আজকের বাংলা বড় গল্প টির শিরোনাম- “সংসার”। বিবাহের পর সম্পূর্ণ এক নতুন পরিবেশে নারীর আগমন ঘটে। সেই পরিবেশে মানিয়ে নিতে সবার চাওয়া পাওয়া পূর্ণ করতে নারীকে হয়ে উঠতে হয় এক আস্ত রোবট, যার কন্ট্রোলার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের হাঁতে!
বাংলা বড় গল্প- নারীর সংসার জীবনের গল্পঃ-
রূপা যেদিন প্রথম বিয়ে করে আসে অভির বাড়ি, সেদিন তার মনে কোনো স্বপ্নও ছিল না বা কোনো আক্ষেপও ছিল না। কারণ ছোট থেকেই সে একটা কথা শুনে এসেছে, “আমরা যা বলব তাই শুনবি!” তাই রূপাকে কেউ কোনো স্বপ্ন দেখতে বা আক্ষেপ করতে বলেনি বলেই তার মনের মধ্যে এইদুটোর কোনোটাই নেই। রূপা ভাবছে নতুন জায়গায় এসে, নতুন পরিবেশে এসে, নতুন মানুষদের মাঝে নিজেকে মানিয়ে গুছিয়ে নিতে পারবে তো? তার এখন চিন্তা আটপৌরে বৌদের মতো, যারা সংসার ছাড়া আর কিছুই বোঝে না, সংসারই যার কাছে পৃথিবী।
অথচ কিছু বছর আগেও মনে পড়ে মাধ্যমিকে ৯২% নম্বর আর উচ্চমাধ্যমিকে ৯৮% নম্বর পাওয়া রূপা স্বপ্ন দেখত সে কলেজে বাংলায় অনার্স পড়ে একজন বড় অধ্যাপিকা হবে। ছাত্রছাত্রীদের পড়াবে, নিজের মনের মতো করে স্বাধীনচেতা হিসেবে গড়ে তুলবে। স্বপ্ন শুধু দেখতে নয়, স্বপ্ন পূরণ কিভাবে করতে হয়, সেই পথের পথিক হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করবে সকলকে। কিন্তু আজ সেই রূপা নিজেই উচ্চমাধ্যমিক এর গন্ডী পর্যন্ত থাকা একজন কমবয়সী অথচ বেশি বয়সী মহিলাদের মতো আটপৌরে গৃহিণী। তার মনে চিন্তা, সংসারটা কিভাবে সে দেখবে?
প্রায় সারাদিনটাই শাশুড়ির ফরমাশ আর রান্নাঘরেই কেটে যায় রূপার। রান্না করতে গিয়ে হাত পুড়ে গেলে সবাই হা হা করে কিন্তু মনটা যে অনেক আগে থেকেই পুড়ে ছাই হয়ে পড়ে আছে সেইদিকে কারোর নজর নেই। অবশ্য এখন রান্না করতে গিয়ে হাত পুড়ে গেলেও কেউ দেখে না!
খুব প্রানোচ্ছ্বল, হাসি, খুশি ছিল রূপা । একটা প্রাণবন্ত মেয়ে ছিল সে, সব বান্ধবীদের সে বড় মুখ করে বলত, নিজের পায়ে সব মেয়েদের দাঁড়ানো উচিত, নয়ত সারাজীবন অন্যের ইশারায় বাঁচতে হবে, এমনকি মরতেও হবে। আমরা সবাই চাকরি করব। সৎপথে কিছু তো একটা করতেই হবে।
অথচ আজ রূপা..!
কথা কম বলতে বলতে এখন প্রায় চুপচাপ হয়েই থাকে। একদিন একটু জোরে হাসতে গিয়ে শুনেছিল, “বৌ মানুষের অত জোরে অলক্ষ্মীদের মতো হাসতে নেই, সংসারে অমঙ্গল হয়।” যেখানে হাসিটাই অমঙ্গলের, সেখানে হাসি আসা শোভা পায় না।
অভি অবশ্য মাঝে মাঝে বুঝতে পারে না যে সে কোনো মেয়ের সাথে নাকি কোনো রোবটের সাথে সংসার করছে! রূপার কোনো কাজে কখনো ভুলই হয়না যে অভি তার উপর ধমকাবে। আবার উল্টোদিকে রূপাও কোনো প্রতিবাদ করে না কিছুর প্রতিই, কোনো অভিযোগ নেই, অসুবিধা নেই, চুপচাপ সবসময়, কোনো ইচ্ছা- আকাঙ্খা , আবদার, আহ্লাদ, কোনো অনুভুতি কিছুই যেন নেই মেয়েটার মধ্যে!
এটা কি কোনো মানুষ! অভি খুব রেগে যায় মাঝে মাঝে এইজন্য কিন্তু তাতেও রূপার কোনো বিকার নেই। হাসেও না কখনো, কীরকম যেন একটা অদ্ভুত মেয়ে। অভি যখন ক্লান্ত হয়ে রাতে ফিরে এসে খাওয়া দাওয়া করে রূপার সাথে মিশে যেতে চায়, রূপা তখনও নির্বিকার, তাই প্রতিরাতে এসেই সে অভির কাছে এসে বলে, “আজ রাতে কি আমাকে তোমার দরকার আছে? যদি থাকে তো বলো আর না থাকলে আমি একটু পরে ঘুমোবো।”
অভি প্রথম প্রথম কামোত্তেজিত হয়ে রূপার চোখ দুটো খেয়াল করেনি কখনো, খেয়াল করেনি রূপার বলা কথাগুলোর মর্মার্থ । শুধু সে খেয়াল রেখেছিল আজ রূপার সাথে কতক্ষণ একাত্ম হতে পারা যাবে! রূপার যৌবনে কতটা অগ্নিবর্ষণ করছে!
কিন্তু এখন অভি মাঝে মাঝে বুঝতে পারে রূপার কথার মধ্যে অনেক না বলা যন্ত্রণা থাকে যেটা সে কাউকে বোঝাতে চেয়ে যখন ব্যর্থ হয়েছে তখন ছেড়ে দিয়েছে সেই ব্যর্থ চেষ্টা। যেন কেউ না বুঝলেও রূপার কোনো দুঃখ নেই ।
সকালবেলা। অভি অফিস বেরোবে। রূপা সঙ্গে সঙ্গে খাবার বেড়ে নিয়ে চলে আসে আর বলে, “সব গুছিয়ে মনে করে নিয়েছ তো, আজ তো তোমার একটা ভাইটাল মিটিং আছে।”
অভি কথাটাকে না শুনে অন্য একটা কথা বলে, “আচ্ছা রূপা, তোমার কি হয়েছে বলোতো?”
“কি আবার হবে , কিছু হয়নি তো।” বলে রূপা।
পড়ুন- নতুন শিক্ষণীয় গল্প
“না না তোমার কিছু একটা হয়েছে। এতটা বলেই ফোন আসে অফিস থেকে আর বলা হয় না অভির অসম্পূর্ণ কথাটা। তাড়াতাড়ি খেয়ে বেরিয়ে পড়তে হয়। রূপা সমস্ত এঁটোকাটা পরিষ্কার করে। শ্বশুর, শাশুড়ি কে খেতে দেয় আর নিজে? নিজে খায় না আর। ভালো লাগে না আর খেতে, খাওয়ার প্রতি খুব অরুচি চলে এসেছে তার। যার জীবনের প্রতিই অরুচি এসে গেছে তার খাবারের প্রতি অরুচি আসা তো অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটা ব্যাপার !
সারাদিন নিত্যনৈমিত্তিক কাজের শেষে দুপুরে অল্প খেয়ে একটু বিশ্রাম নেবে রুপা এমন সময় মা ফোন করে।
“হ্যালো রূপা মা, কেমন আছিস মা।” বলে ওঠে রূপার মা।
“ভালো আছি মা, তুমি, বাবা, ভাই কেমন আছে, পড়াশোনা কেমন চলছে ওর? ”
“এই আছি, তোর ভাইয়ের তো সেকেন্ড সেমিস্টার পরীক্ষা কলেজের। অনেক চাপ ওর। আচ্ছা ভিডিও কল কর তো তুই, অনেক দিন তোকে দেখি না ।”
রূপা ভিডিও কল করে। রূপাকে খুব অন্যরকম লাগছে। হয়ত অনেক দিন পরে দেখছে বলেই। কিন্তু এতটা অন্যরকম!
মা জিজ্ঞাসা করে শরীর ঠিক আছে কি না!
রূপা সবেতেই ‘হ্যাঁ’ বলে।
শেষে মা খুব আক্ষেপের সূরে বলে, “খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগে জানিস এখন বাড়িটা! তুই যখন ছিলিস তখন বোঝাই যেত না যে তুই না থাকলে এতটা খা খা করবে বাড়িটা।”
রূপা স্মিত হাসে হাসির কথা নয় জেনেও। সে বলে, মা মনে পড়ে, তুমি আগে আমার উপর খুব রেগে যেতে আর বলতে মেয়ে হয়েছিস পরের ঘরে তো চলে যাবি একদিন, সংসারই হবে তোর জগৎ, স্বামীই তোর সব হবে। শ্বশুর শাশুড়ির প্রতি নজর দিবি। তোকে অত আদর যত্নে রেখে কি হবে, তুই তো আমাদের দেখবি না! তোর ভাইই তো আমাদের দেখবে বড় হলে। তখন আমি বলতাম, না মা আমি তোমাকে, বাবাকে, ভাইকে সবাইকে দেখব। কিন্তু দেখো মা, অবশেষে তোমার কথাটাই কিন্তু সত্যি হলো। সত্যি সত্যি পরের বাড়ি এলাম ।
সংসার ছাড়া আর আজ সত্যিই কিছু বুঝি না। স্বামীই সব। শ্বশুর শাশুড়ির খেয়ালও রাখি, যত্ন নিই। আর তোমাদের আর আমার দেখা হলো না, যত্ন আত্তি,দায়িত্ব কিছুই নেওয়া হলো না। সবটাই এখন ভাইয়ের হাতে। তবে কি জানো মা, ছেলেরা নিজেদের মা , বাবা কে দেখবে বলে তারা তার মা বাবার কাছে যেই ভালোবাসা, গুরুত্ব, আদর যত্ন পায়, সেই একই কাজ কোনো মেয়ে নিজের মা বাবার জন্য না করতে পারলেও, খেয়াল করে দেখো ঐ এক দায়িত্বটাই কিন্তু পালন করছে অন্য কোনো একটা বাড়িতে ।
পড়ুন- মা নিয়ে একটি হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া গল্প
কিন্তু মেয়েরা সেখানে মোটেও কোনো ভালোবাসা পায় না। কারণ মেয়েদের সত্যি বলতে আপন বলে কেউ নেই। বাপের বাড়িতে শোনে, “তুই পরের ঘরে চলে যাবি!” আর শ্বশুরবাড়ি বলে, “তুমি পরের বাড়ি থেকে এসেছ!” আসলে মেয়েদের নিজেদের জন্য কিছু নেই মা। শাশুড়ি মায়ের সব কাজ করে দিলে, তার সেবা করলে তিনি খুশি। শ্বশুর মশাইয়ের ক্ষেত্রেও একই। স্বামীর কথা চুপ করে শুনে গেলে, কোনো প্রতিবাদ বা কোনো আবদার না করলে এবং রোজ রাতে নিজের দেহ দিলে সেও খুশি। মেয়েদের বলে না, যে সংসারই মেয়েদের জগৎ।
আসলে তা নয় মা, মেয়েদের এটা বলা হয় না বা মেয়েরা নিজেরাও স্বেচ্ছায় বলে না একথা। এটা মেয়েদের বোঝানো হয় সেই যখন থেকে প্রথম মাসিকের প্রথম রক্তবিন্দুটা ভূপাতিত হয়, তখন থেকে, যে মেয়েদের সংসার ই সব । কথায় বলে, মেয়েদের স্বামীই সব কিন্তু মা এটা কেন হয় না যে ছেলেদের স্ত্রীই সব?
অবশ্য ছেলেদের কাছে স্ত্রী সব হলে তো সে সঙ্গে সঙ্গে বৌ এর গোলাম, স্ত্রৈণ পুরুষ কত কিই না হয়ে যায়! আচ্ছা মা, ছেলেদের কাছে যেমন তাদের মা আগে, দিদি আগে তারপর বৌ তাহলে মেয়েদের কাছে প্রথমে তার বাবা ও ভাই না হয়ে স্বামী হয় কেন? আসলে মেয়েদের জীবন টা এইরকম ই। যতোই যা বলুক না কেন, মেয়েরা আজ স্বাধীন, ইত্যাদি ইত্যাদি, আদতে কিন্তু আড়ালে থাকা একটা অন্ধকারের জীব! চাকরি করা মেয়েদের মানায় যা, আমাদের মতো গৃহবধূর পক্ষে তা প্রায় অসম্ভব। মেয়েরা দুর্গা তো ঐ চারটে দিনের জন্য কিন্তু গোটা বছরের বাকি দিনগুলির জন্য…!
রূপার কথাগুলো প্রবল ব্যথার কিন্তু রূপা বলছে স্মিত হাসি হেসে। তার বুকের ভিতর টা হু হু করত একদিন, পরে তা পুড়তে পুড়তে ছাই হয়ে গেছে যেই ছাইয়ে জল ঢালার মতো কাউকে এখনো পায়নি সে। রূপার মায়ের চোখে জল চলে আসে মেয়ের কথাগুলো শুনে ।
রূপার সেই প্রানোচ্ছ্বল, প্রানবন্ত অবয়বে কেমন যেন ছাপ পড়েছে আটপৌরে গৃহিণীদের। তাকে দেখলে সবসময় কেমন যেন মনে হয় সে ভিতরে ভিতরে খুব কঠিন কিন্তু অজানা কোনো রোগে ধুঁকছে। এরপর রূপা মায়ের চোখ ছলছল দেখে অন্য কথায় চলে যায়। সে চেষ্টা করে আগের রূপা হতে, মায়ের খুশির জন্য।
কিন্তু মা আজ সত্যিই অনেক কিছু ভাবছে। ভাবছে, মেয়েটা যখন তাদের কাছে ছিল তখন বুঝতেই পারেনি মেয়েটা আসলে নিজের মা, বাবাকে কতটা ভালোবাসত। তাকে উচ্চমাধ্যমিক এর পর আর পড়ালো না অথচ রূপা একজন মেধাবী ছাত্রী ছিল যে আরো অনেক দূর পর্যন্ত পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে অনায়াসে নিজের বাবা, মা, ভাইয়ের দায়িত্ব নিতে পারত।
মেয়ে কাজ করতে চাইত না বলে মেয়েকে সবসময় কাজ করতে দিয়ে বলত , এখন কাজ শিখছিস না পরে চোখের জলে, নাকের জলে করবি। মেয়েটা প্রতিবারই উত্তরে বলত, আমি তো চাকরি করব মা, তোমাকে, বাবাকে, ভাইকে অনেক কিছু দেবো তোমরা যা চাইবে তাই, তোমাদের দেখভাল করব আমি, তখন রান্না বান্না সব শিখে নেব! আর এখন সেই মেয়েটাই কোনো কাজে ভুল করে না। শ্বশুর বাড়িতে কোনো কাজ না শিখেই মেয়েটা গেছিল মায়ের মনে চিন্তার বোঝা দিয়ে কিন্তু কয়েকদিনও লাগেনি রূপার পরিবর্তন ঘটতে।
মেয়েটাকে কখনো মাছের বড় পিসটা দেওয়াই হলো না। নয় বাবা, নয় ভাই। মা নিজেও কখনো খেত না আর মেয়েকেও দিত না। রূপার বর্তমান জীবনের মতোই হয়ত রূপার মায়ের জীবনেও একই গল্প ছিল, কিন্তু রূপার মায়ের জীবনে ছিল বলে সেই একই গল্প মা হয়ে সে মেয়ের জীবনে কেন লিখল! চোখ জলে ভরে যায় আবার। পরে কথা বলবো রে মা, তুই এখন বিশ্রাম নে”, বলে ফোন কেটে দেয় রূপার মা।
রূপা বুঝতে পারে মা কষ্ট পাচ্ছে কিন্তু কিছু সময়ে সান্ত্বনা কষ্টকে দমন করতে পারে না তাই সে আর কিছু বলে না শুধু একটা কথাই বলে, “মা আমি সত্যি অনেক ভালো আছি, তুমি এত মন খারাপ কোরো না।”
অভি আজ বাড়ি ফেরে তাড়াতাড়ি। রূপা রোবটের মতো আবার সমস্ত কাজ শুরু করে দেয়। আগে অভির নজরে রূপার এইরকম আচরণ গুলো পড়ত না নাকি সে কখনো দেখতেই চাইত না জানে না। তবে এখন খুব চোখে পড়ে। সে আজ খুব রেগে ছিল অফিসের অত্যধিক কাজ ও তার কর্মচারীদের আলস্যতার উপর। তাই আজ সে রূপা খাবার নিয়ে এলে খাবারটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ঠাস করে চড় মারে রূপাকে আর চিৎকার করে বলে, “তোমার মতো রোবটিকস্ মেয়ের সাথে আমার পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। আই উইল ডিভোর্স ইউ!”
রূপাকে চড় খেয়ে চুপচাপ, নির্বিকার দেখে অভি আরো রেগে যায়। সে বলে, তোমার প্রবলেম টা কি বলোতো? কেন এইরকম অস্বাভাবিক আচরণ করছ?
পড়ুন- জীবনের বাস্তব গল্প- জনগণের রক্তে সুখ খোঁজা পিশাচ
এরপর রূপা যা বলে, অভি তা কখনোই ভাবতে পারিনি বা সে সেই কথাগুলো কখনো ভুলতে পারবে কিনা সেই বিষয়ে সন্দেহ আছে।
রূপা অনেকক্ষণ স্তব্ধ থাকার পর বলে ওঠে, “ইচ্ছে করলে এর পাল্টা চড় আমিও দিতে পারতাম তোমায়, কিন্তু আমি দেবো না কারণ একটাই, আমার বিবেক। কিন্তু অন্যায়ের কাছে বিবেক প্রদর্শন অন্যায়ের সাথে আপোষ আর নিজের সাথে বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। আমি কেন এইরকম অস্বাভাবিক আচরণ করি কখনো ভেবে দেখেছ, কখনো আমাকে দেখেছ তুমি! একটা মেয়ে নিজের বাবা মা কে, পরিবারকে ছেড়ে অন্য ছেলের সাথে অন্য বাড়িতে যদি শুধু মাত্র হাড়ভাঙ্গা খাটুনি আর দেহবিলানোর জন্যই আসে তাহলে প্রতিটা ছেলেই নিজেদের বাড়িতে কাজের লোক রাখুক আর নারীদেহর জন্য এমন অনেক জায়গা আছে….!
আজকের দিন নাকি শিক্ষিত সমাজ, শিক্ষার আলোয় আলোকিত নাকি সবাই! কোথায়! আজকেও পাত্রপক্ষের মুখের সেই পুরোনো বচন বন্ধ হয়নি, হয়নি বলা বন্ধ ‘আপনার মেয়ে সমস্ত কাজ পারে তো?’ হয়নি মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া শেষ, ‘আপনাদের মেয়ে আমাদের বাড়িতে বৌ নয়, মেয়ের মতো থাকবে !’
পুরুষেরই কি একার ক্লান্তি আছে, নারীর নেই ? আচ্ছা, পুরুষদের কেন সবসময় এমন মনে হয় যে মেয়েরা কামুক, নারীদেহই তাদের পরিতৃপ্তির একমাত্র উপকরণ , নারীর মন নয়! কেন মনে হয় না যে মেয়েরা কামুক নয়, ভালোবাসার কাঙাল। কারণ মেয়েরা কারোর কাছ থেকেই পরিপূর্ণ ভালবাসা পায় না তাই তারা একটু মায়া, একটু ভালোবাসা পেলে গোটা বিশ্ব দিয়ে দেয়। একটা মেয়ের মৃত্যু ঘটে, যখন নিজের বাপের বাড়ি থেকে তাকে শিকড় সমেত উপড়ে ফেলে অন্য কারোর জমিতে রেখে আসে! সারাদিন যখন রান্নাঘরে আমি ঝলসে যাই তখন কি একবারও মনে হয় তোমাদের কারোর যে তোমাদের পরিবারের মেয়ে যদি হতো তাহলে ঠিক এক কাজ করতে কিনা।
আমি শ্বশুর শাশুড়িকে নিজের মা বাবাই প্রথম থেকে মনে করে এসেছিলাম কিন্তু ওনারা প্রথম দিন থেকেই আমায় বুঝিয়ে দিয়েছেন আমি এই বাড়ির একজন বাইরে থেকে আসা মানুষ, যার সাথে সম্পর্কটা দূরত্ব রেখে করা উচিত। তোমাদের কাছে বিয়ে মানে হচ্ছে বিনাপয়সায় হাড়ভাঙ্গা খাটুনি করা একজন, কোনো ঝি এর সাথেই যেখানে এতটা অমানবিকতা করা উচিত নয় সেখানে বৌ মানে তো! আর তোমাদের কাছে সংসার, স্ত্রী মানে ভোগ্য বস্তু, যাকে রোজ রাতে তপ্ত বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে যৌনতার উদ্দামে মেতে ওঠাকে বোঝায়, ঠিক বললাম তো!
সারা জীবনের গ্লানি, সারা জীবনের যন্ত্রণা একটা নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে মৃত্যু পর্যন্ত একটু একটু করে পায়। বাবা পারেনি আমায় উচ্চ শিখরে পৌঁছে দিতে, মা ভাবত না কখনো যে তার বড় মেয়েটাও পারে নিজের মায়ের জন্য প্রথম মাইনেতে শাড়ি আনতে, অনেক অভাব ছিল বলেই আমি অনেক স্বপ্ন বুনেও উচ্চমাধ্যমিক এর পর যেতে পারিনি। গরীব ঘরের মেয়েদের জীবন টা এইরকম করেই শেষ হয়ে যায় একদিন। বাপের বাড়িতে সে স্বপ্ন দেখবে ছোটবেলা থেকে, তারপর বয়ঃসন্ধি উঁকি দিলেই মেয়ে বিদায়ের পদধ্বনি বাজে পরিবারের বুকে। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের বিয়েটা অনেকটা কীরকম জানো, সকলের চাঁদা দিয়ে শোরগোল, আনন্দ হৈ হুল্লোড় করে দূর্গাপুজোর পর বিসর্জন দেওয়ার মতো।
পড়ুন- মা বাবার প্রতি সন্তানের ভালোবাসা- একটি মজাদার প্রেমের গল্প
খেয়াল করে দেখো, গরীব বাবাকে অনেক মানুষই অর্থ সাহায্য করে, ওটা হলো চাঁদা, আর তারপর ধুমধাম করে বিয়ে আর তারপর কন্যা বিদায়! যতদিন মেয়ে কুমারী থাকবে ততদিন মা বাবার চোখে ঘুম নেই, রোজ রোজ অশান্তি মনোমালিন্য মেয়ের পড়াশোনা, সখ আহ্লাদ ইত্যাদি নিয়ে। নিজের মেয়েটাই একসময় মা বাবার চিন্তার কারণ হয়ে ওঠে। বাপেরবাড়িতে তাকে মেয়ে নয় বৌ হিসেবে তৈরি করে আর তারপর একদিন যখন সত্যি সত্যি সব স্বপ্ন, ইচ্ছা, আকাঙ্খা কে পরিবারের অভাব, অশান্তি ও ব্যর্থতার দায় পড়ে গলা টিপে মেরে সংসার নামক খাঁচায়, বৌ নামক পাখি হয়ে, স্বামী নামক দড়িতে চোখ, মুখ বাঁধা অবস্থায় ছেড়ে চলে যায় তার বাবা মা, তখন থেকেই পাখিটা আস্তে আস্তে মরতে শুরু করে।
আমার কোনো উচ্চাকাঙ্খা ছিল না, ছিল না অন্য মেয়েদের মতো ঘন ঘন আবদার, বায়না, পার্লার, মেক আপ, ছিল না আমার প্রতি সপ্তাহে নতুন নতুন জিনিস কিনে দেওয়ার অসভ্য জোর, কারণ আমি দেখতাম বাবা কতটা কষ্ট করে আমাদের খাওয়াচ্ছে, পড়াচ্ছে। মা কতটা কষ্ট করে আমাদের বড় করছে। আমার বায়না গুলো মনেই থাকতো কারণ আমার একটা ছোট ভাই আছে, ওর মুখ চেয়ে আমি বড় দিদি হয়ে সবকিছু বিসর্জন দিয়েছিলাম কিন্তু তবুও দিনশেষে আমিই যেন বিসর্জন হয়ে গেলাম পুরো। আমার আর কোনো অভিযোগ, অনুভূতি আকুলতা কিছুই নেই। কষ্ট, আনন্দ আর নেই ।
অনেক জমানো কষ্ট ভরা হৃদয় নিয়ে যখন তোমার বাড়ি এসেছিলাম, ভেবেছিলাম মা, বাবা কোনো কারণে না পারুক , স্বামী নিশ্চ্য়ই বুঝবে, কিন্তু তুমি, কখনো আমার ছলছল করা চোখ দেখোনি, খুঁজেছ চোখে উষ্ণতার চাহনি । ব্যথা ভরা হৃদয় নয়, আমার উপর তোমার সমস্ত যৌন উত্তেজনা ঢেলে দিয়েছ অমানুষের মতো । সারাদিন আগুনে ঝলসে যাওয়া নিজের স্ত্রী কে তোমার স্ত্রী নয়, যৌনপল্লীর যৌনকর্মী মনে হয়েছে।
সত্যিই সংসার একটা আর্টিফিশিয়াল যৌনপল্লীই বটে। কারণ, যৌনপল্লী কে সরাসরি দেখলে লোকে যেমন ছিঃ ছিঃ করে, যৌনকর্মী নারীদের দেখলে যেমন তাদের ঘৃণার চোখে দেখে তেমন সংসারও এমন একটা জায়গা, যেখানে বিয়ে নামক পবিত্র উপাসনাকে অপমান করে, ইচ্ছামত যৌধক্ষুধার নিবৃত্তি হয় অন্য বাড়ি থেকে আসা সর্বহারা মেয়েটার উপর দিয়ে। যৌনপল্লী তে তো তাও টাকা পায় মেয়েরা দেহ বিলিয়ে কিন্তু আর্টিফিশিয়াল যৌনপল্লী সংসার, আসল যৌনপল্লীর চেয়েও বহুগুণ অমানবিক! যে পুরুষ নারীর মন বোঝে না, দুঃখ কষ্ট বোঝে না, শুধু নারীর শরীরই যার কাছে সব সে আর যাই হোক কোনো পুরুষ নয় বা কোনো স্বামীও নয়।
তুমি আমাকে ডিভোর্স দেবে বলছিলে না, আমি ডিভোর্স পেপারে সাইন করে রেখেছি আগেই, আমি তোমাকে মুক্তি দিলাম। আমার রোবটের মতো আচরণ, আমার অস্বাভাবিকতার জন্য দায়ী বা কারণ এখন নিশ্চ্য়ই বুঝতে আর বাকি নেই। আমার কাজে শ্বশুর শ্বাশুড়ি অনেক অনেক খুশি ছিলেন কিন্তু আমি চলে যাওয়ার পর কি হবে সেটা তোমার দায়িত্ব। পারলে নতুন একটা বিয়ে করতেই পারো কিন্তু দেখো, মেয়েটা যেন কখনো নিজের সংসার কে উপাসনা ছেড়ে প্রহসন না ভাবে, নিজের স্বপ্নের পূজ্য স্বামী কে কখনো যেন মনে না হয় একটা যৌনক্ষুধা সম্পন্ন পশু। আর শ্বশুরবাড়ি যেন সত্যিকারের মেয়ের মতোই দেখে। অনেক কথা বললাম, তবে এটাই আমার শেষ কথা তোমার কাছে। তুমি ভালো থেকো আর সবশেষে বলি, আমার স্বপ্নে আমার সংসার আমার কাছে সত্যিই একদিন মন্দির ছিল কিন্তু পরে …!
রূপা চলে যায় এক কাপড়ে। অভি ছুটে যায় রূপাকে ধরতে। কিন্তু রূপা অন্ধকারে হঠাৎ করেই যেন হারিয়ে যায়। মনে হয় অনেক অভিমান, অনেক ব্যথা ভরা মেয়েটার মন এই স্বল্প জীবনে হয়ত কেউই বুঝলো না, এমনকি যার জন্য তার সমস্ত বিসর্জন, জীবনপাত সেই সংসারও না !
গল্পের ভাবনায়-
সুস্মিতার কলমে পরিপূর্ণতা প্রাপ্ত কিছু অসাধারণ গল্প- স্কুল লাইফের প্রেম- দুঃখের ভালোবাসার গল্প অবহেলা থেকে ভালোবাসা স্কুল জীবনের দুষ্টুমি- গন্ধ চক্রান্ত
আমাদের সাথে যুক্ত হবেন যেভাবে- ফেসবুক Group - গল্প Junction ফেসবুক- ছাড়পত্র টেলিগ্রাম- charpatraOfficial WhatsApp Group- ছাড়পত্র (২)
“বাংলা বড় গল্প। এক নারীর সংসার জীবনের গল্পbangla boro golpo”
কি কেন কীভাবের উপর গড়ে ওঠা মানুষের জিজ্ঞাসু মন সর্বদাই নতুন দিগন্তের সন্ধানে পা বাড়ায় ৷ প্রতিটি পদক্ষেপেই নতুন কিছু অভিজ্ঞতা আমাদের ঝুলিতে জমা হয় ৷ সেই অভিজ্ঞতা সকলের সাথে ভাগ করে নেওয়ার মধ্যে এক অফুরন্ত আনন্দ লুকিয়ে থাকে ৷ আর সেই কাজেই হাত বাড়িয়েছে ছাড়পত্রের টিম।
ধন্যবাদ।।