আজকের ব্লগটিতে আমরা পৃথিবীর সবথেকে বিষাক্ত প্রাণী বা পৃথিবীর সবথেকে ক্ষতিকারক প্রাণী গুলি নিয়ে আলোচনা করব। আশা করছি, আপনারা এই ব্লগটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়বেন। এদের মধ্যে কিছু প্রাণী আপনার আশেপাশেও রয়েছে, অথচ আপনি জানেন না যে তাদের থেকে কি ধরনের বিপদ আসতে পারে। তাই সচেতন থাকুন, সুরক্ষিত থাকুন।
আমাদের এই পৃথিবীতে অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীর বসবাস, এদের মধ্যে আমরা খুবই কম সংখ্যক প্রাণীর সম্পর্কে জানতে পেরেছি। আবার এদের মধ্যে কিছু প্রাণী রয়েছে, যারা আমাদের উপকারী, আবার অনেকপ্রাণী রয়েছে, যারা আমাদের জীবন পর্যন্ত কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
আফ্রিকান Tsetse Fly (বিষাক্ত প্রাণী)
আমাদের আশেপাশে অনেক মাছিই আমরা দেখি। কিন্তু আপনি কি জানেন, এদের এমন একটি প্রজাতি রয়েছে, যেটি মানুষের জীবন পর্যন্ত কেড়ে নিতে পারে। আফ্রিকার সাহারার ৩৫ টি অঞ্চলে এই মাছির উপদ্রব একসময় অত্যন্ত বেশি ছিল। আমাদের বাড়িতে যে সমস্ত মাছি আমাদের চোখে পড়ে, এগুলি সেগুলির থেকে দেখতে একটু আলাদা। এই মাছি শরীরে বসে সরাসরি রক্ত শুষে নিতে শুরু করে, এই পরজীবী মাছিটি, নিদ্রা রোগের বাহক। এই রোগের সাথে সাথে আক্রান্তের মাথা ব্যাথা, জ্বর, জয়েন্ট পেন ইত্যাদির মত উপসর্গ দেখা যায়। একসময় এই মাছির কারণে শুধুমাত্র আফ্রিকাতেই গড়ে প্রায় ১০,০০০ জন মানুষের মৃত্যু হত। কিন্তু বর্তমানে অনেক ব্যাবস্থা নেওয়ার ফলে, এই মাছির উপদ্রব অনেকটাই কমানো সম্ভব হয়েছে।
পরিষ্কার জলের শামুক
আমাদের আশেপাশের পরিষ্কার জলে কিছু শামুক বাস করে, যারা একধরনের পরজীবী বহন করে থাকে। এদের দ্বারা মানুষের যে রোগটি সৃষ্টি হয় সেটি হল- schistosomiasis. বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা WHO এর মতে প্রতি বছর প্রায় লক্ষাধিক মানুষ এর শিকার হয়ে থাকেন। এবং সমগ্র বিশ্বে প্রায় প্রতি বছর ২০,০০০ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। শামুক বাহিত এই রোগটির মূল উপসর্গ হল- প্রচণ্ড পেটে ব্যাথা এবং মল ও প্রস্রাবের সাথে রক্ত ক্ষরণ। তাই জলে নামার আগে একটু সচেতন হয়ে থাকুন। খেয়াল রাখবেন আপনার শরীর যেন কোনো ভাবেই এদের সংস্পর্শে না আসে।
এশিয়ান ছারপোকা/ KISSING BUG (বিষাক্ত প্রাণী)
এশিয়ান ছারপোকা যে রোগটির বাহক সেটি হল- Chagas disease. বিশেষত শহরাঞ্চলে এই পোকার উপদ্রব বেশি দেখা যায়। প্রতি বছর সারাবিশ্বে প্রায় ৬-৭ মিলিয়ন মানুষ এর কামড়ের শিকার হন। সারা পৃথিবীতে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১০,০০০ জন মানুষ এই Chagas রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাত্র ৩০% আক্রান্ত মানুষের ক্ষেত্রে উপসর্গ দেখা যায়। বাকি ৭০% মানুষ কোনো উপসর্গ ছাড়াই স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকে মারা যান।
গোল কৃমি (ROUND WORM)
এই পরজীবীটির বাস আমাদের শরীরেই। এদের বিভিন্ন প্রজাতি রয়েছে, এদের সবথেকে বড় প্রজাতিটির নাম হল- Ascaris Lumbricodies. এটি অ্যাসকারিয়াসিস নামক এক রোগের সৃষ্টি কারক। এটি পৃথিবীতে যে সমস্ত পরজীবী বাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে সর্বাধিক মানুষের মৃত্যু হয়ে থাকে, তাদের মধ্যে এটি অন্যতম। কেবলমাত্র এর কারণেই প্রতি বছর পৃথিবীতে গড়ে প্রায় ৬০,০০০ জন মানুষ প্রাণ হারান। এবং গড়ে প্রায় ৮০০ মিলিয়ন থেকে ১.২ বিলিয়ন মানুষ প্রতি বছর এই রোগে আক্রান্ত হন। তবে অন্যান্য রোগের মত, এটি তাৎক্ষণিক বিপদ ডেকে আনে না। এটি ধীরে ধীরে সংক্রামিত হয়। এর প্রাথমিক উপসর্গই হল শরীর শুঁকিয়ে যাওয়া। উল্লেখ্য যে, প্রাথমিক অবস্থায় মাত্র গড়ে প্রায় ১৫% মানুষই বুঝতে পারেন, যে তারা এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন।
BOX JELLYFISH (বিষাক্ত প্রাণী)
সমুদ্রের সবথেকে বিষাক্ত প্রাণী হল বক্স জেলি ফিস। মূলত অস্ট্রেলিয়ার উপকূলে এদের পাওয়া যায়। এদের পেছনের শুর গুলিই মূলত বিষে ভরা থাকে। এদের শুঁড়ের সংস্পর্শে যদি কারো কোনো অঙ্গ লেগে যায়, অথবা সামান্য একটি touch হয়, তাহলেই এর বিষক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। একজন মানুষ যদি পুরোপুরি এর সংস্পর্শে চলে আসেন, তাহলে তার বাঁচার প্রায় কোনো সম্ভাবনা নেই। আক্রান্ত তৎক্ষণাৎ প্যারালাইসিস হয়ে যেতে পারেন, অথবা হার্ট অ্যাটাক হতে পারে নতুবা সাথে সাথে প্রব বিষক্রিয়ায় মারা যেতে পারে। অন্যান্য জেলি ফিসের তুলনায় এই বক্স জেলিফিশ খুবই ভয়ানক রকমের হয়ে থাকে। এবং একটি পূর্ণবয়স্ক জেলিফিশ তার শুর ১০ ফুট পর্যন্ত দূরত্বে ছড়িয়ে দিতে পারে। যেসমস্ত জায়গায় এগুলির বাস রয়েছে, সেখানে উপকূলে caution board লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুনঃ-
পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত প্রাণী পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণী
বিষাক্ত সোনালি ব্যাঙ (Golden Poison Dart Frog)
কি হবে যদি আপনি একটি সুন্দর সোনালি রঙের ব্যাঙকে গাছে বসে থাকতে দেখেন? এর সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবে আমি নিশ্চিত। আপনি হয়ত তার কাছে, গিয়ে তার ফটো তুলবেন, বা তাকে ধরার চেষ্টা করবেন। কিন্তু আপনার অজান্তেই এখানে ঘটে যেতে পারে, একটি বড় বিপদ। হ্যাঁ আমরা কথা বলছি Golden Poison Dart Frog নিয়ে।
এটি দেখতে যতটাই না সুন্দর ঠিক ততটাই প্রাণঘাতী বিষ লুকিয়ে আছে এর চামড়ার মধ্যে। ব্যাঙের এই প্রজাতিটি সর্বাধিক প্রায় ২.৩ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। এর চামড়ায় রয়েছে বিষাক্ত batrachotoxin নামের এক বিষ। এর এর সংস্পর্শে এলেই হয়ে যেতে পারে, প্যারালাইসিস বা তৎক্ষণাৎ মৃত্যু। এরা মূলত কলম্বোতে বসবাস করে থাকে। তবে অন্যান্য জায়গাতেও এদের দেখা গেছে। এরা গাছেই বেশি থাকতে পছন্দ করে। কিন্তু কিছু অসাধু মানুষ এদের হত্যা করে, এদের বিষকে সংগ্রহ করে শিকার করার কাজে ব্যবহার করছে।
Sydney Funnel Web Spider (বিষাক্ত প্রাণী)
সমস্ত শরীর বিষে ভরপুর। শরীরের প্রায় এমন কোনো স্থান নেই যেখানে বিষ নেই। এই বিশেষ প্রাণঘাতী মাকড়শাটির বসবাস অস্ট্রেলিয়াতে। তবে প্রায় প্রত্যেক দেশেই এদের দেখা মেলে। তবে সংখ্যায় নগণ্য। এদের সংস্পর্শে আসার ১৫ মিনিটের মধ্যে স্নায়ুতন্ত্র তার কাজ করা বন্ধ করে দেয়। যার ফলে আক্রান্তের মৃত্যু ঘটে। এদের মধ্যে ছেলে মাকড়শারা বেশি বিষাক্ত হয়ে থাকে। এরা দলবদ্ধ ভাবে উপনিবেশ তৈরি করে বসবাস করতে ভালোবাসে। ১৯৮০ সালে এর anti-venom আবিষ্কার হয়। কিন্তু আক্রান্তকে দ্রুত চিকিৎসার বন্দোবস্ত না করলে আক্রান্তের প্রাণ চলে যেতে পারে। এত ছোট একটি জীব, মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়। ভাবা যায়!
STONE FISH (বিষাক্ত প্রাণী)
উপরের ছবিটিতে একটি মাছের ছবি আছে। বুঝতে পাড়ছেন? এখন পর্যন্ত মানুষের আবিষ্কৃত সবথেকে বিষাক্ত মাছের প্রজাতি হল স্টোনফিশ। এরা মূলত ছন্দবেশধারী মাছ। এরা অনায়াসেই সমুদ্রের পাথরের রঙের সাথে মিশে যেতে পারে। এভাবেই এরা শিকার ধরে। অনেক ডুবুরিই এদের আক্রমণের শিকার হয়েছেন। এদের কামড়ে রয়েছে প্রচণ্ড বিষ। তাই দ্রুত আক্রান্তকে অ্যান্টি-ভেনম দেওয়ার ব্যাবস্থা করতে হয়।
শঙ্কু আকৃতির শামুক (CONE SNAIL)
আমাদের অনেকেরই বাড়িতে শামুক বা ঝিনুকের তৈরি অনেক কিছুই আছে। আবার অনেকেই এগুলি দিয়ে তৈরি গয়নাও ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু এই শামুকগুলির মধ্যে শঙ্কু আকৃতির শামুকগুলি অনেক বিষাক্ত হয়ে থাকে। এরা সাধারণত ১০-১৫ সেন্টিমিটার লম্বা হয়ে থাকে, এবং এরা দেখতে অনেকটা শান্ত এবং নিরীহ প্রকৃতির। কিন্তু এই নিরীহতার পেছেন লুকিয়ে রয়েছে, ভয়ংকর প্রাণবিনাশক বিষ। এদের মাত্র একফোঁটা বিষ প্রায় ২০ জন মানুষকে মারার ক্ষমতা রাখে। আপনার যদি সমুদ্রে গিয়ে শামুক কুড়ানোর শক থাকে, তাহলে এদের থেকে একটু সাবধান। আপনাকে এদের খোলসে ধরতে হবে। নতুবা আপনি যদি আপনার তালুর উপড়ে এদের রাখেন, এরা কখন আপনার তালুতে তাদের বিষ দাঁত বসিয়ে দেবে কিছুই বুঝতে পাড়বেন না। তবে উপকূলের ধারে যেসমস্ত শামুকেরা পড়ে থাকে, তাদের অধিকাংশই মৃত হয়ে থাকে।.
ভারত এবং প্রশান্ত মহাসাগরে এদের বেশি দেখা যায়। এটিকে “cigarette snail” ও বলা হয়ে থাকে। কারণ এটি কোনো ব্যাক্তিকে কামড়ানোর পড়, মাত্র একটি সিগারেট খাওয়ার মত সময় তার হাতে থাকবে। এরমধ্যেই কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করলে সে প্রানে বেঁচে যেতে পারে, নতুবা তাকে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হবে।
LORIS (ভয়ংকর প্রাণী)
এই যে উপরের ছবিতে যে প্রাণীটি দেখছেন, এর নাম Loris. এটিকে দেখে আপনার হৃদয়ে মায়া জেগে উঠবে। এর চোখ গুলির দিকে লক্ষ্য করুন, যেন মনে হচ্ছে এরা খুবই নিরীহ। এটিকে দেখতে অনেক cute. কিন্তু আপনি কি জানেন, এটিকে পৃথিবীর সবথেকে বিষাক্ত স্তন্যপ্রায়ী প্রাণীদের মধ্যে ধরা হয়ে থাকে। এটি যখনই আপনাকে কামড় বসাবে, তখনই আপনার কারেন্টের মত শক লাগবে। বিজ্ঞানীদের মতে, কোবরা এবং এদের বিষ প্রায় সমান সমান। তাই কোথাও একে দেখলে, কাছে গিয়ে আদর করতে যাবেন না। একটু দূরত্ব বজায় রাখুন, এতেই আপনার মঙ্গল। হুম তবে বলে রাখি যে, এরা অনেক শান্ত হয়ে থাকে। এদের বিরক্ত না করলে এরা আক্রমণ করে না।
লেখাটি অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে, তাই এখানেই শেষ করছি, আপনারা এটি পছন্দ করলে শীঘ্রই এর দ্বিতীয় খণ্ড নিয়ে আসব। আর হ্যাঁ আপনারা চাইলে আমাদের ফেসবুক গ্রুপে জয়েন হতে পারেন। সেখানে প্রতিদিন নতুন নতুন অজানা ফ্যাক্ট পোষ্ট করা হয়ে থাকে।
কি কেন কীভাবের উপর গড়ে ওঠা মানুষের জিজ্ঞাসু মন সর্বদাই নতুন দিগন্তের সন্ধানে পা বাড়ায় ৷ প্রতিটি পদক্ষেপেই নতুন কিছু অভিজ্ঞতা আমাদের ঝুলিতে জমা হয় ৷ সেই অভিজ্ঞতা সকলের সাথে ভাগ করে নেওয়ার মধ্যে এক অফুরন্ত আনন্দ লুকিয়ে থাকে ৷ আর সেই কাজেই হাত বাড়িয়েছে ছাড়পত্রের টিম।
ধন্যবাদ।।