ে দিয়ে — নির্দোষকে শাস্তি দেওয়া হল। রাজপুত্রকে কয়েদ করে রাখা হল।

রাজার বিচারের রায় শুনে — সভার লোকেরা রাজাকে বাহবা দিল। কিন্তু একজন রাজার বিচার দেখে বাহবা দিল না। সে এই রাজ্যেরই রাজকন্যা রুপবতী। সে রাজসভায় পর্দার আড়ালে বসে রাজপুত্রকে দেখেছিল। তার মন বলল — এ অসম্ভব! এমন রূপ যার — সে কখনও গরু চুরি করতে পারে না। রাজকন্যা রুপবতী রাজপুত্রের রূপ দেখে মুগ্ধও হয়ে গেল। রাজকন্যা একজন দাসীকে রাজপুত্রের কার্যকলাপের ওপর নজর রাখতে বলল।

রাজপুত্র সেই রাত্রে স্বপ্ন দেখল। একজন সন্ন্যাসী তার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে। অপূর্ব তাঁর রূপ। সন্ন্যাসী মিষ্টি হেসে বললেন — এ পৃথিবীতে কর্মফলই বড়। গত জন্মে পাপ করেছিলে বলে এ জন্মে রাজপুত্র হয়েও তোমাকে শাস্তি পেতে হল। চোর না হয়েও চুরির অপরাধে কয়েদ খাটতে হচ্ছে, তবে তোমার কষ্টভাগ শেষ হয়ে এসেছে। এবার থেকে তুমি সুখী হবে।  রাজপুত্র স্বপ্নের মধ্যে প্রশ্নের উত্তর পেয়ে আনন্দে মেতে উঠলেন। পরদিন রামগড়ে চিঠি লিখলেন যে, তিনি এতদিনে প্রশ্নের সঠিক উত্তর পেয়েছেন। আর বিনা দোষে লাভপুর রাজ্যে বন্দী হয়ে আছেন।

কয়েদখানায় অনেকগুলো পায়রা ছিল — রাজপুত্র একটা পায়রার পায়ে চিঠি বেঁধে দিয়ে পায়রাটাকে দক্ষিণ মুখে উড়িয়ে দিল। কারণ, দক্ষিণ দিকেই রামগড় রাজ্য এদিকে রাজকন্যার দাসী পায়রার পায়ে চিঠি বাঁধা থেকে আরম্ভ করে সবই দেখল । সে পায়রাটির যাত্রা পথে কিছু ছোলা আর ধান বিছিয়ে দিয়ে রাজকন্যার দাসী পয়রাটিকে ধরে পায়রার পা থেকে চিঠিটা খুলে এক ছুটে রাজকন্যার কাছে নিয়ে গেল।

পড়ুনঃ- রূপকথার গল্প 

চিঠিটা রাজকন্যা রাজাকেও দেখালেন। রাজা বুঝলেন, বন্দী সাধারণ নয়, রামগড়ের রাজপুত্র। এরপর রাজা মর্মাহত হয়ে রাজপুত্রের কাছে ক্ষমা চাইলেন। সঙ্গে সঙ্গে রাজপুত্রকে মুক্তি দিলেন। হাত জোড় রাজপুত্র রাজাকে বললেন — আপনার কোন দোষ নেই — সবই কর্মফল।

শুধুমাত্র তাই নয়, রাজা রাজপুত্রের সঙ্গে নিজ কন্যা রূপবতীকে বিবাহ দিয়ে দিলেন। আর এরপর আসল চোরটাকে ধরে নিয়ে এসে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হল।

রাজপুত্র ও রাজকুমারী রাজপুত্রের গল্প
রাজপুত্র ও রাজকুমারী রাজপুত্রের গল্প

ওদিকে গরীব বামুনকে তার গরু ফিরিয়ে দিয়ে রাজা অর্থ দিলেন।

রাজপুত্র রূপবতীকে নিয়ে সুন্দর একটা দিন দেখে রামগড় রাজ্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। সঙ্গে অনেক পরিচারক-পরিচারিকা আর অজস্ত্র উপঢৌকন।

এদিকে রামগড় রাজ্যের রাজা সাতদিনের দিন সকালে রাজপুত্রকে দেখতে না পেয়ে খুবই ভেঙ্গে পড়েছিলেন। অনেক খুঁজেও যখন রাজপুত্রের দেখা মিলল না, তখন রাজা পুরো ভেঙ্গে পড়েছিলেন। রাগের মাথায় তিনি রাজপুত্রকে বলে দিয়েছিলেন যে, উত্তর দিতে না পারলে নির্বাসন দেবেন, কিন্তু রাজপুত্র এই কথাটিকে এতটা গভীর ভাবে নিবেন সেটি তিনি ভাবতে পারেননি। উত্তেজনার বশে রাজা নির্বাসনের কথা বলে ফেলেছেন। পুত্রশোকে রাজা-রাণী কোনোমতে প্রাণ ধারণ করে ছিলেন।

যখন রাজপুত্র লাভপুরের রাজকন্যা রূপবতীকে নিয়ে ফিরে এলেন। রাজা আনন্দে রাজপুত্রকে জড়িয়ে ধরলেন।

এরপর রাজপুত্র বলল- আপনার প্রশ্নের উত্তর আজ আমি দিতে পাড়ব পিতা। এই পৃথিবীতে কর্ম ফলই হল সবথেকে বড় ফল। তার উপড়ে আর কোনো বড় ফল নেই।

অর্থাৎ ঠিকমত কর্ম করলে তার ফল একদিন না একদিন মিলবেই।  

এই রাজপুত্রের গল্প সম্পর্কিত আপনার মতামত আমাদের জানাতে ভুলবেন না। চাইলে আমাদের গল্প পাঠাতে পাড়েন এই পেজের নীচে দেওয়া লিঙ্কে ক্লিক করে অথবা আমাদের পেজে সরাসরি ম্যাসেজ পাঠিয়ে।

Spread the love

Leave a Reply