ব্যর্থদের সফলতার গল্প দুর্বলদের সফলতার গল্প
আজকের ব্লগটিতে আমরা কিছু বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন মানুষদের অনুপ্রেরণামূলক গল্প জানব। শারীরিক সমস্যা থাকলেও মনের সদ ইচ্ছাই যে সাফল্যের মূল চাবিকাঠি তা প্রতিটি মানুষের চোখে এই মহান মানুষেরা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। এরা সবাই আমাদের কাছে অনুপ্রেরণার পাত্র। আমরা শারীরিক দিক থেকে সক্ষম হলেও, আমাদের ভাগ্যকে আমরা দোষ দিয়ে কপাল চাপড়াতে থাকি, কিন্তু কখনোই চেষ্টা চালিয়ে যেতে চাই না। ঘরে বসে কপাল চাপড়িয়ে লাভ কি বন্ধু যদি সমস্যাকে বা নিজের দুর্বলতাকে ভয় পেয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকো? নিজের সমস্যাকে ভয় পেয়ে নয়, বরং সমস্যাকে মসৃণ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে শিখুন।
হুম জানি এসব বলতে যত সহজ, আসল ফিল্ডে ঠিক ততটাই কঠিন। কিন্তু না কঠিন নয়। মনে রাখবেন, আমরা যদি কোনো কাজ যতটা কঠিন ভেবে বসে থাকি, সেই কাজ আমাদের কাছে ঠিক ততটাই কঠিন বলে মনে হবে।
মোটিভেশনাল গল্প ১
ব্যর্থদের সফলতার গল্প।। অনুপ্রেরণা ও সফলতার গল্প
ইনি হলেন অরুনিমা সিনহা। প্রথম বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন মহিলা হিসেবে মাউন্ট এভারেস্ট জয়ের খেতাবধারী তিনিই। ১২ এপ্রিল ২০১১ লখনউ থেকে তিনি দিল্লী যাচ্ছিলেন একটি পরীক্ষা দিতে। কিন্তু পদ্মাবতী এক্সপ্রেস নামক ট্রেনে তিনি এক ডাকাত দলের মুখোমুখি হয়ে যান। ডাকাতেরা তার সোনার চেইন এবং ব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে, অরুনিমা তাদের বাঁধা দেন, এতে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে যায় এবং ডাকাতের দল চলন্ত ট্রেন থেকে তাকে ফেলে দেয়। কিন্তু তার দুর্ভাগ্য যে, অপর লাইন দিয়ে আরেকটি ট্রেন তৎক্ষণাৎ চলে আসে এবং তার একটি পায়ের উপর দিয়ে চলে যায়।
এরপর তাকে উদ্ধার করে, হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হলে, ডাক্তারেরা তাঁর প্রাণ বাঁচাতে, একটি পা কেটে বাদ দিয়ে দেন। এদিকে এভারেস্ট জয়ের ইচ্ছা তাকে পেয়ে বসে। কৃত্তিম পা নিয়েই তিনি চলে যান, পর্বত আহরণের প্রশিক্ষণ শিবিরে। সেখানে সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। ২০১৩ সালে তিনি এভারেস্ট জয় করে নেন। তাঁর এই এভারেস্ট জয়ের শফর ৫২ দিন স্থায়ী হয়েছিল। তাঁর ইচ্ছা তিনি বিশ্বের সব মহাদেশের উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ গুলি জয় করবেন। তাঁর লেখা একটি বইয়ে তিনি বলেছেন- “ No matter how great a loss, time always heals the pain, even though the scars remain.”
মোটিভেশনাল গল্প ২
সুধা চন্দ্রন, যখন তাঁর বয়স মাত্র ১৬ বছর তখন তামিলনাডুতে এক সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁর পায়ে আঘাত পান। তাঁর পায়ে গ্যাংগ্রিন হয়ে যায় এবং ডাক্তারের পরামর্শ মত তাঁর একটি পা কেটে বাদ দিতে হয়। এদিকে সুধাকে পেয়ে বসেছিল নৃত্যের নেশা। নাচ পাগল সুধা, সমস্ত বাঁধা, এবং অক্ষমতাকে পেছনে ফেলে কৃত্তিম পা সঙ্গে নিয়ে তাঁর ইচ্ছাকে পূর্ণ করতে উঠে পড়ে লেগে যান। তিনি বর্তমানে ভারতের বিখ্যাত ভারতনাট্যম নৃত্য শিল্পী। কেবল মাত্র একজন নৃত্য শিল্পীই নয়, তিনি সিনেমাতেও অভিনয় করেছেন। তার মধ্যে দুটি সিনেমা হল- “ময়ূরী” এবং “নাচে ময়ূরী“। তাঁর কথায়- “Once I stepped on the stage, I got my soul back.”
মোটিভেশনাল গল্প ৩
ইনি হলেন বিখ্যাত সংগীত গীতিকার, কম্পোজার, লিরিক্স মেকার রবীন্দ্র জেন। জন্ম অবস্থা থেকেই পুরো পৃথিবী তাঁর কাছে ছিল, কালো অন্ধকারে ভরা। সেই অন্ধকারেই নিজের পথ খুঁজে নিয়েছিলেন তিনি। তিনি বলেন- “You will never be brave if you don’t get hurt, you will never learn if you don’t make mistakes, you will never be successful if you didn’t encounter failure.” তাঁর কাজের জন্য ভারত সরকার তাকে পদ্মশ্রী সম্মানে সম্মানিত করেন।
মোটিভেশনাল গল্প ৪
আপনি কি জানেন, বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের বয়স যখন ৩ বছর হয়ে যায়, তখনও তিনি কথা বলতে পারতেন না। তাঁর বাবার মতে, ছোট বেলায় আইনস্টাইন ছিল একদম জড়বুদ্ধি সম্পন্ন। সাধারণ অঙ্কও তিনি করতে পারতেন না। তাঁর বাবা আরও বলেছেন- আইনস্টাইন একই জিনিস বারংবার করত, যতক্ষণ না পর্যন্ত সে সেই জিনিসটির শেষ সিদ্ধান্তে আসছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সে কিছুতেই হার মানত না।
ব্যর্থদের সফলতার গল্প।। অনুপ্রেরণা ও সফলতার গল্প
হুম এবার আপনি বলুন, আপনি কোনো কাজে ব্যর্থ হওয়ার পর কতবার পুনরায় চেষ্টা করেন? একবার- দুইবার বা বড়জোর তিন বার। আবার অনেকেই একবার চেষ্টা করে, ব্যর্থ হলে চুপচাপ থাকে, তারা এটা ভাবে যে, এই কাজ আমার দ্বারা হবে না। কিন্তু একজন জড়বুদ্ধি সম্পন্ন শিশু যদি পরবর্তীকালে সারা পৃথিবীর কাছে পরিচিত হতে পারে, তাহলে আপনার মাথায় পর্যাপ্ত বুদ্ধি থাকা সত্যেও আপনি শেষ চেষ্টা টুকুও করছেন না কেন?
মোটিভেশনাল গল্প ৫
স্টিফেন হকিংস, এনার সম্পর্কে আশা করছি নতুন করে আর কিছু বলার নেই। ১৯৬২ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে তিনি একটি নিউরোন ঘটিত রোগে আক্রান্ত হন। ডাক্তারেরা বলেছিলেন ২ বছরের বেশি তিনি বাচবেন না। এরপর তাঁর জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তিনি হুইলচেয়ারে কাটিয়েছেন। তিনি কথা বলতেন কম্পিউটার স্পিচ সিন্থেসাইজারের মাধ্যমে।
ব্যর্থদের সফলতার গল্প।। অনুপ্রেরণা ও সফলতার গল্প
তাকে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল আপনি এরকম একটি মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়েও কিভাবে এতকিছু সামলান? এর উত্তরে হকিংস বলেছিলেন- “আমার এই রকম কোনো রোগ আছে, তা তো আমি বুঝতেই পারিনা। আমি স্বাভাবিক জীবন কাটাতেই চেষ্টা করি। আমার নিজস্ব কাজে ব্যাঘাত ঘটায় এরকম কিছুকে আমি একদম পাত্তা দিই না।” হুম বুঝলেন তো, আপনি যদি সমস্যাকে পাত্তা না দিয়ে নিজের রাস্তায় চলতে থাকেন, দেখবেন একসময় আপনার অজান্তেই সমস্যা আপনার রাস্তা থেকে দূরে সরে গেছে।
আরও পড়ুনঃ-
শিক্ষণীয় ছোট গল্প মোটিভেশনাল গল্প
মায়ের ভালোবাসা শিক্ষণীয় গল্প
মোটিভেশনাল গল্প ৬
নিকোলাস জেমস ভুজিসিক- এর জন্মই হয় টেট্রা-অ্যামিলিয়া(জন্ম থেকেই হাত-পা বিহীন) নামের এক উপসর্গ নিয়ে। তাঁর এই অক্ষমতাকে পাশ কাটিয়ে তিনি ২১ বছর বয়সে গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েট হন। তিনি হলেন একাধারে একজন মোটিভেশনাল স্পিকার, একজন সাতারু এবং পেইন্টার। তিনি বিখ্যাত “Attitude is Attitude’ –এর প্রতিষ্ঠাতা।
মোটিভেশনাল গল্প ৭
রোয়ান অ্যাটকিনসন কে আমরা সকলেই চিনি, এখনও বুঝলেন না কার কথা বলছি? আমি আমাদের প্রিয় কমেডিয়ান মিঃ বিন-এর কথা বলছি। কোনো বাক্য ব্যয় না করে, তিনি যেভাবে আমাদের মনকে খুশি করে তুলেছেন, তা আর আশা করছি, নতুন ভাবে বলার কিছুই নেই। যে মানুষ ঠিক মত কথা বলতে পাড়েন না, তাকে কি আর কোনো সিনেমাতে নেওয়া যায়? রোয়ান অ্যাটকিনসন- এর ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়েছিল। মাঝে মধ্যেই তাঁর কথা আঁটকে যেত। অনেক বার তিনি প্রত্যাখ্যান-ও হয়েছিলেন। কিন্তু সে আর যাই হোক, তিনি তাঁর জায়গা ঠিকই তৈরি করে নিয়েছিলেন। বিখ্যাত Quote- “I love walking in the rain, because no one can see me crying”- তিনিই বলেছিলেন।
মোটিভেশনাল গল্প ৮
হেলেন কেলার, বয়স মাত্র ১৯ মাস ঠিক তখনই গুরুতর ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। বাবা-মা নিরাশ হয়ে চিকিৎসা শুরু করান। তিনি সুস্থ হন ঠিকই কিন্তু তাঁর কথা বলার শক্তি, শ্রবণ ক্ষমতা এবং দৃষ্টি শক্তি চিরতরে হারিয়ে যায়। এই বহুমুখী প্রতিবন্ধকতাকে সাথে নিয়েই তাঁর পথ চলা শুরু। বাবা-মা নিয়ে যান, টেলিফোনের জনক গ্রাহাম বেলের কাছে। তিনি জানান হেলেন-এর প্রতিবন্ধকতাকে কোনো দিনই ঠিক করা সম্ভব নয়। কিন্তু তাকে যদি সঠিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়, অবশ্যই সে জীবনে অনেক কিছু করতে পারবে। এরপর এক গৃহ শিক্ষিকার কাছে পড়াশোনা শুরু।
ব্যর্থদের সফলতার গল্প।। অনুপ্রেরণা ও সফলতার গল্প
ধীরে ধীরে আয়ত্ত করলেন অনেক কিছু। এরপর তিনি নিজেকে একজন আদর্শ সমাজ সেবিকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করান। শুরু হয় তাঁর নতুন জীবনের পথ চলা। তিনি সর্বমোট ১২ টি বিখ্যাত বই রচনা করে গেছেন। এমনকি একজন দৃষ্টি ও শ্রবণশক্তিহীনের জীবনের বিষাদের উপর একটি চলচিত্রও তিনি নির্মাণ করেন। মূল ভুমিকায় অভিনয় করেন তিনি নিজেই।
মোটিভেশনাল গল্প ৯
এবার আমার নিজের চোখে দেখা একজনের সংগ্রামের কথা বলি। আমাদের পাশের গ্রামেই এক দাদা বাস করে, যদিও বাড়ির অবস্থা মোটামুটি ভালই, তবে আসল সমস্যা হল দাদার হাত ও পা নিয়ে, দাদার ডান হাত এবং ডান পা, প্যারালাইসিস। বাম হাতের সব আঙ্গুল ঠিক মত কাজ করে না। দাদার স্বপ্ন কলেজের অধ্যাপক হওয়ার, আর এদিকে তার স্বপ্ন পূরণের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তার শারীরিক অক্ষমতা। বাধ্য হয়েই সে ইচ্ছা থাকলেও উপায় নেই, এরকম অবস্থার সম্মুখীন হয়।
অনেক দিন দাদাকে, বাইরে দেখিনি। প্রায় ২ বছর পর, শুনলাম দাদা নাকি তার স্বপ্ন পূরণে সফল হয়ছে। পড়ে সে আমাকে জানায়, এই ২ বছর সে নিজেকে ভাল-ভাবে তৈরি করে। সে খুব লেখালেখি শুরু করে, যার ফলে তার হাতের অক্ষমতা তার মনের জেদের কাছে হার মেনে যায়। একটা সময় সে নাকি ভেবেছিল- এই মূল্যহীন জীবন নিয়ে বেঁচে থেকে আর কোনো লাভ নেই। কিন্তু পরবর্তীতে সে বুঝে যায়, জীবন যুদ্ধ মানেই সমস্যা আর ব্যর্থতা। সেই সমস্যাকে কাটিয়ে উঠতে পারলেই, সমস্যাকে জেদের কাছে হার মানতে হয়।
না আমি এটি কোনো গল্প বলছি না। এই লিস্টে আমাদের পাশের পাড়ার দাদাকে রাখার একমাত্র কারণ হল, আমি দাদাকে আমার নিজের চোখে, তার অক্ষমতাকে পাশ কাটিয়ে লড়াই করতে দেখেছি।
এই সমস্ত ব্যাক্তিরা যদি নিজের ভাগ্যকে দোষ দিয়ে, কপালের দোষ হিসেবে চালিয়ে দিতেন, তাহলে কি আজ তারা বিশ্বের কাছে পরিচিতি পেতেন? এবার অনেক মানুষই বলবেন- “বাপের টাকা থাকলে এমন অনেক কিছুই করা যায়।“ তাদের বলছি- অনেক নিচু ভাবনা পোষণ করছেন আপনি, আপনি আপনার এই ভাবনাটি থেকে বেড় হয়ে দেখুন, বিশ্ব আপনাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে অনেক এগিয়ে গেছে, আর আপনি বেচারা টাকা থাকলেই সব হয়, এই ভাবনা মাথায় নিয়ে কপাল চাপড়াচ্ছেন। আমাকে গালমন্দ করবেন না প্লিজ, কারণ সত্য সবসময় তেতোই হয়।
অবশেষে বলব-
দুর্বলতা সবারই থাকে। মানুষের সর্বমোট তিনটি হাত থাকে। হ্যাঁ ঠিকই পড়েছেন তিনটি হাত থাকে। ডান হাত, বাম হাত ছাড়াও আরেকটি হাত আমাদের রয়েছে। আর সেটি হল অজুহাত। এটি খুবই ভয়ংকর হাত। যেখানে এ টাচ করবে, সেখানেই ধ্বংসের দিকে যাবে। আর সবথেকে দুঃখের ব্যাপার হল এই অজুহাতকে আমরা দেখতে পারি না। তাই আমরা একে আমাদের মধ্যে থেকে দূর করারও চেষ্টা করি না। তাই অজুহাত নয়, এখনই শুরু করুন, দেখি আপনাকে কে আটকায়?
কি কেন কীভাবের উপর গড়ে ওঠা মানুষের জিজ্ঞাসু মন সর্বদাই নতুন দিগন্তের সন্ধানে পা বাড়ায় ৷ প্রতিটি পদক্ষেপেই নতুন কিছু অভিজ্ঞতা আমাদের ঝুলিতে জমা হয় ৷ সেই অভিজ্ঞতা সকলের সাথে ভাগ করে নেওয়ার মধ্যে এক অফুরন্ত আনন্দ লুকিয়ে থাকে ৷ আর সেই কাজেই হাত বাড়িয়েছে ছাড়পত্রের টিম।
ধন্যবাদ।।