আজ আবার তিনটি বীরবলের গল্প নিয়ে নতুন আরেকটি ব্লগে হাজির হলাম। বীরবল ছিলেন সম্রাট আকবরের একজন অত্যন্ত প্রিয়পাত্র। নিজের বুদ্ধিদীপ্ত মনোভাবের জন্যই তিনি সম্রাটের মনে এক বিশেষ জায়গা করে নিয়েছিলেন। বীরবলের হাসির গল্প। বীরবলের কাহিনী।

বীরবলের গল্প। বীরবলের হাসির গল্প। বীরবলের কাহিনীঃ-

বীরবলের হাসির গল্প ০১ঃ-

দুপুরের খাওয়ার শেষ করার পড়, সম্রাট আকবর বিশ্রাম করছেন। সাথে রয়েছে বীরবল। সম্রাট বীরবলকে জিজ্ঞাসা করলেন- “আচ্ছা বীরবল বল তো, এই পৃথিবীতে কাদের সংখ্যা সবথেকে বেশি, যারা চোখে দেখে অর্থাৎ ভালো মানুষ নাকি অন্ধদের?

সম্রাট এই সময়ে আপনার প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়, কিন্তু আমার মনে হয় পৃথিবীতে ভালো মানুষের চেয়ে অন্ধের সংখ্যা বেশি হবে।

সম্রাট- “উঁহু এভাবে বললে হবে না, তোমাকে তোমার কথার ভিত্তিতে যুক্তি উপস্থাপন করতে হবে।“  বীরবলও সম্রাটের এই কথা স্বীকার করে নিলেন।

পরের দিন বীরবল দুইজন রাজকর্মচারীকে নিয়ে বাজারে চলে গেলেন। সেখানে একটি জায়গায় বসে তিনি জাল বুনতে লাগলেন। দেখতে দেখতে সেখানে ভিড় জমে গেল। সবাই দেখতে উৎসুক হয়ে গেল যে, কিভাবে জাল বুনা হয়! সেখানে উপস্থিত ব্যক্তিরা বীরবলকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন- “বীরবল তুমি এটা কি করছ?”

বীরবলের কাছে থাকা দুইজন রাজকর্মচারী, যারাই বীরবলকে এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করছে তাদের নাম লিখে নিতে লাগল। এই কথা পাঁচকান হতে হতে রাজার কানেও গিয়ে পৌছাল। এই কথা শোনামাত্রই সম্রাট দলবল নিয়ে বাজারে বীরবলের কাছে চলে এলেন এবং বীরবলকে সেই একই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন- “বীরবল তুমি এটা কি করছ?”

এটা শুনে বীরবল, তার সাথে থাকা একজন রাজকর্মচারীকে নির্দেশ দিলেন বাদশাহের নামও সেখানে লিখে নিতে। এটি শুনে বাদশাহ, সেই কর্মচারীটির হাত থামিয়ে দিয়ে সেই কাগজটি নিয়ে নিলেন। সম্রাট দেখলেন, সেই কাগজটির হেডিং-এ লিখা আছে- ‘অন্ধ লোকেদের নামের তালিকা’

এরপর সম্রাট আকবর আগ্রহ বশত জিজ্ঞাসা করলেন- “এই লিস্টে আমার নাম কেন লিখতে বললে?” এরপর বীরবল বললেন- “সম্রাট, আপনি দেখলেন যে, আমি জাল বুনছি, কিন্তু তবুও আপনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন যে আমি কি করছি?”

বীরবলের গল্প। বীরবলের হাসির গল্প
বীরবলের গল্প। বীরবলের হাসির গল্প

এরপর বাদশাহ অপর কর্মচারীর হাত থেকে আরেকটি কাগজ নিলেন, দেখলেন সেখানে হেডিং লিখা আছে- “দৃষ্টিশক্তি যুক্ত লোকেদের নামের তালিকা।“ কিন্তু সেখানে একজন ব্যক্তিরও নাম নেই।

এরপর বীরবল বললেন- “সম্রাট, এবার তো আপনি বিশ্বাস করবেন যে, পৃথিবীতে অন্ধ মানুষের সংখ্যাই বেশি!”

আরও পড়ুনঃ- পঞ্চতন্ত্রের গল্প। জ্ঞানের গল্প

বীরবলের হাসির গল্প ০২ঃ-

সম্রাট আকবরের দরবারে প্রতিদিনের মত সেদিনও নানান সমস্যা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। সবাই নিজের নিজের মত প্রকাশ করছিল, কিন্তু সম্রাট কিছুতেই বুঝতে পারছিলেন না যে তিনি কার মতকে প্রাধান্য দিবেন। তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন- “পৃথিবীর সব মানুষের পৃথক পৃথক মতামত, কিন্তু পৃথিবীর সব মানুষ একই রকম চিন্তা করে না কেন?”

এটা শুনে বীরবল নিচু গলায় বললেন- “সর্বদা এরকম হয়না সম্রাট, কিছু কিছু সমস্যা এমনও আছে যেখানে সবাই একই-রকম চিন্তা করে।“ বীরবলের কথা শুনে সবাই হেঁসে উঠলেন। এর কিছুক্ষণ পড় সেদিনের মত, সভা মুলতুবী হয়ে যায়।

সেদিন বিকেলে, বীরবল দেখলেন সম্রাট তার বাগানে দাঁড়িয়ে আছেন। বীরবল তার কাছে যেতেই, তিনি আবার বীরবলের বলা কথা নিয়ে হাসাহাসি করতে লাগলেন। এরপর বীরবল বললেন- “সম্রাট, ওই যে ওই কোণায় একটি কুয়ো আছে, চলুন ওই কোণায়, আমি আমার বলা কথার উপড়ে যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করব। আমার কথা হল- কোনো কোনো ক্ষেত্রে পৃথিবীর সব মানুষ একই রকম চিন্তা করে।“

এরপর বীরবল সম্রাটকে ভালো মত কুয়োটি দেখতে বললেন। কুয়োর চারপাশে ভালো মত দেখার পড়, বাদশাহ বললেন- “আমি কিছুই বুঝলাম না।“ বাদশাহ জানেন যে, বীরবল এভাবেই সব কিছু বোঝানোর চেষ্টা করে।

বীরবল- “সব কিছুই বুঝে যাবেন হুজুর। আপনাকে শুধু ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে ঘোষণা করতে হবে যে, আগামী পূর্ণিমায়, আপনার নগরের সব ব্যক্তিই যেন এক লোটা দুধ এই শূন্য কুয়োতে ফেলে দিয়ে যায়। আপনার এই সুবিশাল নগরীর লোক যদি এই কুয়োতে দুধ ফেলে দিয়ে যায়, তাহলে আপনার এই কুয়ো একদিনেই দুধে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে।“ বীরবলের কথা শুনে সম্রাট আবারও হাসিতে লুটে পড়লেন।

বীরবলের কথা মত, পড়ের দিন সমগ্র নগরে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে দেওয়া হল। সঙ্গে এটাও বলা হল যে, “ যদি কোনো ব্যক্তি দুধ ঢালতে না আসেন, তাহলে তাকে সাঁজা দেওয়া হবে।“

পূর্ণিমার দিন, রাজদরবারের সেই কুয়োটিতে মানুষের প্রচণ্ড ভিড় জমে গেল। সবাই কুয়োতে দুধ ঢালার জন্য লাইন লাগিয়ে দিল। দেখতে দেখতে সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসল। প্রায় সমস্ত মানুষই কুয়োতে দুধ ঢেলে চলে গেল। কুয়ো তখন প্রায় কানায় কানায় পরিপূর্ণ।

কিছুক্ষণ পড় সবাই চলে গেলে, বীরবল সম্রাটকে ডেকে দিয়ে এসে কুয়োটি দেখতে বললেন। কুয়োটি দেখে সম্রাট আশ্চর্য হয়ে গেলেন কারণ কুয়োতে একফোঁটাও দুধ নেই, বরং জলে পরিপূর্ণ। এরপর সম্রাট বললেন- “সবাইকে দুধ আনতে বলা হয়েছিল, কিন্তু সবাই জল এনেছে কেন? আমি তো কিছুই বুঝছি না!”

“জাহাঁপনা আমি তো এটাই প্রমান করতে চাইছিলাম যে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে পৃথিবীর বেশীরভাগ মানুষ একই রকম চিন্তা করে। এটা তারই প্রমান। সবাই ভাবছিল, নগরে দুধের অনেক দাম ফালতু ফালতু কুয়োতে দুধ ফেলে নষ্ট না করাই ভালো। তাই তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে, সবাই তো কুয়োতে দুধই ঢালবে, কিন্তু সে যদি এক লোটা দুধের জায়গায় এক লোটা জল ঢেলে দেয়, তাহলে কেউই কিছু বুঝতে পাড়বে না। কারণ এত্ত এত্ত দুধের মধ্যে তার এক লোটা জল কিছুই নয়!”

আকবর আর বীরবলের গল্প। বীরবলের মজার গল্প
আকবর আর বীরবলের গল্প। বীরবলের মজার গল্প

“এই কথা নগরের সবাই চিন্তা করেছিল, তাই সবাই দুধের বদলে জল নিয়ে এসেছে, এটা ভেবে যে, প্রচুর পরিমাণ দুধের মধ্যে তার এক লোটা জল ফেললে কেউই কিছু বুঝতে পারবেনা। আর সবার এই ভাবনার জন্যই যেই কুয়োটি দুধে ভর্তি হওয়ার কথা ছিল, সেটি জলে পরিপূর্ণ।“

এভাবেই বীরবল প্রমান করে দিলেন যে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পৃথিবীর বেশীরভাগ মানুষ একই রকম চিন্তা করে।   

পড়ুনঃ- আকবর বীরবল এর কাহিনী 

বীরবলের হাসির গল্প ০৩ঃ-

সম্রাটের রাজধানীর কাছেই সুখচাদ নামে এক বণিক বাস করত। সকালে ঘুম থেকে উঠে যে প্রথমে এই বণিকের মুখ দর্শন করত, তার নাকি সারাদিন আর অন্ন জুটত না। এমনটাই প্রবাদ প্রচলিত ছিল। কথাটা সম্রাটের কানে এল।

সম্রাট ভাবলেন, আজব কথা তো। বিষয়টা পরীক্ষা করে দেখবেন বলে ঠিক করলেন। তাই একদিন ধরে এনে প্রাসাদে বন্দী করে রাখা হলো সেই বণিকটিকে। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে সম্রাট প্রথমেই সুখচাঁদকেই দেখলেন। তারপর তাকে মুক্ত করার আদেশ দিয়ে মনে মনে ভাবতে লাগলেন, দেখা যাক আজ কি হয়।

যথারীতি প্রাতঃকৃত্য শেষে সম্রাট খেতে যাবেন। এমন সময় বাঁদী এসে খবর দিল বেগমের ভয়ানক মাথা ধরেছে। সম্রাটকে অতিশীঘ্র যেতে হবে। খাওয়া দাওয়া ফেলে ছুটলেন সম্রাট। বদ্যি ডেকে আনা হল কিছুক্ষণ পর বেগম সুস্থ হয়ে উঠলেন।

ওদিকে সম্রাটের সকালের খাবার সব ঠান্ডা হয়ে গেছে। ফলে আবার তা গরম করার ব্যবস্থা করতে হলো। কিন্তু খাওয়ার নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাবার অনেক পরেও না খাওয়ার জন্য সম্রাটের পেটে ব্যাথা শুরু হলো। ব্যাথা তো ব্যাথা, সম্রাটের অবস্থা একেবারে কাহিল। আবার বদ্যি এলেন। সম্রাটকে পরীক্ষা করে বললেন, “আজ আর কিছু না খাওয়াই সম্রাটের জন্যে ভাল হবে।“

ব্যাথায় অস্থির সম্রাট বললেন, “সে কি বদ্যি, সকালেও তো কিছু খাইনি।“ বদ্যি বললেন, “তবুও আজ না খাওয়াই ভাল। কিন্তু সকালে খাননি কেন? তাহলে তো ওষুধ দিতে হবে” বলে সম্রাটকে ওষুধ খাইয়ে দিলেন বদ্যি। খানিক পরে ব্যাথা কমে গেল। ব্যাথা কমতেই সম্রাটের মনে পড়ল সুখচাঁদের কথা। মেজাজ তাঁর গরম হয়ে গেল। ঘুম থেকে উঠে ওই নচ্ছার বণিকের মুখ দেখেছিলেন বলেই সকালে তো খেতে পারেনইনি, উপরন্ত সারাদিনের খাওয়া বরবাদ হতে চলছে। এমন অলক্ষণের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। তৎক্ষণাৎ তিনি সুখচাঁদকে ধরে এনে ফাঁসিতে লটকে দেবার নির্দেশ দিলেন।

নির্দেশ মত পেয়াদা গিয়ে হাজির সুখচাঁদের বাড়িতে। সম্রাটের নির্দেশ জানাতেই রীতিমত ভড়কে গেল সে। পেয়াদা তাকে আগাগোড়া সব কথা জানিয়ে বলল- তাই তার এই শাস্তি। সুখচাঁদের শত কাকুতি মিনতি সত্ত্বেও পেয়াদা তাকে ধরে নিয়ে চলল। পথে বীরবল এ দৃশ্য দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলেন। সুখচাঁদ বীরবলের পা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমাকে বাঁচান। আমার বউ ছেলেমেয়ের সর্বনাশ হয়ে যাবে।’

বীরবল বণিককে অভয় দিলেন, প্রহরীদের কাছ থেকে তাকে একটু আড়ালে নিয়ে, কিছু কথা বলে আবার প্রহরীদের কাছে ছেড়ে দিলেন। পেয়াদারা বণিককে ধরে সোজা ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে এল। জল্লাদ এসে উপস্থিত হলো। ফাঁসির পূর্বে মূহুর্তে মানিক চাঁদকে জিজ্ঞেস করা হলো যে মৃত্যুর আগে তার কোনো বিশেষ ইচ্ছা আছে কি না। তার যে কোনো ইচ্ছা পূরণ করা হবে।

সুখচাঁদ বলল, ‘মহামান্য সম্রাট ভারতেশ্বর আকবর কে একবার দেখতে চাই। এটাই আমার শেষ ইচ্ছে।’

পেয়েদা-আমত্যরা রাজি হলো না। তারা বলল- “সম্রাটের মেজাজ বিগড়ে আছে। একথা বললে তিনি হয়তো আরো রেগে যাবেন।“  কিন্তু সুখচাঁদের ওই একই কথা। শেষে খবর দেয়া হল সম্রাটকে। এলেন তিনি। সুখচাঁদকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি ব্যাপার? মৃত্যুর আগে আমার দেখার ইচ্ছা কেন?’

বীরবলের মজার গল্প। BANGLA NEW FUNNY AKBAR O BIRBAL ER KAHINI
বীরবলের মজার গল্প। BANGLA NEW FUNNY AKBAR O BIRBAL ER KAHINI image
<

সুখচাঁদ করজোড়ে বলল, ‘মহামান্য সম্রাট বাহাদুর, এটা কি সত্যি যে ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই আমার মুখ দর্শনের কারণে সারাদিন কিছু খেতে পারেননি? আর তাই আমাকে ফাঁসিতে ঝোলাতে নির্দেশ দিয়েছেন?’

সম্রাট বললেন, ‘শুধু কি আমি-যারাই সকালে প্রথমে তোমার মুখ দর্শন করে তারাই সারাদিন উপোস করে মরে। তোমার মত এরকম অলক্ষুণে, অপয়া লোককে আমরা রাজ্যে বাঁচিয়ে রাখতে পারি না।’

সুখচাঁদ বলল, ‘আজ্ঞে জাঁহাপনা, আমি আজ প্রথমেই আপনার মুখ দর্শন করেছি। আর সেজন্যেই মরতে বসেছি। সকালে ঘুম থেকে উঠে আপনার মুখ দেখে যদি ফাঁসিতে ঝুলে মরতে হয়, সেটা কেমন হচ্ছে?’

একথা শুনে সম্রাট একটু চিন্তিত হয়ে বললেন, ‘তোমার কথাটা একদিক থেকে ভুল নয়। ঠিক আছে যাও, তোমার মৃত্যুদন্ড রদ করে দিলাম। কিন্তু তোমার ঘটে এই বুদ্ধি এল কি করে?’

সুখচাঁদ বলল, “আজ্ঞে জাঁহাপনা, বীরবল মহাশয়ের বুদ্ধি পেয়েছিলাম।”

মুচকি হেসে চলে গেলেন সম্রাট।

For Facebook Updates:- গল্প আর গল্প

“বীরবলের গল্প। বীরবলের হাসির গল্প। বীরবলের কাহিনী। আকবর আর বীরবলের গল্প। বীরবলের মজার গল্প”

Spread the love

Leave a Reply