মুঘল সম্রাট আকবরের রাজসভার একজন অন্যতম বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব হলেন বীরবল। আকবর বীরবল এর কাহিনী অন্যতম শিক্ষণীয় গল্প। এই গল্পগুলিতে অনেক জ্ঞানের খোরাক রয়েছে। অনেক শিক্ষণীয় জিনিস রয়েছে এই আকবর বীরবলের গল্প গুলিতে। আজকের ব্লগে আমরা আকবর বীরবলের শিক্ষণীয় গল্প পড়ব।
আকবর বীরবল এর কাহিনী। শিক্ষণীয় ছোট গল্প
গল্প-১ সবথেকে বড় হাতিয়ার
একদিন সম্রাট আকবর ও বীরবল গল্প করছেন, এমন সময় আকবর বীরবলকে জিজ্ঞাসা করলেন- “আচ্ছা বীরবল বল তো, এই পৃথিবীতে সবথেকে বড় হাতিয়ার কি?” বীরবল বললেন- “বাদশাহ, এই পৃথিবীতে সবথেকে বড় হাতিয়ার হল আত্মবিশ্বাস।“
বীরবলের এই জবাবে আকবর ঠিক-একটা সন্তুষ্ট হলেন না, তিনি এই কথাটিকে নিজের মনের মধ্যেই রেখে দিয়ে ভাবলেন, উপযুক্ত সময়ে এর পরীক্ষা করব।
দৈবক্রমে একদিন, আকবরের হাতিশালের একটি হাতি পাগল হয়ে গেল। হাতি পাগল হয়ে গেলে সেই হাতিটিকে একটি খাঁচার মধ্যে রেখে দেওয়া হয়, যাতে এটি কারও ক্ষতি করতে না পাড়ে। এই সময় আকবর বীরবলের আত্মবিশ্বাসের ভাবনা পরীক্ষা করে দেখতে চাইলেন, তিনি দেখতে চাইলেন কিভাবে বীরবল আত্মবিশ্বাসের মাধ্যমে হাতির হাত থেকে রক্ষা পায়। তিনি বীরবলকে অতি শীঘ্র রাজদরবারে হাজির হওয়ার জন্য খবর পাঠালেন।
এদিকে সম্রাট তার কর্মচারীদের নির্দেশ দিলেন, বীরবল আশা মাত্রই সেই পাগল হাতিটির খাঁচার দরজা যেন খুলে দেওয়া হয়, তারপর তিনি বললেন- “দেখি কিভাবে আত্মবিশ্বাস সবথেকে বড় হাতিয়ার হয়।“
অপরদিকে বীরবল, নিজের মনেই রাজদরবারের দিকে হেঁটে হেঁটে আসছেন, এমন সময় সেই পাগল হাতিটির দরজা খুলে দেওয়া হল। হাতিটি বীরবলকে দেখে দ্রুত চিৎকার করতে করতে তার দিকে ছুটে যেতে লাগল।
কিন্তু হাতির এই ছুটে আসা দেখে, বীরবল ঘাবড়ে না গিয়ে, মনে মনে বললেন, এ নিশ্চয় সম্রাটের নির্দেশ, আর সম্রাট তার আত্মবিশ্বাস পরীক্ষা করতেই এই নির্দেশ দিয়েছেন। বীরবল ছিল অনেক শান্ত,চতুর এবং আত্মবিশ্বাসী। সে পাগল হাতিকে তার দিকে ছুটে আসতে দেখে, এদিক-ওদিক কোথাও পালালো না, কারণ পালিয়েও কোনো লাভ নেই। এদিকে হাতিটি তার অনেকটা কাছে চলে এসেছে। এমন সময় বীরবল দেখল, তার পাশ দিয়েই একটি কুকুর দৌড়ে যাচ্ছে, হাতির আগে আগে। বীরবল এটি দেখে তাড়াতাড়ি কুকুরটির পেছনের পা গুলি ধরে হাতিটির দিকে ছুঁড়ে দিল।
এরকম হ্যাঁচকা টানের জন্য একদম প্রস্তুত ছিলনা কুকুরটি। কুকুরটি রাগে এবং ভয়ে, জোরে বিকট চিৎকার করে উঠল। হাতিটি এই ধরনের চিৎকার শুনে ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। হাতিটি আর আগে না গিয়ে পেছন ফিরে দৌড়াতে লাগল। এদিকে আকবর মহল থেকে সব কিছুই দেখছিলেন।
এভাবেই বীরবল প্রমান করলেন যে, পৃথিবীর সবথেকে বড় হাতিয়ার হল আত্মবিশ্বাস।
যদি হাতিটিকে তীর বা পাথর বা ইট ছুঁড়ে মারা হত তাহলে সেটি আরও বেশি রেগে যেত, কিন্তু বীরবল উপস্থিত বুদ্ধি প্রয়োগ করে, হাতিটিকে ভয় পাইয়ে দেওয়ার ফলে হাতিটি আর এগিয়ে যাওয়ার সাহস পায়নি। বীরবল আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, তিনি হাতিটিকে দমাতে পাড়বেন। সুতরাং আত্মবিশ্বাস হল পৃথিবীর সবথেকে বড় হাতিয়ার।
পড়ুনঃ- বাংলা অনুপ্রেরণামূলক গল্প
মায়ের ভালোবাসা শিক্ষণীয় গল্প
গল্প-২ সম্রাটের প্রশ্নঃ-
একদিন সম্রাট আকবরের মাথায় তিনটি প্রশ্ন আসে, তিনি কিছুতেই সেই প্রশ্ন গুলির সমাধান খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তাই তিনি সভাসদদের মাঝে বললেন, “যে আমার প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পাড়বে তাকে পুরস্কৃত করা হবে।“ প্রশ্ন গুলি অনেকটা এরকম-
-এমন কি জিনিস আছে যেটি বর্তমানেও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে?
– এমন কি আছে যেটি বর্তমানেও নেই, আর ভবিষ্যতেও থাকবে না?
-এমন কি জিনিস আছে, যেটি বর্তমানে থাকলেও ভবিষ্যতে থাকবে না?
এরপর তিনি বললেন- “শুধুমাত্র উত্তর দিলে হবে না, উত্তরের সাথে সাথে যথাযথ উদাহরণও দিতে হবে।“ উপস্থিত সবাই চিন্তায় ,মগ্ন হয়ে যায়। কারও মুখ থেকে কোনো উত্তর বেড় হচ্ছে না দেখে বীরবল বলে উঠলেন-“হুজুর আপনার প্রশ্নের সঠিক উত্তর আমি দিতে পাড়ব, কিন্তু তার জন্য আপনাকে আমার সাথে আপনার রাজ্য ঘুরতে হবে, তাহলে আপনি যথাযথ উদাহরণের সাথেই আপনার উত্তর পেয়ে যাবেন।“
এরপর সম্রাট আকবর ও বীরবল সুফির ছন্দবেশ ধারণ করে, বেড়িয়ে পড়লেন।
কিছুক্ষণ পর তারা বাজারে পৌঁছে গেলেন। এরপর তারা একটি দোকানে ঢুকে পড়লেন। এরপর বীরবল দোকানীকে বললেন- “আমরা ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের জন্য একটি মাদ্রাসা তৈরি করতে চাই, এরজন্য আপনাকে এক হাজার টাকা দিতে হবে।“ এটি শুনে দোকানি তার হিসাব রক্ষককে একহাজার টাকা দিতে বললেন। এবার বীরবল বললেন- “আমি যখন টাকা নিব, তখন আমি আপনার মাথায় জুতোর বারি মারব। প্রত্যেকটা টাকার জন্য একটা করে বারি আপনার মাথায় আমি মারব, রাজী থাকলে বলেন।“
এই কথাটি শোনার পর, দোকানের এক কর্মচারী দারুন রেগে গেল, সে বীরবলকে মারতে উদ্যত হল, কিন্তু দোকানের মালিক তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “হ্যাঁ আমি তৈরি, কিন্তু আমার একটি শর্ত আছে আপনাকে, আমাকে বিশ্বাস জোগাতে হবে যে, আমার দেওয়া টাকা মাদ্রাসা তৈরির কাজেই লাগানো হবে, অন্য কোথাও ব্যয় করা হবে না।“
এই কথাটি বলে, দোকানের মালিক মাথা নিচু করে বললেন- “জুতো মারা শুরু করুন।“ এটি দেখার পর বীরবল দোকানীকে কিছু না বলেই, সম্রাট আকবরকে নিয়ে দোকানের বাইরে চলে এলেন।
এরপর তারা চুপচাপ রাস্তা দিয়ে আবার হাঁটতে লাগলেন। এবার বীরবল বলতে শুরু করলেন- “সম্রাট, দোকানে যা কিছু হয়ে গেল তার মানে দাঁড়ায় যে, দোকানদারের কাছে আজ টাকা আছে, আর সেই টাকাকে সে মহৎ কাজে ব্যয় করতে চায়, যাতে ভবিষ্যতেও তার নাম থেকে যায়।
সুতরাং এর অর্থ দাঁড়ায়- নিজের মহৎ কাজের মাধ্যমে মানুষ স্বর্গে নিজের জায়গা করে নিতে চায়। অর্থাৎ আপনি বলতে পাড়েন যে, তার কাছে আজ যা আছে, ভবিষ্যতেও তা থাকবে। আর এটিই হল আপনার প্রথম প্রশ্নের উত্তর।
এরপর তারা হাঁটতে হাঁটতে একজন ভিক্ষুকের কাছে যায়। তারা দেখল যে, একজন মানুষ সেই ভিক্ষুককে কিছু খাবার দিচ্ছেন, আর সেই খাবারটি প্রয়োজনের অতিরিক্ত। এরপর বীরবল সেই ভিখারিটির কাছে গিয়ে বললেন- “আমার অনেক খিদে লেগেছে, আমাকেও কিছু খাবার দিন।“
এই কথাটি শোনার পর সেই ভিক্ষুক খুব রেগে গেলেন, এবং বললেন- “পালা এখান থেকে, কিজানি কোথা থেকে এসে জোটে এরা।“
এরপর সম্রাট ও বীরবল কিছু না বলে এগিয়ে চললেন।
যেতে যেতে বীরবল বললেন- “হুজুর এখন যে ঘটনাটি ঘটল সেটি হল আপনার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর। এই ভিক্ষুকটি নিজেকে ঈশ্বরের সেবক মনে করেন, অথচ তিনি সাধারণ মানুষকেই খুশি করতে পাড়েন না, ঈশ্বরকে কি খুশি করবেন? এর মানে দাঁড়ায় যেটি আজ তার কাছে আছে, সেটি ভবিষ্যতে আর তার কাছে থাকবে না।“
এরপর তারা আরও এগিয়ে যেতে লাগলেন।
এরপর তারা দেখলেন, একজন তপস্বী গাছের নীচে বসে তপস্যা করছেন। বীরবল সেই তপস্বীর কাছে গিয়ে, তার সামনে কিছু অর্থ রেখে দিলেন। এটি দেখে তপস্বীটি বললেন-“এগুলিকে শীঘ্র এখান থেকে সরাও। এই টাকা গুলি নিলে বেইমানী হবে, আর বেইমানী করা টাকা আমার চাই না।“
“হুজুর এটি হল আপনার পরের প্রশ্নের উত্তর, এর মানে হল এখন তার কাছে কিছুই নেই, কিন্তু সে কিছু অর্জনের চেষ্টা করছে। তাই বর্তমানে তার কাছে সুখ নেই ঠিকই, কিন্তু ভবিষ্যতে তার কাছে অনেক সুখ থাকবে।“
প্রশ্নের এরূপ উত্তর পেয়ে সম্রাট আকবর বেজায় খুশি হলেন। এরপর আকবর ও বীরবল রাজমহলের দিকে পা বাড়ালেন।
আমাদের লেখা পাঠানোর জন্য এই পেজের নীচে দেখবেন আপনার লেখা প্রকাশ করুন নামে একটি বোতাম আছে, সেখানে ক্লিক করে অতি-সহজেই আপনার লেখা আমাদের পাঠাতে পাড়েন। এই আকবর ও বীরবলের গল্প গুলি আপনার কেমন লাগল তা আমাদের জানাতে ভুলবেন না যেন!
কি কেন কীভাবের উপর গড়ে ওঠা মানুষের জিজ্ঞাসু মন সর্বদাই নতুন দিগন্তের সন্ধানে পা বাড়ায় ৷ প্রতিটি পদক্ষেপেই নতুন কিছু অভিজ্ঞতা আমাদের ঝুলিতে জমা হয় ৷ সেই অভিজ্ঞতা সকলের সাথে ভাগ করে নেওয়ার মধ্যে এক অফুরন্ত আনন্দ লুকিয়ে থাকে ৷ আর সেই কাজেই হাত বাড়িয়েছে ছাড়পত্রের টিম।
ধন্যবাদ।।