আয়রন ডোম কি? আয়রন ডোম কিভাবে কাজ করে?
ইজরায়েল এবং প্যালেস্টাইনের মধ্যে সংঘর্ষের মধ্যেই বর্তমানে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে, ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা অস্ত্র আয়রন ডোম নিয়ে। আজ আমরা জানব আয়রন ডোম কি? আয়রন ডোম কিভাবে কাজ করে? তাহলে জেনে নিই এই ভয়ংকর হাতিয়ার সম্পর্কে কিছু কথা।
ইজরায়েল এবং প্যালেস্টাইনের চরমপন্থি সংগঠন হামাসের মধ্যে লড়াইয়ের বেশ কিছু ভিডিও সামনে এসেছে। এদের মধ্যে একটি ভিডিও Israel Defense Forces বা IDF –এরও রয়েছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে, যে হামাস থেকে ইজরায়েলের দিকে অনেক রকেট ছুটে আসছে, কিন্তু সেগুলি তাদের লক্ষ্য ভেদ করার পূর্বেই হাওয়াতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। হুম এই রকেট গুলিতো আর এমনি এমনি নষ্ট হয়ে যায় নি, তার পেছনে নিশ্চয়ই কিছুর হাত ছিল, আর এই বিধ্বংসী রকেট গুলি ধ্বংস করার মূলে ছিল ইজরায়েলের আয়রন ডোম নামের একটি হাতিয়ার।
অস্ত্রের ইতিহাস
প্রথমে আমরা একটু ইতিহাসের দিকে ঘুরে যাব, তারপর বিস্তারিত জানব। ইজরায়েলের দক্ষিণপ্রান্তে গাজা-র সীমানা বরাবর Sderot নামের একটি শহর রয়েছে। এই শহরের জনসংখ্যা প্রায় ২৭ হাজার। ঘটনার সূত্রপাত ২০০১ সালের ১৬ এপ্রিলে। এই দিনটিতে এমন কিছু ঘটে যায়, যা সেখানকার মানুষ আগে কখনো প্রত্যক্ষ করেন নি। এই দিন থেকে একটি ছোট্ট রকেট প্রায় প্রতিদিন শহরে এসে দাঙ্গা চালাতে থাকে। এই রকেটটি অনেকটা বাড়িতে তৈরি রকেটের মত। কিছুটা বিস্ফোরক পদার্থে ভর্তি থাকত এই রকেটটি। যার ফলে শহরটির কিছু ক্ষতি হয়।
এরপর খোঁজ নিয়ে দেখা যায়। এই রকেটগুলি এসেছে গাজা থেকে। এরপর আরও খোঁজখবর নিয়ে জানা যায় যে, গাজা-তে অবস্থিত হামাস নামের একটি চরমপন্থি সংগঠন এই রকেটগুলি বানিয়েছে। এর আগে হামাস কোনোদিনও ইজরায়েলের ভূখণ্ডের উপর রকেট আক্রমণ করেনি। এর আগে হামাস সরাসরি আক্রমণ করত। কিন্তু এবার তারা দূরে বসেই ইজরায়েলকে আক্রমণ করতে থাকে। ২০০১-২০০৫ এরকম অনেক রকেট হামলার শিকার হয় Sderot কিন্তু ২০০৬ সালে হামাস ইজরায়েলের গাজা থেকে দূরবর্তী তটীয় শহর Ashkelon-এও রকেট হামলা করতে শুরু করে। এই রকেটগুলি পূর্বের রকেট থেকে বেশি শক্তিশালী ছিল।
এই রকেট আক্রমণের প্রায় ১১ বছর পর ২০১২ সালে হামাসের রকেট Tel Aviv এমনকি ইজরায়েলের রাজধানী জেরুজালেমকেও আক্রমণ করে বসে। তবে সবসময় এই রকেট হামলা করা হত না। যখনই ইজরায়েল-প্যালেস্তাইনের মধ্যে পরিস্থিতি একটু উত্তপ্ত হয়ে উঠত তখনই হামাস এই রকেট গুলি নিক্ষেপ করত। ২০০১-২০০৭ সালের মধ্যে কেবলমাত্র Sderot শহরেই ২০০০ –রের বেশি বার রকেট হামলা করে হামাস।
সুতরাং আপনারা বুঝতেই পারছেন সময়ের সাথে সাথে হামাস কিভাবে তাদের অস্ত্রশস্ত্র উন্নত করছিল। ঠিক এরমধ্যেই ইরান হামাসকে সাহায্য করতে থাকে। হুম আপনি হয়ত ভাবছেন, এত হামলার পরেও, ইজরায়েল কি চুপ-চাপ হাত গুটিয়ে বসে ছিল। একদমই নয়। এরমধ্যেই পরিস্থিতি আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠে। ইজরায়েলের ইজবুল্লাহ-তে হামাস গোষ্ঠী প্রায় ৪০০০ রকেট ছাড়ে, যার কবলে ৪৪ জন ইজরায়েল বাসিন্দা মারা যান। এদিকে ইজরায়েলের অভ্যন্তরেও সরকারের প্রতি ধীরে ধীরে ক্ষোভ জমা হচ্ছিল। হামাসের এই রকেট আক্রমণ ঠেকাতে, ইজরায়েলের দরকার ছিল, একটি দক্ষ এবং সুনিপুণ রণনীতি।
এরপর ২০০৭ সালে ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষার জন্য একটি বিশেষ অস্ত্র নির্মাণের জন্য পরিকল্পনা করতে থাকে। পূর্বেই বলা হয়েছে যে, এটি একটি প্রতিরক্ষা অস্ত্র, সেহেতু এর মূল কাজই হল, বৈদেশিক আক্রমণ থেকে নিজ রাষ্ট্রকে রক্ষা করা। অর্থাৎ, বিপক্ষের ছোঁড়া মিসাইল বা রকেট তার লক্ষ্য বস্তুকে আঘাত হানার পূর্বেই ধ্বংস করে দেওয়া। এটি শুনতে যতটা সাধারণ মনে হয়, এই পরিকল্পনাকে বাস্তবে রুপায়ন করা কিন্তু ততটাই কঠিন। কারণ আকাশে দ্রুত গতিতে ধেয়ে আসা কোনো মিসাইলেক টার্গেট করে ধ্বংস করা কোনো সাধারণ ব্যাপার নয়।
এরপর অনেক উথান পতন এবং বাগবিতণ্ডার মধ্যেই ইজরায়েল এই অস্ত্রটি নির্মাণের দায়িত্ব Israel Advanced Defence System এর উপর দিয়ে দেয়। আর এই প্রকল্পটি বাস্তব রূপ দেওয়ার জন্য প্রয়োজন ছিল প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা। এত বিপুল পরিমাণ অর্থ ইজরায়েলের পক্ষে শামিল করা সম্ভব ছিল না। পাশে দাঁড়ায় আমেরিকা। আমেরিকান তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বারাক- ওবামা ইজরায়েলকে যথাসাধ্য সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেন। কারণ হামাস কিছুতেই শান্তিরক্ষায় সায় দিচ্ছিল না। ওবামার মূল উদ্দেশ্য ছিল দুই পক্ষই যেন শান্তিতে বসবাস করতে পারে।
অনেক আপত্তি সত্যেও আমেরিকান কংগ্রেসের কাছ থেকে ওবামা সরকার ১৫০০ কোটি টাকার একটি বিল পাশ করায় এবং সম্পূর্ণ অর্থ দিয়ে দেয়, ইজরায়েলের হাতে। অবশেষে ইজরায়েল একটি অস্ত্র উদ্ভাবন করে। ২০০১ এর হামলার প্রায় ১০ বছর পর ২০১২ সালে হামাস ইজরায়েলের উদ্দেশ্যে একটি রকেট ছূরে। ইজরায়েলের নবনির্মিত এই অস্ত্রটি হাওয়াতেই সেই রকেটটিকে ভস্মীভূত করে দেয়। আর এই অস্ত্রটিই হল আয়রন ডোম।
১৪ নভেম্বর ২০১২ ইজরায়েল একটি এয়ার স্ট্রাইক করে। এই হামালায় হামাসের মিলিটারি চীফ আহম্মদ জবারি মারা জান। এর মধ্যেই ইজরায়েলের কাছে, খবর আসে হামাস পাল্টা আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। এবার তাদের রকেট জেরুজালেমকেও আক্রমণ করতে পারে। কারণ ইরান হামাসকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। এবার হামাস দুরপাল্লার রকেট নিক্ষেপণের জন্য প্রস্তুত হয়।
READ MORE:-
শিক্ষণীয় ছোট গল্প।।মোটিভেশনাল ছোট গল্প।
ব্ল্যাক হোল ।। ব্ল্যাক হোল কিভাবে সৃষ্টি হয় ?
ঠিক এরপর হামাস ইজরায়েলের টেল আবিব-এ রকেট হামলা করে। কিন্তু ইজরায়েলের আয়রন ডোম, বেশিরভাগ রকেটকে হাওয়াতেই ধ্বংস করে দেয়। আয়রন ডোমের লক্ষ্য বস্তু ভেদন ক্ষমতা ছিল প্রায় ৮০-৯০% । এবার অনেক ক্ষয়-ক্ষতির হাত থেকে ইজরায়েল বেঁচে যায়, কেবলমাত্র আয়রন ডোমের জন্য। তাই ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় আয়রন ডোমের সংযোজন শুরু করে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
আয়রন ডোম কিভাবে কাজ করে? INSANE WEAPONS IRON DOME
আয়রন ডোম অনেকগুলি ব্যাটারির সহযোগিতায় তার কাজ করে। এখানে ব্যাটারি বলতে চলন্ত রকেটকে প্রতিহত করার প্রতিটি একককে বলা হয়েছে। আসুন এবার বিস্তারিত জেনে নিই-
প্রতিটি ব্যাটারির তিনটি অংশ থাকে। এই তিনটি অংশ হল- ১) র্যাডার ২) কন্ট্রোল সেন্টার এবং ৩) লাঞ্চার।
র্যাডারঃ- এটি রকেট-কে ট্র্যাকিং করে। অর্থাৎ যখনই কোনো রকেট এই র্যাডারের কভারেজ এলাকার মধ্যে ধরা পড়ে, সাথে সাথেই এই র্যাডার রকেটটির স্পীড এবং গতিমুখ ও গতিপথ নির্ধারণ করে ফেলে, এবং পরবর্তী অংশ অর্থাৎ কন্ট্রোল সেন্টারে পাঠিয়ে দেয়।
কন্ট্রোল সেন্টারঃ- গুরুত্বপূর্ণ সিধান্ত এই কন্ট্রোল সেন্টার নিয়ে থাকে। এখানে অনেক উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কম্পিউটার লাগানো থাকে। এই কম্পিউটার নির্ধারণ করে, রকেটটি কোথায় পড়তে পারে। এটি ডিটেক্ট করে, রকেটটি কোনো ফাঁকা জায়গায় পড়বে, নাকি কোনো জনবসতিযুক্ত এলাকায় বা কোনো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পড়বে! যদি রকেটটি জনবসতি যুক্ত এলাকায় বা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পড়ার সম্ভাবনা আছে, তাহলে এটি লাঞ্চারকে সংকেত পাঠায়। আর যদি কোনো ফাঁকা জায়গায় রকেটটি পড়ার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে সেটির বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না।
লাঞ্চারঃ- যদি কন্ট্রোল সেন্টারের মনে হয় যে, সেই রকেটটিকে থামাতে হবে, তাহলে কন্ট্রোল সেন্টারের সিগন্যাল লাঞ্চারে পৌছায়। এরপর লাঞ্চার দ্রুত একটি রকেট ধ্বংসকারী মিসাইল ছুরে দেয়। কখন কোনদিকে মিসাইল ছুড়তে হবে, এর পরিপূর্ণ গাইড করে, কন্ট্রোল সেন্টার। এই মিসাইলটিকে বলা হয় ইন্টারসেপ্টর। এই ইন্টারসেপ্টরে আরেকটি ছোট রাডার লাগানো থাকে। এই রাডার এবং কন্ট্রোল সেন্টারের সঙ্গে নিয়মিত তথ্য আদান-প্রদান হয়ে থাকে। এর গতি কন্ট্রোল সেন্টার ও ইন্টারসেপ্টরে লাগানো রাডার দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। যখন রাডারটি ডিটেক্ট করে সে রকেটটির কাছাকাছি চলে এসেছে, তখন এটি বিস্ফোরিত হয়ে যায়। অপরদিকে রকেট জ্বালানি পদার্থে পূর্ণ থাকায় এটিও ইন্টারসেপ্টরের সাথে সাথে বিস্ফোরিত হয়ে যায়। ও হ্যাঁ আরেকটি কথা এদের মধ্যে কোনো তার বা প্রবাহী থাকে না। যা হয় সম্পূর্ণ wireless হয়ে থাকে।
আশা করছি এই ব্লগে আপনি আয়রন ডোম সম্পর্কে অনেক কিছুই জনাতে পেরেছেন। ভালো লাগলে লাইক করতে ভুলবেন না। আর হ্যাঁ যদি কোথাও ত্রুটি থেকে থাকে, কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না যেন।
কি কেন কীভাবের উপর গড়ে ওঠা মানুষের জিজ্ঞাসু মন সর্বদাই নতুন দিগন্তের সন্ধানে পা বাড়ায় ৷ প্রতিটি পদক্ষেপেই নতুন কিছু অভিজ্ঞতা আমাদের ঝুলিতে জমা হয় ৷ সেই অভিজ্ঞতা সকলের সাথে ভাগ করে নেওয়ার মধ্যে এক অফুরন্ত আনন্দ লুকিয়ে থাকে ৷ আর সেই কাজেই হাত বাড়িয়েছে ছাড়পত্রের টিম।
ধন্যবাদ।।