২১ ফেব্রুয়ারী ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দ, এই দিনটি পৃথিবীর ইতিহাসের এক স্মরণীয় অধ্যায়। কারণ এই দিন থেকেই বিশ্বের সর্বপ্রথম রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হয়। তবে প্রথম দিকের ট্রেনগুলি ছিল বাষ্পীয় ইঞ্জিন চালিত। পরবর্তীতে সময়ের সাথে সাথে ইঞ্জিনের দক্ষতা বাড়িয়ে তোলা হয়, ধীরে ধীরে কয়লা চালিত রেলের যুগ পেড়িয়ে ডিজেল ইঞ্জিনের আবির্ভাব হয়। বর্তমানে বিদ্যুৎ চালিত ট্রেনও প্রচলন হচ্ছে। যতই উন্নত হয়েছে ট্রেন ততই বেড়েছে এর পরিবহণ ক্ষমতা এবং গতি। আবার এই ট্রেন কেন্দ্রিক দুর্ঘটনাও কিন্তু কম হয় না। আর এই দুর্ঘটনা গুলি খুবই ভয়াবহ হয়ে থাকে। আজ আমরা পৃথিবীর ইতিহাসে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা সম্পর্কে আলোচনা করব।
ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ট্রেন দুর্ঘটনা-
শ্রীলঙ্কার “Queen of the sea” ট্রেন দুর্ঘটনা:-
পৃথিবীর ইতিহাসে সবথেকে বেশি ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা মানা হয়ে থাকে, শ্রীলঙ্কার ২০০৪ সালে সুনামির সময় ঘটে যাওয়া “Queen of the sea” নামক ট্রেনের ভয়াবহ দুর্ঘটনা। এই ট্রেনটি শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বো এবং মাতারার মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করত। ট্রেনের যাত্রাপথে রয়েছে ভারত মহাসাগর।
২৬ ডিসেম্বর ২০০৪ খ্রিস্টাব্দ প্রায় ১৮০০ জনেরও অধিক যাত্রী নিয়ে ট্রেনটি কলম্বো থেকে যাত্রা করে। পেরালিয়া গ্রামের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় ট্রেনে থাকা যাত্রীরা সমুদ্রের উপকূল থেকে দানবাকৃতি একটি ঢেউ তাদের দিকে ছুটে আসতে দেখে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই ঢেউটি ট্রেনের বগি গুলির উপর আছড়ে পড়ে। ট্রেনের বগিগুলি সজোরে কেঁপে উঠে। যাত্রীরা আতঙ্কিত হয়ে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দেয়। এর পরের ঢেউটি সব শেষ করে দেয়। বিশালাকৃতির এই ট্রেনটিকে এক ধাক্কায় লাইন থেকে ছিটকে ফেলে দেয় জলের স্রোত। এরপর ট্রেনটি জলের প্রকাণ্ড ঢেউয়ের সঙ্গে আশেপাশের ঘড়-বাড়ি গাছপালা গুলির সাথে দুমড়ে-মুচড়ে যায়।
দুঃখের কথা ১৮০০ জনেরও অধিক যাত্রী থাকলেও শেষ পর্যন্ত জীবনকে ধরে রাখতে পেরেছিলেন মাত্র ১৫০ জন। প্রায় ১৭০০ জন যাত্রী তাদের প্রাণ বিসর্জন দেন, ভারত মহাসাগরের জলে। শোচনীয় ব্যাপার হল মাত্র প্রায় ৭০০ জনের দেহ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। বাকি ১০০০ জনের দেহ তাদের প্রিয়জনেদের কাছে ফিরিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়েছিল সরকার।
বিহারের ট্রেন দুর্ঘটনাঃ-
এবারের হৃদয়বিদারক ট্রেন দুর্ঘটনাটি ভারতের অঙ্গরাজ্য বিহার-এর। ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসের ঘটনা, প্রতিদিনের মত মান্সি এবং সাহারাসা ষ্টেশনের মধ্যে প্রায় ১০০০ জন যাত্রী নিয়ে নিজের গন্তব্যে যাচ্ছিল প্যাসেঞ্জার ট্রেনটি। এই ট্রেনের যাত্রীদের ভাগ্য যে তাদের সাথ দিচ্ছিল না, তা সকাল থেকেই খারাপ আবহাওয়া জানান দিচ্ছিল।
প্যাসেঞ্জার ট্রেনটি সবে-মাত্র বাগমতী নদীর রেল ব্রিজের উপর উঠেছিল। ঠিক এইসময়ে ধেয়ে আসে প্রকাণ্ড ঘূর্ণিঝড়। ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপে ট্রেনটি লাইন থেকে বাগমতী নদীর জলে পড়ে যায়। ট্রেনটি জলে নিমগ্ন হতে থাকে।
উদ্ধারকারী টিম এসে ৫ দিনে মাত্র ২০০ জনের মত মানুষের মৃত দেহ উদ্ধার করতে পেরেছিল। বাকিরা বাগমতী নদীর জলের সাথেই ভেসে যান। মনে করা হয় যে, মৃতের সংখ্যা প্রায় ৫০০-৮০০ জনের মধ্যে। এই ট্রেন দুর্ঘটনাটি পৃথিবীর মধ্যে চতুর্থ বৃহত্তম ট্রেন দুর্ঘটনা মানা হয়ে থাকে।
তবে কেবলমাত্র সাইক্লোন নয়, এই দুর্ঘটনাটির জন্য ট্রেনটির ব্রেক ফেল এবং মেঘ ভাঙ্গা বৃষ্টিকেও দায়ী করা হয়। তবে সঠিক কারণ নিয়ে আজও ধোঁয়াশা রয়েই গেছে।
ফ্রান্সের ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনাঃ-
এবারের ট্রেন দুর্ঘটনাটি এখনও পর্যন্ত ফ্রান্সের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা নামে পরিচিত। তবে এই ট্রেন দুর্ঘটনাটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ের। প্রায় ১০০০ জন ফ্রেঞ্চ সৈন্য নিয়ে ট্রেনটি যাত্রা শুরু করেছিল, কিন্তু মাউরিয়েন উপত্যকার কাছে ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়ে যায়।
অতিরিক্ত পরিমাণ যাত্রী নিয়ে ট্রেনটি নিজের গন্তব্যে যাচ্ছিল। ট্রেনটিতে কিছু আলাদা বগি যোগ করার ফলে ট্রেনটির দৈর্ঘ্য দাঁড়িয়েছিল প্রায় ৩৫০ মিটার। সব মিলিয়ে ট্রেনটির ওজন দাঁড়িয়েছিল প্রায় ৫২৬ টন।
সেই অঞ্চলটিতে লোকোমোটিভ এর ঘাটতির কারণেই ট্রেনটির সাথে কিছু বেশি বগি দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই বগি গুলির মধ্যে প্রথম তিনটি বগির জন্য এয়ার ব্রেক থাকলেও, বাকি বগি গুলির জন্য শুধুমাত্র হ্যান্ড ব্রেক ছিল। যার ফলে এটি খুবই বিপদজনক একটা ব্যাপারে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু সেইদিকে পরোয়া না করেই জুড়ে দেওয়া হয় ১৯ টি বগি।
উপত্যকা থেকে নিচে নামার সময় ট্রেন চালক যতটা আস্তে সম্ভব ততটা আস্তেই ট্রেনটিকে নামাচ্ছিলেন। এইসময় ট্রেনটির গতি ছিল মাত্র ১০ কিমি/ঘণ্টা। কিন্তু কিছুদূর এভাবে যাওয়ার পর হঠাৎই ট্রেনটির গতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে থাকে। চালক ব্রেক কষলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। কারণ ট্রেনটির ভাঁড় অতিরিক্ত বেশি ছিল, যার ফলে পেছনের বগি গুলি ইঞ্জিনকে সামনের দিকে দ্রুত এগোনোর জন্য বাধ্য করছিল।
ব্রেক কাজে না আসায় এবং ট্রেনটির অনিয়ন্ত্রিত গতির জন্য ট্রেনটি লাইন থেকে পড়ে যায়। এই সময় ট্রেনটির গতি ছিল প্রায় ১৩৫ কিমি/ঘণ্টা। প্রথম বগিটি লাইনচ্যুত হয়েছিল প্রায় ১০২কিমি/ঘণ্টা গতিবেগে। যদিও ট্রেনটির গতিবেগ বেঁধে দেওয়া হয়েছিল ৪৫ কিমি/ঘণ্টা।
যেহেতু ট্রেনটির বগিগুলি তৈরিতে কাঠের ব্যবহার বেশি ছিল, সেহেতু বগি গুলি দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়ার সময় একে অপরের সাথে ঘর্ষণ লাগতে থাকে। আবার অন্যদিকে ব্রেকগুলি অতিরিক্ত চাপে খুবই গরম হয়ে গিয়েছিল। এর সাথে হাত মেলায় সৈন্যদের সাথে থাকা মোমবাতি এবং গ্র্যানেড। যার ফলে ট্রেনটিতে ভয়াবহ আগুন লেগে যায়।
মৃত্যু হয় প্রায় ৬৭৫ জনের। ১৩৫ জনের দেহ এত খারাপ ভাবে খতিগ্রস্থ হয়েছিল যে তাদের ঠিকমত শনাক্ত করাও সম্ভব হয়ে উঠেনি।
রাশিয়ার উফা ট্রেন দুর্ঘটনাঃ-
এবারের ট্রেন দুর্ঘটনাটি রাশিয়ার। জুন মাস ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দ। রাশিয়া এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাসে ঘটে যায় ভয়াবহ দুর্ঘটনা। রেল-লাইনের পাশ দিয়েই গেছে একটি গ্যাস পাইপলাইন। সময় ভোর ১.১৫। এই পাইপলাইনে গ্যাস লিক করে এবং আগুন লেগে যায়, ভয়ংকর বিস্ফোরণ ঘটে যায়।
ঠিক এই সময় দুটি প্যাসেঞ্জার ট্রেন প্রায় ১৩০০ জন যাত্রী নিয়ে একে অপরকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল। ট্রেনের যাত্রীদের মধ্যে ঘুম ঘুম ভাব, আবার অনেকেই ঘুমিয়ে গেছেন। এই সময়ে বিস্ফোরণের শব্দশুনে হতচকিত হয়ে যান কিছু যাত্রী। কিছু বোঝার আগেই বিস্ফোরণের তিব্রতায় ঝাঁঝরা হয়ে যায় অনেক যাত্রী। হসপিটাল এবং ঘটনাস্থলে মৃত্যু হয় প্রায় ৫৭৫ জন যাত্রীর। ৮০০ এরও বেশি যাত্রী গুরুতর আহত হয়েছিলেন।
কিন্তু বেসরকারি মতে মৃতের সংখ্যা ছিল প্রায় ৭৮০ জন। এবং এদের মধ্যে ১৮১ জন ছিল শিশু। যারা বেঁচেছিল তাদের মধ্যে অনেকেই পরবর্তীতে ব্রেনের সমস্যা এবং পুড়ে যাওয়া অঙ্গ নিয়ে জীবন-যাপন করেছিলেন।
READ MORE:-
আজব ও অদ্ভুত ১০ টি গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড
মেক্সিকোর ভয়ানক ট্রেন দুর্ঘটনাঃ-
এবারের ট্রেন দুর্ঘটনাটি মেক্সিকো-র। জানুয়ারী মাসের শীতের দিন ছিল, সালটা ১৯১৫। ট্রেনটি প্রায় ৯০০ জন যাত্রী নিয়ে একটি খারা ঢালের মধ্য দিয়ে নামছিল। ট্রেনের চালক, ব্রেকটা ধরেই রেখেছিলেন, কিন্তু এমন সময় ট্রেনটার ব্রেক আর ধরে রাখতে পারেননি চালক, কারণ ট্রেনটির ব্রেক ফেল করেছিল। খারা ঢাল থাকার কারণে, ট্রেনটির গতি বেড়ে যায়।
ট্রেনটি লাইন থেকে আলাদা হয়ে যায়, এবং গুয়াদালাজারার কাছে একটি গিরিখাতে নিমগ্ন হয়ে যায়, তবে বেশিরভাগ মানুষের মৃত্যু হয়, ট্রেন থেকে ছিটকে পড়ে গিয়ে, যেহেতু ট্রেনটির গতি অনেক বেশি ছিল, এবং এত দ্রুত গতিতেই বাঁক নিয়েছিল, সেহেতু ট্রেন থেকে অনেক যাত্রী ছিটকে পড়ে যায়, এবং অনেকেই মারা যান। এই দুর্ঘটনায় প্রায় ৬০০ জন যাত্রী প্রাণ হারিয়েছিলেন।
উপরোক্ত ঘটনাগুলি সম্পর্কিত আপনার গুরুত্বপূর্ণ মতামত আমাদের জানাতে ভুলবেন না। প্রতিদিনের আপডেটের জন্য ফেসবুক পেজ এবং ফেসবুক গ্রুপে জয়েন হতে ভুলবেন না যেন!
কি কেন কীভাবের উপর গড়ে ওঠা মানুষের জিজ্ঞাসু মন সর্বদাই নতুন দিগন্তের সন্ধানে পা বাড়ায় ৷ প্রতিটি পদক্ষেপেই নতুন কিছু অভিজ্ঞতা আমাদের ঝুলিতে জমা হয় ৷ সেই অভিজ্ঞতা সকলের সাথে ভাগ করে নেওয়ার মধ্যে এক অফুরন্ত আনন্দ লুকিয়ে থাকে ৷ আর সেই কাজেই হাত বাড়িয়েছে ছাড়পত্রের টিম।
ধন্যবাদ।।