আজ আমরা বহুল প্রচলিত এবং জনপ্রিয় পঞ্চতন্ত্রের গল্প পড়ব। যারা জানেন না যে, পঞ্চতন্ত্র কি তাদের বলি, পঞ্চতন্ত্র হল প্রাচীন কালের লেখা এক শিক্ষণীয় গ্রন্থ বা বই। এতে আছে নানান শিক্ষামূলক। গল্প এখনও পর্যন্ত পুরো পৃথিবীতে ৫৫ টিরও অধিক ভাষায় এই পঞ্চতন্ত্রের কাহিনী অনুবাদিত হয়েছে। অনেক জ্ঞানের কাণ্ডারি এই গল্পগুলি। এই বিখ্যাত গ্রন্থটির রচয়িতা হলেন পণ্ডিত বিষ্ণু শর্মা।

পঞ্চতন্ত্রের গল্প। জ্ঞানের গল্পঃ-

মাছ ও ব্যাঙের বুদ্ধিঃ-

এক পুকুরে দুটি মাছ বাস করত। একজন ছিল শতবুদ্ধি, আর অপরজন ছিল সহস্ত্রবুদ্ধি। আবার সেই পুকুরেই বাস করত একবুদ্ধি যুক্ত একটি ব্যাঙ। এতক্ষণে হয়ত বুঝেই গিয়েছেন কার বুদ্ধি কেমন! ব্যাঙটির এক বুদ্ধি থাকায় তার কোনো অভিমান ছিল না। কিন্তু মাছদুটির নিজের চতুরতার উপর খুবই অভিমান ছিল। একদিন তারা সন্ধ্যার সময় পুকুরের ধারে একসাথে গল্প করছে। হঠাৎ তারা দেখল যে, কয়েকজন জেলে হাঁতে জাল নিয়ে, তাদের দিকেই এগিয়ে আসছেন। মাছদুটি ও ব্যাঙটি জেলেদের জাল দেখে চমকে গেলেন, কারণ তাদের জালে অনেক মাছ আঁটকে রয়েছে এবং মাছগুলি জীবন নিয়ে খেলছে।

পুকুরটির কিনারার কাছে এসে জেলেরা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে লাগল। একজন বলল- “এই পুকুরে খুব ভালো মাছ পাওয়া যাবে, আবার পুকুরটিতে জলও তেমন নেই, তাই কাল এখানেই মাছ ধরব। বাকি জেলেরাও সেই জেলেটির কথা মেনে নিল, এবং এরপর সবাই সেখান থেকে চলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে খবরটি বাকি মাছেদের মধ্যেও ছড়িয়ে গেল।

পঞ্চতন্ত্রের গল্প। জ্ঞানের গল্প।
পঞ্চতন্ত্রের গল্প। জ্ঞানের গল্প।

এরপর মাছেরা একটি সভার আয়োজন করল যে, কিভাবে তারা নিজেদের বাঁচাবে। এই বিষয় নিয়ে সবাই যখন আলোচনায় মগ্ন ঠিক তখনই সহস্ত্রবুদ্ধি তাদের উপহাস করে বলতে লাগল- “তোমাদের ভয়ের কিছুই নেই, পৃথিবীর সব দুর্জনের মনের ইচ্ছা পূর্ণ হয়না। পৃথিবীর সব দুর্জনের মনের ইচ্ছা পূর্ণ হতে থাকলে এই পৃথিবীতে এত জীবের বাস হতনা। সাপ আর দুষ্টের অভিপ্রায় কখনোই পূর্ণ হয়না। কারও কথায় ভয় পাওয়া কাপুরুষতার লক্ষণ। আসল কথা হল যে, জেলেরা কাল এখানে আসবেই না, আর যদি এসেই থাকে, তাহলে আমি আমার বুদ্ধির বলে সবাইকে বাঁচিয়ে নিব।“

সহস্ত্রবুদ্ধির কথা শুনে শতবুদ্ধিও তার সপক্ষে যোগ দিয়ে বলল- “বুদ্ধিমানদের পক্ষে এই জগতের সব অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণত করে দেওয়া অস্বাভাবিক কিছুই নয়। যেখানে বায়ু এবং আলোও পৌঁছাতে পাড়েনা, সেখানে বুদ্ধিমানের বুদ্ধি পৌঁছে যায়। কেউ বললেই আমরা আমাদের মাতৃভূমি এই পুকুর ছেড়ে চলে যাব, তা কক্ষনই আমরা হতে দিতে পাড়িনা। নিজের মাতৃভূমিতে যে সুখ পাওয়া যায় সেই সুখ স্বর্গে গেলেও মিলবে না। ঈশ্বর আমাদের বুদ্ধি দিয়েছেন, ভয় দেখে পালানোর জন্য নয়, বরং ভয়ের মোকাবিলা করার জন্য।“

পুকুরের মাছেরা সহস্ত্রবুদ্ধি ও শতবুদ্ধির কথা শুনে অনেকটা ভরসা পেল, এতক্ষণে একবুদ্ধি ব্যাঙ বলে উঠল- “বন্ধুগণ, আমার কাছে শুধু একটিই বুদ্ধি আছে, আর সেটি হল এই পুকুরটি থেকে অন্যত্র পালিয়ে যাওয়া, এতে সবার জন্যই মঙ্গল হবে। এই যে, ছোট নালাটি দেখা যাচ্ছে সেটি দিয়ে পাশের এক বড় পুকুরে যাওয়া যায়, সকাল হতে না হতেই আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে এখান থেকে পালাব।“ এই কথা বলে ব্যাঙটি সেই সভা ছেড়ে চলে গেল।

পড়ের দিন সকাল হতে না হতেই, সেই ব্যাঙটি তার স্ত্রীকে নিয়ে সেই জলাশয় ছেড়ে পাশের জলাশয়ে চলে গেল। এদিকে কিছুক্ষণ পড় আগের কথা মত সব জেলেরা সেই পুকুরটিতে আসে এবং জাল বিছিয়ে দেয়, পুকুরের মাছ একে একে জালে ধরা পড়তে থাকে। এদিকে শতবুদ্ধি আর সহস্ত্রবুদ্ধি মাছেদের বাচাবার জন্য অনেক উপায় বেড় করল, কিন্তু জেলেরাও যে নাছোড়বান্দা, মাছেরা যেখানেই লুকিয়ে থাকুক না কেন, জেলেরা ঠিক তাদের জালে ফেলে। সবাই বাধ্য হয়েই জেলেদের জালে ধরা দিল।

 শিক্ষামূলক গল্প শিক্ষণীয় মজার গল্প।
শিক্ষামূলক গল্প শিক্ষণীয় মজার গল্প।

সব মাছ স্বেচ্ছায় জালে ধরা দিল। শতবুদ্ধি আর সহস্ত্রবুদ্ধি আকারে অন্যান্য মাছেদের তুলনায় অনেকটাই বড়, তাই জেলেরা সেই মাছদুটিকে জালে না নিয়ে কাঁধের উপর নিয়ে যেতে লাগল। এদিকে সেই একবুদ্ধি ব্যাঙটি অন্য পুকুরের ধার থেকে সব দৃশ্যই দেখছিল। শতবুদ্ধি আর সহস্ত্রবুদ্ধির এই অবস্থা দেখে সে তার স্ত্রীকে বলল- “বুঝলে প্রিয়া, শুধু বুদ্ধি থাকলেই হয়না, বরং তাকে ব্যবহার করতে জানতে হয়। অনেক বুদ্ধি দিয়ে কি হবে, যদি তুমি জায়গা মত ব্যবহারই করতে না পাড়? যদি তোমার কাছে অল্প বুদ্ধিও থাকে এবং তুমি ঠিকমত ব্যবহার করতে পাড়, তাহলে সেই একটি বুদ্ধিই তোমাকে জীবন বাঁচাতে সাহায্য করবে।

পড়ুনঃ- মায়ের ভালোবাসা শিক্ষণীয় গল্প

আকবর বীরবল এর শিক্ষণীয় ছোট গল্প

তিতির ও খরগোশের ঝগড়াঃ-

অনেক দিন আগের কথা, এক জঙ্গলের একটি গাছের নীচে একটি গর্তে একটি তিতির পাখি বাস করত। একদিন সেই তিতিরটি তার বন্ধুদের সাথে অনেকদূরে একটি শস্যের ক্ষেতে শস্য খাওয়ার জন্য উড়ে যায়। সে তার বন্ধুদের সাথে সেদিকেই রাত কাঁটাতে থাকে। এদিকে একটি খরগোশ সেই তিতিরটির গর্তে এসে আস্তানা গড়ে তুলল।

এভাবেই কয়েকদিন সে সেখানে কাঁটাল। কয়েকদিন পড়েই তিতির পাখিটি তার আস্তানায় ফিরে এসে দেখে, তার জায়গা একটি খরগোশ দখল করে আছে। সে খরগোশটিকে তার জায়গাটি খালি করতে বলে।

panchatantra stories in bengali পঞ্চতন্ত্রের গল্প
panchatantra stories in bengali পঞ্চতন্ত্রের গল্প ছবি
<

জায়গা খালি করার কথা শুনেই খরগোশটি চটে গেল। সে রেগে গিয়ে বলল- “এই ঘড়টি আর তোমার নেই, আমি যখন এই ঘড়টি খুঁজে পাই, তখন তোমার কোনো অস্তিত্ব এখানে ছিল না, আর আজ আবার আমার ঘড়টি দখল করতে এসেছো? তুমি বলতে পাড় এটী তোমার ঘড়, কিন্তু কি প্রমাণ আছে যে, এটী তোমারই ঘড়? এটিতে যেহেতু এখন আমি আছি, সেহেতু এটি আমার ঘড়।

তাদের দুইজনের মধ্যে ঝগড়া বেড়েই চলল। শেষে তিতিরটি বলল- “কোনো,তৃতীয় পক্ষকে ডেকে আমাদের এই সমস্যাটির মীমাংসা করা উচিত।“ এদিকে তাদের ঝগড়া আর পেতে শুনছিল একটি বন্য-বিড়াল। সে ভাবল আমি যদি তৃতীয় পক্ষ সেজে তাদের ঝগড়া মিটিয়ে দিতে যাই, তাহলে কোনো মতে ফুসলিয়ে ওদের দুইজনকেই মেরে আমার ভোজন বানাতে পাড়ব।

তাই সে একটি ফুলের মালা হাঁতে নিয়ে সূর্যের দিকে মুখ ঘুড়িয়ে, তপস্যা করার ভান করতে লাগল। এতক্ষণে খরগোশটির নজর সেই বন্য-বিড়ালটির উপর গেল। সে তিতিরটিকে বলল- “ওই দেখ একজন তপস্বী তপস্যা করছে, আমাদের সমস্যাটি সমাধানের জন্য ওই তপস্বীটিকে ডাকলেই হয়ত ভালো হবে।

এরপর তিতিরতি ভয়ে ভয়ে সেই বেড়ালটির কাছে গিয়ে বলল- “মুনিবর আপনি আমাদের ঝগড়া মিটিয়ে দিন। আপনি শুধু বলে দিন কোনটি ন্যায় আর কোনটি অন্যায়?”

এটি শুনে তপস্বী-রূপী বন্য-বিড়ালটি বলল- “বৎস, আমি অনেক বৃদ্ধ, আমি ঠিক মত শুনতে পাই না, তুমি ও তোমার অপর পক্ষকে আমার কাছে নিয়ে এসো, এবং আমার কাছে এসে দুইজনে তোমাদের সমস্যার কথা জানাও। এরপর তিতিরতি খরগোশটিকে বিড়ালটির কাছে নিয়ে আসে।

তারা দুইজনই বিড়ালটির কাছে যেতেই, বন্য বেড়াল, তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, এবং তাদের মেরে ফেলে। এরপর দারুন আনন্দে সে তিতির ও খরগোশকে খেয়ে নিল।

শিক্ষণীয় মজার গল্প জ্ঞানের গল্প
শিক্ষণীয় মজার গল্প জ্ঞানের গল্প

সুতরাং বোঝা গেল যে, নিজের সমস্যা নিজেরাই পরস্পর আলোচনার মাধ্যমে আপস করে নেওয়াই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। অযথা তৃতীয় পক্ষের হস্তান্তর আপনাদের ক্ষতি ডেকে নিয়ে আসতে পাড়ে। কারণ সমস্যা সৃষ্টি করেছেন, আপনারা দুইজন তাই, সমাধানও করতে পাড়বেন আপনারা দুইজনই। তৃতীয় পক্ষের আগমন ঘটলেই সে শুধু সুযোগ খুঁজতে থাকবে। তাই নিজেদের সমস্যা নিজেরাই মিটিয়ে নিতে শিখুন।

পড়ুনঃ- বাংলা নীতি কথা গল্প 

আমাদের গল্প পাঠানোর জন্য নীচের “আপনার লেখা প্রকাশ করুন” বোতামে ক্লিক করুন অথবা আমাদের ফেসবুক পেজে বার্তা পাঠান। অথবা আমাদের মেল করুন- charpatrablog@gmail.com –এ।

শারদীয়রা শুভেচ্ছা রইল। ধন্যবাদ।   

Spread the love

Leave a Reply