আজ আমরা ইতিহাসে ঘটে যাওয়া কিছু দুঃখজনক বিমান দুর্ঘটনা সম্পর্কে জানব। বিশ্বের ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনার কিছু ঘটনা আপনাদের সামনে তুলে ধরা হল। এই ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা গুলি শরীরের লোম খাঁড়া করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
বিশ্বের ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা ভয়াবহ সব ঘটনা
তেনেরীফ বিমান দুর্ঘটনাঃ-
১৯৭৭ সাল ২৭ মার্চ। পৃথিবীর ইতিহাসে ঘটে যায় খুবই দুঃখজনক বিমান দুর্ঘটনা। এই বিমান দুর্ঘটনাটি পৃথিবীর ইতিহাসের সবথেকে বড় বিমান দুর্ঘটনা মানা হয়ে থাকে। কারণ ৫৮৩ জন যাত্রী এই দুর্ঘটনায় মারা যান।
ফ্রান্সের কানারিয়া দ্বীপে অবস্থিত বিমান বন্দর গান্দো। বিমান বন্দরে বোমা বর্ষণ করার ফলে, সকল বিমান গুলিকে কাছের ছোট্ট একটি বিমান বন্দর লোস রোদেওস-এ ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। যেহেতু ঘটনার দিনটি ছিল রবিবার, স্বভাবতই সেদিন ছুটি ছিল, কেবলমাত্র দুইজন কন্ট্রোল টাওয়ারের কর্মী কাজ করছিল। গান্দো বিমান বন্দরের ফ্লাইট গুলি এখানে ঘুড়িয়ে দেওয়ার ফলে, ছোট্ট এই বিমান বন্দরে ট্রাফিক জ্যাম লেগে যাওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে যায়।
বিকেলের দিকে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ায় গান্দো বিমান বন্দর পুনরায় চালু করা হয়, যেহেতু লোস রোদেওস বিমান বন্দরে ট্র্যাফিক জ্যামের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, সেহেতু, বিমানগুলি ফ্লাইটের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে।
এই বিমান বন্দরেই ছিল ডাচ এয়ারলাইনস K-L-M র একটি বিমান, এই বিমানটিতে সর্বমোট ২৩৪ জন যাত্রী ছিল আবার এদের মধ্যে ৫৩ জনই ছিল শিশু। অপরদিকে এখানেই ছিল প্যান এম এর একটি বিমান। এই বিমানে ৩৮০ জন যাত্রী এবং ১১ জন ক্রু মেম্বার ছিল।
KLM এর ক্যাপ্টেনের ফ্লাইট আওয়ার শেষ হতে থাকায়, তিনি তাড়াহুড়ো শুরু করে দেন। কারণ দেড়ি করলে তার লাইসেন্স বাতিল হয়ে যেতে পাড়ে, অথবা মোটা অংকের টাকা জরিমানা দিতে হতে পাড়ে। তাই সময় বাঁচানোর জন্য তিনি অন্য বিমান বন্দরে যাতে Re-fuelling করতে না হয়, তিনি এই বিমান বন্দরেই অতিরিক্ত পরিমাণ জ্বালানি বিমানে ভড়ে নেন। যদিও নিয়ম অনুসারে অতিরিক্ত জ্বালানি নেওয়া অনুচিত, কারণ এর ফলে বিমান ভারী হয়ে যাবে, এবং দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু ক্যাপ্টেন এই নিয়ম মানেন নি। আবার এই অতিরিক্ত জ্বালানি নেওয়ার জন্য প্রায় ৪০ মিনিট সময় সে অতিরিক্ত লাগিয়ে দিয়েছিল। যার ফলে প্যান এম নামে বিমানেরও পথ আঁটকে যায়। এদিকে সময় গড়াতে গড়াতেই নিকটবর্তী পাহাড় থেকে নেমে আসে ঘন কুয়াশা।
কন্ট্রোল রুম নির্দেশ দিয়েছিল- প্যান এম, কে এল এম বিমানের পিছু পিছু যাবে। রান ওয়েতে আসার পর প্যান এম বামে ঘুরে যাবে আর অন্যদিকে কে এল এম রানওয়েতে ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে রানওয়েতে নিজের যাত্রা স্থলে চলে যাবে। এরমধ্যেই কুয়াশা আর তীব্র হতে থাকে, দৃষ্টি সীমানা ৫০০ মিটারে নেমে যায়। কুয়াশার জন্য প্যান-এম এর পাইলট তিন নম্বর গেটকে ঠিক মত দেখতে পায় নি।
অপরদিকে কে-এল-এম এর পাইলট পূর্বে দেওয়া নির্দেশ মত ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে উড্ডয়নের জন্য পুরো প্রস্তুতি নিয়ে নেয়। অন্যদিকে কো-পাইলট ক্লিয়ারেন্স না নেওয়ার কথা জানায়, এবং কন্ট্রোল রুমে জানিয়ে দেয়- “we are now taking off” কো-পাইলটের এই কথার অর্থ ঠিক মত না বুঝেই কন্ট্রোল রুম জানিয়ে দেয়- “Ok” এটা শুনেই কে-এল-এম এর ক্যাপ্টেন বলে দেন- “we are going” এর উত্তরে কন্ট্রোল রুম একটু অপেক্ষা করতে বলে।
যদিও ঠিক একই সময়ে প্যান-এম এর ক্যাপ্টেন বলেন যে, তারা রানওয়েতেই আছেন, কিন্তু দুর্বল রেডিও সিগন্যাল এর জন্য কথাটি ঠিক মত কে-এল-এম বিমানের ক্যাপ্টেন বুঝতে পারেননি। তাছাড়া কন্ট্রোল রুম এবং প্যান-এম এর ক্যাপ্টেন প্রায় একই সময় কে-এল-এম বিমানকে সতর্ক করেছিল, যার ফলে কে-এল-এম এর ক্যাপ্টেন ঠিক মত বুঝে উঠতে পারেননি।
কে-এল-এম বিমানটির ক্যাপ্টেন তাড়াহুড়ো করে, রানওয়েতে চলে আসেন, কিছুদূর আসার পড় তার নজরে প্যান-এম বিমানটি আসে। তিনি ভেবেছিলেন বিমানটি টেক-অফ করে নিয়েছে, কিন্তু বিমানটি তখনও রানওয়ে ছাড়ে নি। অপরদিক থেকে কে-এল-এম আসছে দেখে প্যান-এম দ্রুত রানওয়ে থেকে সরে যেতে চেষ্টা করে, অন্যদিকে কে-এল-এম বিমানটির ক্যাপ্টেন প্যান-এম বিমানটিকে দেখা মাত্রই দ্রুত তার বিমানটিকে উড়িয়ে নেওয়ার অর্থাৎ টেক-অফ করার প্রাণ-পণ চেষ্টা চালান, তিনি প্রায় সফলও হয়ে যান, কিন্তু হঠাৎ কে-এল-এম বিমানটির লেজের অংশটি প্যান-এম এর উপর ধাক্কা লেগে যায়। সঙ্গে সঙ্গে বিমান দুটি ভেঙ্গে যায়।
কে-এল-এম টেক-অফ করতে সফল না হওয়ার অন্যতম কারণ হল অতিরিক্ত পরিমাণ জ্বালানি নিয়ে নেওয়া, এতে বিমানটি ভারী হয়ে যায়, এবং টেক-অফ করতে বেশি সময় লাগিয়ে দেয়।
এই মর্মান্তিক ঘটনায় কে-এল-এম বিমানটির সব যাত্রী এবং ক্রু মেম্বার মারা যান, অন্যদিকে প্যান-এম বিমানটির ৮০% যাত্রীই মারা যান, অনেকেই পঙ্গু হয়ে জীবন কাটান। আর হ্যাঁ ঘটনাটি যখন ঘটেছিল তখন স্থানীয় সময় ছিল সন্ধ্যা প্রায় ৬.০০ টা। একদিকে কুয়াশা অন্যদিকে কে-এল-এম বিমানের ক্যাপ্টেনের তাড়াহুড়ো ও কন্ট্রোল রুমের দুর্বল সিগন্যাল এই দুর্ঘটনাটির জন্য দায়ী।
বিশ্বের ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা AIR INDIAN FLIGHT- 182:-
১৯৮৫ সালের ২৩ জুন। বিমানটির নাম ছিল কনিস্ক। ৬ ঘণ্টার মধ্যে বিমানটির লন্ডনে ল্যান্ড করার কথা ছিল, এরপর দিল্লীর উদ্দেশ্যে বিমানটির যাত্রা করার কথা ছিল। রাত প্রায় ২.০০ টা, বিমানটি মণ্টরিল থেকে লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু কেউই জানত না যে, কিছুক্ষণের মধ্যেই পৃথিবীর ইতিহাসে সবথেকে ভয়াবহ আতঙ্কবাদী বোমা হামলা হতে চলেছে বিমানটিতে। বিমানটি তখন আয়ারল্যান্ডের দক্ষিণ দিক দিয়ে আটলান্টিক মহাসাগরের উপর দিয়ে সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩১,০০০ ফুট উচ্চতায় নিজের যাত্রা পথের দিকে এগোচ্ছিল।
সময় ৭.১৪ মিনিট একটি হালকা শব্দ সেনার রাডারে আসে। রাডারের সিগন্যালে থাকা এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান হঠাৎ হারিয়ে যায়। তখন বিমানটি আয়ারল্যান্ডের সমুদ্রতট থেকে প্রায় ১৬০ কিমি দূরে ছিল, কিন্তু কন্ট্রোল রুমের কেউই জানত না, একটি বিশাল বড় দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। আকাশেই বিমানটি বিস্ফরিত হয়ে যায়। বিস্ফোরণের তীব্রতা এতটাই ছিল যে, প্রায় ৬ কিমি পর্যন্ত বিমানটির বিচ্ছিন্ন টুকরো ছিটকে পরেছিল।
অনেক চেষ্টা করেও যখন ফ্লাইট ১৮২ এর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায় নি, তখন এমারজেন্সি জাহাজ এবং বিমানকে ফ্লাইট ১৮২ এর শেষ সংকেতের স্থানে পাঠানো হয়। এরপর যে খবর আসে তা সাবার হৃদয় কাপিয়ে দেয়, পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম বাড়ের জন্য কোনো বিমান আতঙ্কবাদীদের শিকার হয়। কিন্তু তখনও বিমান যে আতঙ্কবাদীদের শিকার হয়েছে, সেটি জানা যায় নি। কিন্তু আতঙ্কবাদীরা কেবলমাত্র কনিস্ক বিমানটিতেই নয়, বোম সেট করে রেখেছিল জাপানের নরিতা বিমান বন্দরের একটি বিমানে। যেমন ভাবে কণিস্কতে একটি পাত্রে বিস্ফোরক রাখা হয়েছিল, ঠিক সেভাবেই জাপানে ল্যান্ড করা একটি বিমানে পার্সেল-এ বিস্ফোরক রেখেছিল আতঙ্কবাদীরা।
বিমান বন্দরেই এটি বিস্ফোরিত হয় এবং কয়েকজন মারা যান। এরপর কানাডা এবং জাপান পুলিশ তদন্তে নতুন মোড় আনে, যখন তারা আবিষ্কার করে যে,যাত্রীদের মধ্যে একজন এমন ছিল যার নাম লিস্টে থাকলেও, সে বিমানে যাত্রা করেনি। অথচ তার জিনিসপত্র বিমানে নিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এরপরেই এটি যে আতঙ্কবাদী হামলা এটি পরিষ্কার হয়। আর এই হামলাটি ঘটিয়েছিল খালিস্থানী জঙ্গি সংগঠন।
EXPLORE MORE:-
বিশ্বের ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা ভয়াবহ দুর্ঘটনা
হরিয়ানার চরখি দাদরি বিমান দুর্ঘটনাঃ-
এবারের বিমান দুর্ঘটনাটি ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দের। অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ২৪ বছর আগের। এই বিমান দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিল ৩৫০ জন যাত্রী। দুর্ঘটনার ভয়াবহতা এতটাই ছিল যে, যাত্রীদের দেহ মূল ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ১০ কিমি দূরে পর্যন্ত ছিন্ন-ভিন্ন অবস্থায় পাওয়া যায়।
শীতকালের সন্ধ্যা ছিল, আকাশ ছিল সম্পূর্ণ পরিষ্কার, হঠাৎ গ্রামের কিছু মানুষ আবিষ্কার করেন, তাদের ক্ষেতের উপর আকাশ থেকে আগুনের গোলা পরছে , আতঙ্কিত মানুষজন দ্রুত ঘড় থেকে বেড় হয়ে পালাতে থাকে। কিছু সাহসী মানুষ ক্ষেতের দিকে দৌড়ে যায়, সেখানকার দৃশ্য দেখে তাদের লোম খারা হয়ে যায়, তারা দেখে যে সেখানে একটি উড়োজাহাজ পড়ে আছে।
এবার ঘটনাটি কিভাবে ঘটেছিল সেই বিষয়ে জেনে নেওয়া যাক। ঘটনাটি ঘটেছিল কাজাকিস্থানের একটি যাত্রীবাহী বিমানের সঙ্গে সৌদি আরবের একটি মালবাহী বিমানের। একটি বিমান দিল্লী থেকে টেক-অফ করছিল, আর আরেকটি বিমান দিল্লী তে নামার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। বিমান দুটি হরিয়ানার চরখি দাদরি নামক গ্রামে একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা লেগে যায়। গ্রাম বাসীদের ভাগ্য যে, বিমান ক্ষেতের উপর ভেঙ্গে পরেছিল, কোনো বাড়ির উপর ভেঙ্গে পড়েনি।
এত জোরে বিমান দুটির মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে যে, বিমান দুটির ভাঙ্গা অংশ এবং যাত্রীদের দেহ মূল ঘটনা স্থল থেকে প্রায় ১০ কিমি দুরেও ছিটকে পরেছিল। গ্রামবাসীদের ক্ষেতের জমি নষ্ট হয়ে যায়, যদিও তারা সরকারের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ বাবদ কিছু অর্থ পেয়েছিল।
আকাশ পরিষ্কার থাকা সত্যেও কিভাবে এতবড় দুর্ঘটনা ঘটে সেটি আজও ধোঁয়াশা। তবে এই দুর্ঘটনার পেছনে কন্ট্রোল রুমের অদূরদর্শিতাকেই দায়ী করেন অনেকে। কারণ টেক-অফ এবং টেক-ইন করার দিকে তারা বিশেষ গুরুত্ব দেয় নি। তাছাড়া রাডার পর্যবেক্ষণে পাইলট এবং কন্ট্রোল রুমের অবহেলা এই দুর্ঘটনার মূল কারণ। যার ফলাফল ভোগ করতে হল ৩৫০ জন যাত্রীকে। এটি তৎকালীন সময়ের ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা গুলির মধ্যে অন্যতম।
কি কেন কীভাবের উপর গড়ে ওঠা মানুষের জিজ্ঞাসু মন সর্বদাই নতুন দিগন্তের সন্ধানে পা বাড়ায় ৷ প্রতিটি পদক্ষেপেই নতুন কিছু অভিজ্ঞতা আমাদের ঝুলিতে জমা হয় ৷ সেই অভিজ্ঞতা সকলের সাথে ভাগ করে নেওয়ার মধ্যে এক অফুরন্ত আনন্দ লুকিয়ে থাকে ৷ আর সেই কাজেই হাত বাড়িয়েছে ছাড়পত্রের টিম।
ধন্যবাদ।।